Bangladesh

ইন্ডিয়ান বামদের ‘ঝাঁকে’ উপদেষ্টার ঢিল

এ যেন আগুনে ঘি ঢালার ঘটনা। সেই ঘি ঢাললেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নেই’। আর যায় কোথায়? তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে গিরগিটির মতো রঙ বদল করা বামরা। তবে মাহফুজ আলম ‘মুজিববাদী বাম’ শব্দের ব্যবহার করলেও বাংলাদেশে কোনো মুজিববাদী বাম নেই। যারা রয়েছে তারা ভারতপন্থি। দিল্লিতে বৃষ্টি হলে এরা ঢাকায় ছাতা ধরেন। এক সময় চীন ও রাশিয়াপন্থি বামদের দৌড়ঝাঁপ দেখা গেলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় এখন সেটা নেই। বরং শেখ মুজিবুর রহমান ’৭৫ সালে আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে যে বাকশাল গঠন করেছিল সেটাও বাম নেতা মনি সিংয়ের সিপিবির চেতনায় ভর করেই। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি শুনলেই উপদেষ্টা পরিষদের যেসব সদস্যের মন খারাপ হয়ে যায়; যারা সংস্কারের অজুহাতে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছেন; ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ধুয়া তুলে সংস্কারের নামে পশ্চিমা কূটনীতিকদের দিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে ‘সংস্কারের পর নির্বাচন’ চাপ দিচ্ছেন, তাদের কেউ ভারত ঘেঁষা বাম ও কেউ পশ্চিমাদের টাকায় (উচ্ছিষ্ট) পরিচালিত এনজিওর হর্তাকর্তা গিরগিটিরূপী সাবেক বাম। ক্ষমতার দর্পে ঝাঁকে ঝাঁকে বসা এই বামরা কখনোই দেশ ও জনগণের পক্ষে ছিল না, এদের কাজ হচ্ছে বিদেশি মুরুব্বিদের স্বার্থ রক্ষা করা।

গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫ অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ এপ্রিল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ওই বিনিয়োগ সম্মেলনে ৫০ দেশের ৪১৫ জন বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করেন। তারা ৩১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দেন। বাস্তবতা হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে চাইলেও অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। তারা চান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিনিয়োগ না করে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে বিনিয়োগের বার্তা দিয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো অপরিহার্য। আর বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর আবশ্যক। অথচ উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ‘ডিসেম্বরে নির্বাচন’ দাবি কটাক্ষ করছেন। পশ্চিমাদের দূতিয়ালির মাধ্যমে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। আবার তাদের উস্কে দিতে দু-একটি ইসলামী দল ‘বিএনপি নির্বাচনের জন্য পাগল হয়ে গেছে’ মন্তব্য করে বাহবা নিচ্ছেন। প্রশাসনে হালুয়া-রুটির স্বার্থে ‘পানি আর তেল মিশে না’ প্রবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিল্লিপ্রেমী বাম ও ইসলামপন্থি একই সুরে গাইছেন। তারা মুখে নির্বাচনের কথা বললেও পর্দার আড়ালে নির্বাচন পেছানোর দাবিতে একাট্টা।

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ‘একাত্তর ও মুজিববাদী বাম’ ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দেন। তিনি বলেন, ‘মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নেই। লীগের গুম-খুন আর শাপলায় মোদিবিরোধী আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের মস্তিষ্ক এরা। এরা থার্টি সিক্সথ ডিভিশন। জুলাইয়ের সময়ে এরা নিকৃষ্ট দালালি করেও এখন বহাল তবিয়তে আছে। আজ পর্যন্ত মুজিববাদী বামেরা কালচারালি ও ইন্টেলেকচুয়ালি জুলাইয়ের সঙ্গে গাদ্দারি করে যাচ্ছে। দেশে বসে জুলাইয়ের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে এরা চক্রান্ত করেই যাচ্ছে। লীগের এসব বি-টিমও শিগগিরই পরাজিত হবে। অন্য কারও কাঁধে ভর করে লাভ নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘একাত্তরের প্রশ্ন মীমাংসা করার দাবি জানিয়ে বলেন, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। সহযোগীদের ইনিয়ে-বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোটাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে’।

মৌচাকে ঢিল ছুড়লে যেমন হয়, মাহফুজ আলমের ‘মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নেই’ ঢিল ছোড়ায় সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নানান কসরতে তার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার মাদরাসা জীবনের বেশ কিছু ছবি ভাইরাল করা হয়। পাঞ্জাবি পরিহিত ওসব ছবি মূলত শিবিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বলেও প্রচার করে কেউ কেউ ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন।

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, মাহফুজ সময়মতো ঠিক জায়গায় ঢিল ছুড়েছেন। মাহফুজের ভাষায় থার্টি সিক্সথ ডিভিশন যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এরা পতিত হাসিনার পক্ষে দালালি করেছেন। বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণমাধ্যমে প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সম্পাদকীয় লিখে তাদের ভাষায় শিক্ষার্থীদের ‘বিশৃঙ্খল’ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। টিভির টকশোতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারীদের ডা-া মেরে ঠা-া করার পরামর্শ দিয়েছেন। আবার পশ্চিমাদের টাকায় যারা এনজিও ব্যবসা করে মানবাধিকার, পরিবেশ রক্ষা, জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে মায়াকান্না করতে অভ্যস্ত কারা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে রাজপথে রক্তের বন্যা বইলেও তারা গর্তে মুখ লুকিয়ে ছিলেন। ভারতের নাচের পুতুল হাসিনার আওয়ামী লীগ যাতে বিপদে না পড়ে এমন চেতনা ধারণ করে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন। এরা সকলেরই মূলত কালচারালি ও ইন্টেলেকচুয়ালি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে গাদ্দারি করেছে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি হওয়ার পর পশ্চিমাদের ধরে গাদ্দারি করাদের কেউ উপদেষ্টা পরিষদে কেউ সংস্কারবিষয়ক কমিশনে কেউ প্রশাসনে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি কব্জা করেন। তাদের গলার সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিষিদ্ধ থেকে মুক্ত হওয়া জামায়াত কখনো আগে স্থানীয় নির্বাচন পরে জাতীয় নির্বাচন, কখনো সংস্কারের পর নির্বাচন, কখনো বিএনপি নির্বাচনের জন্য পাগল হয়ে গেছে, কখনো ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে নির্বাচন নানামুখী সবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবির আন্দোলনে ‘গোলাম আজমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ স্লোগান জামায়াতিদের জন্য যে বুমেরাং হয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

৯২ ভাগ মুসলমান নাগরিকের এই বাংলাদেশে কখনোই ধর্মনিরপেক্ষতা (সেক্যুলারিজম) প্রশ্রয় পায়নি। মুসলমানরা ধর্মান্ধ না হলেও ইসলাম বিদ্বেষ পছন্দ করে না। ফলে রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পেরে বাধ্য হয়েই দিল্লির চেতনাধারী বামেরা চতুর্দিকে (অন্যান্য দল ও বুদ্ধিজীবী) ছড়িয়ে পড়েছে। এদের একটা বড় অংশ রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে পশ্চিমাদের টাকায় এনজিও খুলে মানবাধিকার-পরিবেশ রক্ষার ব্যবসা করছে। বড় একটা অংশ বিভিন্ন দলের ছায়াতলে থেকে রাজনীতির নামে দিল্লির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। মাওলানা ভাসানী এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। বর্তমানে সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিও এর বাইরে নয়। ইসলামী চেতনার রাজনীতিতে বিশ্বাসী শেখ মুজিবুর রহমান ’৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরে (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে বোঝা যাবে) প্রথমে বামদের খপ্পরে পড়েন। কমরেড মনি সিংয়ের খপ্পরে পড়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ চার মূলনীতি করেন। পরবর্তীতে ’৭৫ সালে দেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ বিলুপ্তি এবং বাকশাল গঠনের মাধ্যমে বামদের চেতনার ষোলকলা পূর্ণ করেন। ’৭৮ সালে জিয়াউর রহমান যখন বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতর্বন করেন তখন বামেরা নানা প্রক্রিয়ায় বিএনপিতে প্রবেশ করেন। জাতীয়তাবাদী ধারার দল বিএনপি এখনো সেখান থেকে বের হতে পারেনি। আর ইসলামী ধারার দল হিসেবে পরিচিত জামায়াত ’৭৮ সালে নতুন যাত্রা শুরু করে কখনোই জনগণের মনন বোঝার চেষ্টা করেনি। স্বৈরশাসক এরশাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে ’৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া, ’৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা এবং এখন ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ স্টাইলে কখনো জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সুরে সুর মিলিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, কখনো বিএনপির দাবির প্রতি সমর্থন করা আবার প্রেসিডেন্ট সাহাবু্িদ্দন চুপ্পুকে সরানো, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ইস্যু, দিল্লির বিরুদ্ধে জামায়াত নয়, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীরা যেমন খুশি পোশাক পরতে পারবে, বিএনপি চাঁদাবাজি করছে, সংস্কারের পর নির্বাচন ইত্যাদি বক্তব্য দিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ থিওরি কাজে লাগিয়ে ‘নির্বাচনের দাবি শুনলে যাদের শরীর জ্বালাপোড়া করে’ সেই বাম চেতনার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের ব্যবহার করে প্রশাসনে জাতায়াতি ধারার কর্মর্কতাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে শিক্ষা বিভাগের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে জামায়াত চেতনার কর্মকর্তারা জেঁকে বসেছেন। তথ্য ও সম্প্রদার উপদেষ্টা বিষয়টি ভালোভাবেই ধরে ফেলেছেন। যার কারণে ফেসবুকে দেয়া তার দু’টি স্ট্যাটাস নিয়ে তোলপাড় চলছে। বামদের মৌচাকে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টার ঢিলে দিল্লির তাঁবেদার ও পশ্চিমাদের উচ্ছিষ্টভোগী বামদের সম্পর্কে দেশবাসী সতর্ক না হলে সামনে আরো বিপদে পড়তে হবে। অতএব দিল্লির চেতনাধারী বামদের থেকে সাবধান!

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto