ইভিএম ধ্বংস না মেরামত: সিদ্ধান্তহীনতায় নির্বাচন কমিশন
শুরুতে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কেনা হয়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার সেট ইলেকট্রনিক ভেটিং মেশিন (ইভিএম)। ক্রটিপূর্ণ ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) কারণে এই মেশিন এখন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এগুলো সংরক্ষণে কোনো গুদাম তৈরি বা ভাড়ার কথা চিন্তাই করা হয়নি। ফলে বরাদ্দ না থাকলেও এখন বাধ্য হয়েই রাজস্ব খাত থেকে দিতে হবে ৫৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ওয়্যারহাউজ ভাড়া। পাশাপাশি আগামীতে এগুলো কোথায় রাখা হবে তা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ইতোমধ্যেই ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৬০ কোটি টাকা খরচের অনুমতি চাওয়া হলেও বৈদেশিক মুদ্রার কথা চিন্তা করে সেটি দেয়নি অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই মুহূর্তে ৪০ হাজার ইভিএম নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। যেগুলোর অধিকাংশই অমেরামতযোগ্য। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার মেশিন নিষ্ক্রিয় হওয়ার পথে। এগুলো মেরামত করা না হলে নষ্ট হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ভবিষ্যতে নির্বাচনে এসব মেশিন ব্যবহার করা না হলে নষ্টগুলো ধ্বংস করা যেতে পারে-এমন অভিমত দায়িত্বপ্রাপ্তদের। সবমিলিয়ে এই ইভিএম ধ্বংস না মেরামত করা হবে-তা নিয়ে বেশ সিদ্ধান্তহীনতায় আছে ইসি।
এসব দিক বিবেচনা করে আবার মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে ‘নির্বাচন ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার’ শীর্ষক প্রকল্পের। এটি নিয়ে গত ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) নবম সভা। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
সূত্র জানায়, ওই সভায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই ইভিএমের আয়ুষ্কাল ১০ বছর বিবেচনায় নিয়ে মেরামতযোগ্য ইভিএম যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে আরও ৩-৫ বছর বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে। অথবা ভবিষ্যৎ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে নষ্ট ইভিএমগুলো ধ্বংস করা যেতে পারে। মেরামত ও নষ্ট উভয় ক্ষেত্রেই অর্থের সংশ্লেষ আছে। এ অবস্থায় মেরামতের সিদ্ধান্ত হলে প্রকল্পের মেয়াদ ৬ থেকে ১২ মাস বৃদ্ধি করা প্রয়োজন হবে।
ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) সৈয়দ রাকিবুল হাসান রোববার বলেন, ডিপিপিতে ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ কোনো অর্থই ধরা ছিল না। যেটি মনে হয় প্রকল্প প্রস্তাব থেকে ব্যয় কেটে দেওয়া হয়েছিল পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশেই। পরবর্তী সময়ে আর যুক্ত করা হয়নি। ফলে এখন এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইভিএম রাখার জন্য টাকা যে দিতে হবে সে বিষয়ে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি। পরে এই প্রতিষ্ঠানটি ওয়্যারহাউজের ভাড়া বাবদ টাকা দাবি করছে। একটা জায়গা ব্যবহার করলে তো এমনিতেই ভাড়া দেওয়া উচিত। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলোতে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস আছে। সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করা না গেলে এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত ইভিএম মেরামত বা ধ্বংস করার কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তবে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, যতদিন ব্যবহার করা যায় ততদিন করতে হবে। তবে এগুলো যদি মেরামত করা না হয় তাহলে অবশ্যই বোঝা হয়ে যাবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা অবশ্যই রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। এ কথা পরিষ্কার যে, ইভিএম নিয়ে একটা বাণিজ্য হয়েছিল। কেননা আমাদের দেশের আবহাওয়ায় অনুপযোগী এবং কারিগরি দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল ও নিম্নমানের এসব ইভিএম মেশিন কেনা হয়েছিল। এসব মেশিন দিয়ে সহজেই জালিয়াতি করা সম্ভব। ইভিএম কেনার ক্ষেত্রে ওই সময় গঠিত কারিগরি কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সুপারিশও মানা হয়নি। তাই যারা ইভিএম কেনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এছাড়া সংরক্ষণের অভাবে বা অবহেলায় যদি এই যন্ত্রগুলো নষ্ট হয়ে যায় তাহলে হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এক্ষেত্রে বলা যায় অবশ্যই ডিপিপিটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তবে এই ত্রুটি অনিচ্ছাকৃতভাবে যে করা হয়েছে তা নয়। ইভিএম ছাড়াও অনেক প্রকল্পে এ রকম ত্রুটি রেখে দেওয়া হয় কৌশল হিসাবে। কারণ যাতে মোট প্রকল্পের ব্যয় বেশি দেখা না যায়, এতে অনুমোদনে সুবিধা হয়। পরবর্তী সময়ে আবার যেসব অপরিহার্য ব্যয় বাদ দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর জন্য আলাদা বরাদ্দ নেওয়া হয়। ইভিএম কিনলে যে সংরক্ষণ করতে হবে এটা বোঝা তো কঠিন কিছু নয়। কিন্তু এখানে এ ব্যয় ধরা হয়নি। এর মানে হলো মেশিন কিনলে তো পরে বাধ্য হয়েই সংরক্ষণ ও মেরামত ব্যয় বরাদ্দ দিতে হবে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৬৭৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ডিপিপি অনুসারে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯৬ দশমিক ০২ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ইতোমধ্যেই ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম সেট ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি, ৬টি সফটওয়্যার, ৫টি যানবাহন এবং ৯ হাজার ২০০টি রেক কেনা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ইভিএমের মাধ্যমে গত ২৫ মার্চ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩৯৪টি নির্বাচন পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের ৩১ আসনে (উপনির্বাচনসহ), জেলা পরিষদ ও উপনির্বাচন করা হয়েছে ৬৬টি এবং ২৪টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন করা হয়েছে। আরও আছে ২৩৫টি পৌরসভা নির্বাচন, ৩৪টি উপজেলা নির্বাচন এবং ১ হাজার ৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছে।
গত ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশব্যাপী কোয়ালিটি চেকিং করে (কিউসি) কার্যক্রম শেষে বর্তমান ইভিএমের স্থিতির পরিমাণ হয়েছে বিএমটিএফ ১ লাখ ১ হাজার ৩৫টি, মাঠ পর্যায়ে ৪৮ হাজার ২৬৭টি এবং প্রকল্প কার্যালয়ে ৬৯৮টি। মোট ১ লাখ ৫০ হাজার সেট। কিন্তু এই ইভিএম সংরক্ষণের জন্য আগে থেকেই কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের (বিএমটিএফ) লিমিটেডের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউজে রাখা হয়। এরপর সংস্থাটি ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ বকেয়া ৫৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দাবি করে। কিন্তু ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) ওয়্যারহাউজ ভাড়া বাবদ কোনো বরাদ্দ না থাকায় বিএমটিএফের চাহিদা করা অর্থ পরিশোধ সম্ভব হয়নি। তবে ২৭তম নির্বাচন কমিশন সভায় বিষয়টি আলোচনায় আসে। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, রাজস্ব খাত থেকে ওই ওয়্যারহাউজ ভাড়ার বকেয়া অর্থ একসঙ্গে পরিশোধ না করে একটি দ্বিপক্ষীয় সভা করে কিস্তিতে পরিশোধ দেওয়া যেতে পারে।
এদিকে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধিত প্রস্তাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপিতে ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার সংশ্লেষের বিষয়টি উল্লেখ করে ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাবটি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিইএ) অনুমোদন করেনি। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের আরডিপিপিতে (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বরাদ্দ আছে। এছাড়া ডিপিপি অনুযায়ী বিএসটিএফকে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো অর্থ বৈদেশিক মুদ্রা বা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে পরিশোধ করতে হয় না। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা।
ওই সভায় আরও জানানো হয়, আগামী ৩০ জুন প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইভিএমগুলো তিন স্থানে রয়েছে। মাঠ, বিএমটিএফ এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মাস্টমাইজেশন সেন্টারে। এছাড়া ইভিএম রেক মাঠ পর্যায়ে এবং বিএমটিএফের ওয়্যারহাউজে সংরক্ষিত আছে। এ অবস্থায় বিপুলসংখ্যক ইভিএম ও রেক কীভাবে হস্তান্তর করা যায়, তার একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এক্সিট প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনকে এসব ইভিএম সরবরাহ করেছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বিএমটিএফ)। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই সংস্থা ইসিকে জানিয়েছিল, প্রায় ৪০ হাজার যন্ত্র নষ্ট। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএমেরও মেরামত প্রয়োজন। এজন্য লাগবে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় তখন ইসিকে এই অর্থ বরাদ্দ করেনি। বিভিন্ন সূত্র জানায়, এখন দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে অন্তত ১ লাখ ৫ হাজার ইভিএম অকেজো বা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ৩০-৪০ হাজার ইভিএম একেবারেই নষ্ট বা মেরামত অনুপযোগী। মূলত মাঠপর্যায়ে ইভিএমগুলো সংরক্ষণ করা এবং মেরামতের জন্য বরাদ্দ না থাকায় বেশির ভাগ ইভিএম আংশিক নষ্ট হয়ে গেছে।
ইভিএমগুলোর এ অবস্থার পরও গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও নতুন করে দুই লাখ ইভিএম কিনতে চেয়েছিল বর্তমান কমিশন। এজন্য তারা ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠায় পরিকল্পনা কমিশনে। তবে অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়নি।