Bangladesh

ইফতারে খেজুরের বদলে বরই, কী বিচিত্র উন্নয়ন!

উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে বাংলাদেশ ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ এগিয়ে চলছে। পদ্মা সেতু, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলি নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণ, রাজধানীতে অসংখ্য ফ্লাইওভার, উড়াল সড়ক, মেট্রোরেল চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন দৃশ্যমান। রাজধানী ঢাকায় অসংখ্য ফ্লাইওভার দেখে মনে হয় না দেশের মানুষ কষ্টে রয়েছেন, মূল্যস্ফীতিতে লাখ লাখ পরিবার ক্রয় ক্ষমতা হারিয়েছে। পবিত্র রমজান মাসে সারাদিন রোজা রাখার পর খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার করা মুসলিম পরিবারগুলোতে শত শত বছরের রেওয়াজ। সেই খেজুর দিয়ে ইফতার করার সংগতি হারিয়েছে হাজার হাজার পরিবার। ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বল্গাহীন পণ্যমূল্য করার পরও মন্ত্রীরা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে রোজদারদের খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। অথচ পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোজাদারদের ইফতারে খেজুর খাওয়া মহৌষধের কাজ করে থাকে। খালি পেটে বরই খাওয়া উচিত নয়।

রাজধানীতে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প করা হলেও বাস্তবে রাজধানী ঢাকা ভয়াবহ যানজট আর শব্দদূষণ-বায়ু দূষণের নগরী। সড়ক মহাসড়কে চলাচলে যানবাহনের গতি বাড়েনি বরং ক্রমান্বয়ে কমছে। ১০ বছর আগেও যে দূরত্ব অতিক্রম করতে ২০ মিনিট লাগতো এখন সে দূরত্ব অতিক্রম করতে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। একদিকে চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন অন্যদিকে বিপর্যস্ত মানুষের জীবন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের উন্নতি ঘটলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বড় অংশ ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বেঁচে থাকার লড়াই করতে মানুষ খাবার ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থা জরিপ করে জানিয়েছে, ঢাকা শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে দিনে তিন বেলার বদলে দু’বেলা খাচ্ছেন। সংসারের অন্যান্য খরচ কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি বাসা ভাড়া দেয়ার মতো আয়-রোজগার না থাকায় গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন অসংখ্য কর্মজীবী ও বেকার মানুষ। এমন প্রেক্ষাপটে বছর ঘুরে পবিত্র মাহে রমজান আসছে। সিয়াম সাধনার এই মাসে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না থাকার বাস্তবতার নিরিখে গত ৪ মার্চ ডিসি সম্মেলনে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন রোজাদারকে ইফতারে খেজুরের পরিবর্তে বরই, পেয়ারা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলন শেষে শিল্পমন্ত্রী বলেছেন,‘আঙুর-খেজুর নয়, বরই-পেয়ারা দিয়ে ইফতার করুন। ইফতারে আপেল লাগে কেন? আঙুর লাগে কেন? আমাদের অভাব অভিযোগ আছে। ইফতারে পেয়ারা খান ইফতারের প্লেট সেভাবে সাজান।’

অপ্রিয় হলেও সত্য যে শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। চোখ ধাঁধানো ব্রিজ, কালভার্ট দেখা গেলেও ভিতরে ভিতরে অর্থনীতি কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে। ডলার সংকট, ঘুষ দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচারের মতো ভয়াবহ ঘটনা এবং মূল্যস্ফীতিতে নাকাল হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না অথচ প্রতিদিন কেউ না কেউ কাজ হারাচ্ছেন। উন্নয়নের নামে যে প্রচারণা চলছে তা কার্যত ‘পান্তাভাত’ খেয়ে ‘দুধভাত’ খাওয়ার ঢেঁকুর তোলার মতোই। মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে কর্পেটের নিচে চাপা দিয়ে ঝকঝকা ফকফকা উন্নয়ন দেখানো হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে ইফতারে খেজুর খাওয়ার অবস্থা যে দেশের বেশির ভাগ মানুষের নেই; সে দেশে এত্তো এত্তো উন্নয়ন! প্রশ্ন হচ্ছে ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে পবিত্র রমজানে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের রোজাদার ইফতারে খেজুর কিনে খেতে পারে না সে দেশে এত্তো উন্নয়ন হারমোনিয়াম কার জন্য বাজছে?

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদের ইফতারে খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ দেশের প্রকৃত চিত্র উঠে এলেও এ নিয়ে নেট দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। তার এ পরামর্শ মানুষ ভালভাবে নেয়নি। প্রথমে প্রতিবাদ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরীক ১৪ দলীয় জোটের জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু। শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের উদ্দেশে ইনু বলেন, ‘আমি বরই দিয়ে ইফতার করবো। আর তুই খেজুর-আঙুর খাবি? তা হবে না, তা হবে না।’ ইনুর এ বক্তব্য নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল ও বাম দলগুলোও শিল্পমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। তারা সরকারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে মন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘জনগণের সঙ্গে মস্করা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সত্যিই খেজুরের মতো পণ্য এখন বেশির ভাগ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। মন্ত্রী দেশের অর্থনীতির নাজুক চিত্র তুলে ধরেছেন। বাস্তবতা হলো মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক হলেও তার বক্তব্যে যে ‘বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির সার্বিক চিত্র’ উঠে এসেছে তা বলাইবাহুল্য। তা না হলে দীর্ঘ দুই বছর চেষ্টা করেও ডলার সংকটের সুরাহা করা যায়নি। দেশের সাধারণ গ্রাহকরা ব্যাংকিং খাতের প্রতি আস্থা হারিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা রাখা কমিয়ে দিয়েছে।

নানা চেষ্টা তদবির করেও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র ও মানুষের কষ্টদায়ক জীবনের ভয়াবহ চিত্র গণমাধ্যমগুলোতে আসছে না। কারণ দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যম সরকারের তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর যারা বিক্রি হননি তারা সাইবার আইনে মামলার ভয়ে প্রকাশ করছেন না। যে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ খেজুর কিনে খাওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে সে দেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল দাবি করার যৌক্তিকতা কতটুকু?

খেজুরের বদলে বরই দিয়ে ইফতার ইস্যুতে তোলপাড়ের মধ্যে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘ইফতারে খেজুর না খেলে কী হয়?’ গত শুক্রবার কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের ঝড় বইছে।

ইফতারে খেজুরের বদলে বরই খাওয়ার পরামর্শ নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা সহসাই শেষ হবে বলে মনে হয় না। কারণ খেজুরের সঙ্গে ইফতারের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামিক চিন্তাবিদরা জানান, মুসলিম সমাজে ইফতারে খেজুর খাওয়ার প্রচলন রয়েছে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসরণেই। বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই রমজানে ইফতারিতে খেজুর খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এটা সুন্নত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ইফতারিতে খেজুর খাওয়া মানুষের আধ্যাত্মিক আকাক্সক্ষা। কিন্তু দামের কারণে খেজুর ক্রয় আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে ভোক্তাদের মধ্যে এ নিয়ে অতৃপ্তি, অসন্তোষ ও অস্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে।

দেশের পুষ্টিবিদরা বলছেন, সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারে (খালি পেটে) খেজুর সবচেয়ে উপকারী। যার সঙ্গে অন্য কোনও ফলের তুলনা চলে না। ইফতারে খাদ্য হিসেবে বরই কখনও খেজুরের বিকল্প হতে পারে না। খেজুরের ১১টি উপকারিতা রয়েছে। খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, আয়রন, ভিটামিন এবং ম্যাগনেসিয়ামসহ নানান পুষ্টিগুণ। সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারে খেজুর খেলে ফলটিতে থাকা এসব খাদ্য উপাদান শরীর সতেজ করে তোলে। ডাক্তারদের ভাষায়, পেট খালি থাকলে মস্তিষ্কের স্মৃতি ধারণক্ষমতা কমে, কর্মশক্তি হ্রাস, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, পেশির সমস্যা, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধি, হিমোগ্লোবিনের অসামঞ্জস্যতা, হজমে সমস্যা, ডায়াবেটিস, হাড় ক্ষয়, ত্বকের নানা সমস্যা হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। আর এসব সমস্যারই সমাধানে একটি দামি অস্ত্র হচ্ছে খেজুর। খেজুর মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বাড়ায়, কর্মশক্তি বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে তোলে, পেশিকে করে মজবুত, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে, রক্তে হিমোগ্লোবিনের সামঞ্জস্যতা বজায়, পরিপাকে সহায়তা করে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, হাড়ের সুরক্ষা দেয়, ত্বকের যত্নে সহায়তা করে। অন্যদিকে বরই মানুষের শরীরের জন্য অনেক উপকারী হলেও ইফতারে রোজাদারদের জন্য খেজুরের বিকল্প হতে পারে না। বরই অত্যন্ত চমৎকার একটি রক্ত বিশুদ্ধকারক ফল। উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য টক বরই অত্যন্ত উপকারী। ডায়রিয়া, ক্রমাগত মোটা হয়ে যাওয়া, রক্তশূন্যতা, ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে চমৎকার কাজ করে বরই। পটাসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন এবং জিঙ্ক সমৃদ্ধ হওয়ায় বরই শরীরের রক্ত প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বরই ফল টক হয়। টক জাতীয় ফল খালি পেটে না খাওয়াই স্বাস্থ্য সম্মত নয়। বরই খেয়ে ইফতার নয়, ইফতারের পর বরই খাওয়া উচিত। এতে করে বরই গুণাগুণ শরীরে উপকারে আসবে। তাছাড়া বরই ক্যালরি ও ফ্যাট কম থাকার কারণে ওজন বৃদ্ধি হয় না। তাছাড়া শুকনো বরই খেলে শরীরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যেমন পেটে ব্যথা সমস্যা হতে পারে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইফতারে বরই খাওয়া যেতে পারে। তবে খেজুরের বিকল্প নয়। সিয়াম সাধনার মাসে রোজাদারগণ সারাদিন রোজা রেখে ইফতার করেন খেজুর মুখে দিয়ে। খেজুর রোজাদারদের শরীরের জন্য উপকারী। ইফতারের পর বরই খাওয়া ভাল তবে ইফতারের সময় খালি পেটে বরই খাওয়া উচিত নয়।

বাংলাদেশে এত্তো এত্তো উন্নয়ন। গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন রোল মডেল। অথচ দেশের মানুষের বৃহৎ অংশ পবিত্র রমজান মাসে খেজুর কিনে ইফতার করার সামর্থ্য হারিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ পণ্য ক্রয়ে সামর্থ্য হারিয়ে দিনের খাবার কমিয়ে দিয়েছে। অথ” সরকারের তাবেদার গণমাধ্যমগুলোতে নিত্য প্রচার হচ্ছে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে দেশ। কী বিচিত্র দেশ! দ্বিজেন্দ্রনাথ রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (নাটকে) আলেকজান্ডার ভারতে প্রবেশের সময়ে এ উপমহাদেশের মানুষের চিত্র-বিচিত্র চরিত্র দেখেন। এ সময় তিনি প্রধান সেনাপতি সেলুকাসকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’ আলেকজান্ডার বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেখলে কী বলতেন কে জানে?

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d