Bangladesh

ইউরোপীয় ইউনিয়নের আলোচনা স্থগিত কী বার্তা দিচ্ছে? পিসিএ কী?

বাংলাদেশে এখন চলছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের ব্যানারে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সব খানে। আজ শুক্রবার সারাদেশে পালন করা হবে প্রার্থনা ও গণমিছিল।

জানা যায়, চলমান বিক্ষোভ ও অস্থির পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাথে পার্টনারশিপ এন্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট (অংশিদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি) নিয়ে আলোচনা স্থগিত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্রের অফিস থেকে একটি ইমেইলের মাধ্যমে বিবিসি বাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

“বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে পার্টনারশিপ এন্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট-এর প্রথম দফার যে আলোচনা সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল সেটি স্থগিত করা হয়েছে। এর পরবর্তী কোন সময় ধার্য করা হয়নি।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে বর্ণনা করেন বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

“যারা এই ডিসিশন (সিদ্ধান্ত) যারা নিয়েছেন তারা একপক্ষকে শুনে এই ডিসিশন নিয়েছেন। তারা ঘটনার অন্যদিক জানার চেষ্টা করেনি। এটা একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত হয়েছে, এটা আমাদের মর্মাহত করেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হক।

তিনি বলেন সরকার এ বিষয়ে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবে।

এই আলোচনা স্থগিত করার একদিন আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেপ বোরেল এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ সরকার ‘দেখামাত্র গুলি করার’ যে নীতি ঘোষণা করেছে এবং গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দ্বারা যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে তাতে তিনি উদ্বিগ্ন।

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, পিসিএ স্থগিত করার সাথে বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতির একটি সম্পর্ক থাকতে পারে।

“কিছু কার্যকারণ সূত্র আপনি এটা থেকে দেখবেন। একটার পিঠে আরেকটা আসলে কিছু যোগসাজশ তো দেখার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি,” বলেন মি. ভট্টাচার্য।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান গত ২৭শে জুলাই লাওসে ‘আসিয়ান’ জোটের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের সাইড-লাইনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল কথা বলেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে। মি. মোমেন সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

“আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের দ্বারা হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা, গণ-গ্রেফতার এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন,” বিবৃতিতে উল্লেখ করেন মি. বোরেল। এসব ঘটনার সুষ্ঠু পরিপূর্ণ তদন্ত এবং দোষীদের বিচার করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“ বিক্ষোভকারী, সাংবাদিক ও শিশু-কিশোরদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে,” বলেন মি. বোরেল। এসব ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

হাজার হাজার মানুষ যাদের আটক করা হয়েছে তারা যাতে আইনগত অধিকার পায় সেটি নিশ্চিত করার কথা বলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই শীর্ষ কূটনীতিক।

এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার কী ধরণের পদক্ষেপ নেয় সেটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। বাংলাদেশ সরকার সব ধরণের মানবাধিকার পুরোপুরি মেনে চলবে বলে আশা করে সংস্থাটি।

অন্যক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে? পার্টনারশিপ এন্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট স্থগিত হলেও বাংলাদেশের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চলমান যেসব অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবার আপাতত কোন সম্ভাবনা দেখছেন না মি. ভট্টাচার্য।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে বাংলাদেশের বর্তমানে ‘এভ্রিথিং বাট আর্মস’, অর্থাৎ ‘অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া বাকি সবকিছুর’ যে চুক্তি রয়েছে, তার আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন অতীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশকে নানা ধরণের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

“তারা যদি মনে করে যে আমাদের একতরফাভাবে বাজার সুবিধা দিয়েছে, সেই বাজার সুবিধা যাদের দেয়া হচ্ছে তারা ন্যূনতম মানবাধিকারকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে না, তখন সে বিবেচনা আসবে কি আসবে না সেটা ভবিষ্যৎ বলবে,” বলেন মি. ভট্টাচার্য।

বাংলাদেশ যত বৈদেশিক বাণিজ্য করে তার প্রায় ২১ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে হয়।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব উত্তম কুমার কর্মকার রয়টার্সকে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আলোচনা স্থগিত করার সাথে সাম্প্রতিক সহিংসতার কোন সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের কারণে এটি স্থগিত করা হয়েছে।

“এটা বোধ হয় খুব বেশি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হবে বলে মনে হয় না,” বলছিলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

পিসিএ কী?

পার্টনারশিপ এন্ড কোঅপারেটিভ অ্যাগ্রিমেন্ট বা পিসিএ হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে অন্যদেশের একটি বিশেষ চুক্তি। এই চুক্তি উভয়পক্ষ মেনে চলতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আন্তর্জাতিকভাবে যে তিন ধরণের বিশেষ চুক্তি করে তার মধ্যে পিসিএ অন্যতম।

এর মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট দেশের গণতন্ত্র সংহত করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে। পিসিএ সাধারণত ১০ বছরের জন্য হয়। মেয়াদ শেষ হবার পরে যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে প্রতি বছর সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়তে থাকে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন পিসিএ করে প্রধানত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভূক্ত দেশ এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য। পিসিএ’র মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংশ্লিষ্ট দেশে শক্তিশালী মুক্তবাজার অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য ভালো পরিবেশ তৈরি এবং বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য সহায়তা করে থাকে।

এছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে পিসিএ’র মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো ও নাগরিক সমাজের সাথে সহযোগিতার কথা বলা হয়।

যে কোন দেশের সাথে পিসিএ করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন চারটি ধাপ অনুসরণ করে। বাংলাদেশের সাথে ইইউ দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে। অর্থাৎ এটি হচ্ছে আলোচনার পর্ব।

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলে, পিসিএ বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ

“আগে বৈদেশিক সহায়তার ওপর বেশি জোর থাকতো। নতুন এই এগ্রিমেন্ট হলে সেখানে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।”

স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি দেশের জন্য যে ধরণের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পিসিএ-তে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে।

এখানে পরিবেশ, শ্রম ও নারীবান্ধব করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসতে চায়।

মি. ভট্টাচার্য বলেন, সেক্ষেত্রে ২০২৬ সাল থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস-এর মতো কিছু সুবিধা পেতে পারে কী না সেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পিসিএ তে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button