ইয়াবা ১১ আন্তর্জাতিক রুটে
দেশে ইয়াবা প্রবেশের ঢল নেমেছে অপ্রচলিত ১১ আন্তর্জাতিক রুটে। সীমান্তবর্তী ৯ জেলার বিভিন্ন পয়েন্ট হয়েই আসছে ইয়াবার চালান। মূলত ইয়াবা প্রবেশদ্বার খ্যাত কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তবর্তী মিয়ানমার অংশ সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার পর ইয়াবা মাফিয়ারা অপ্রচলিত রুট ব্যবহার করে দেশে নিয়ে আসছে বড় বড় চালান।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা বলেন, ‘অপ্রচলিত রুট ব্যবহার করে ইয়াবা আসছে তা আমাদেরও নজরে এসেছে। কয়েকটি চালান আমরাও জব্দ করেছি। অপ্রচলিত রুট ব্যবহার বিষয়টি খুবই সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’ র্যাব-৭ অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুবুল আলম বলেন, ‘নতুন রুট ব্যবহার করে ইয়াবা পাচারের সময় আমরা একাধিক চালান জব্দ করেছি। তাই সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন পথে ইয়াবা পাচার রোধে বিজিবির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে র্যাব।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, কয়েক মাস আগেও দেশে আসা ইয়াবার সিংহভাগ চালান আসত বঙ্গোপসাগর ও কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকা হয়ে। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরকান আর্মির মধ্যে সংঘাতের কারণে ইয়াবা ও অন্যান্য মাদক আসার রুটগুলো কার্যত বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ইয়াবার আসার পুরনো রুট মংডু এবং সিত্তের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। বুথিডং, রাথিডং এবং পারতোয়াসহ কিছু কিছু এলাকা দখল নিয়েছে বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন আরকান আর্মি। ইয়াবা পাচারের পুরনো এ রুটগুলোতে সেনাবাহিনী এবং বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠনগুলোর নিয়মিত সংঘাতের কারণে অপ্রচলিত ১১ আন্তর্জাতিক রুট ব্যবহার করেই আসছে ইয়াবার চালান। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, ত্রিপুরা, আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যের অপ্রচলিত ইয়াবা রুটকে।
রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে সান স্টেট- মান্দালে-সাগাইং অঞ্চল-মনেয়া-কালে- মোরে (মনিপুর)-আইজল (মিজোরাম)-পানিসাগর-শিলং-করিমগঞ্জ হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত। একই রুটে কিছু অংশ ব্যবহার করছে শিলং-শিলিগুড়ি-মালদা হয়ে যশোর এবং সাতক্ষীরার তিনটি রুট। আইজল (মিজোরাম)-ইমরপাল (মনিপুর)-পানিসাগর-সিলচর-শিলং-তেলিয়া মুড়া-উদয়পুর হয়ে সোনামুড়া (কুমিল্লা সীমান্ত), বিলোনিয়া (ফেনী), বক্সানগর (বিবাড়িয়া সীমান্ত) এবং খোয়াই (হবিগঞ্জ) এ চার রুট দিয়ে হয়ে প্রবেশ করছে মাদকের চালান। আইজল (মিজোরাম)-কহিমা (নাগাল্যান্ড)-শিলং-গোয়াহাটি (মেঘালয়)-সুনামগঞ্জ সীমান্তের কেকেরঘাট এবং একই রুট ব্যবহার করে মধ্যনগর-ধুরবী-আসাম নদীপথে কুড়িগ্রাম ও রৌমারী দিয়ে বাংলাদেশ আসে মাদকের চালান।
এ রুটগুলোতে ইয়াবা পাচারে মিয়ানমার অংশে নেতৃত্ব দিচ্ছে মিয়ানমার ভিত্তিক বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন- টাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাট অ্যালাইন্স আর্মি (এমএনডিএএ), কাচিন ন্যাশনাল অর্গারেশন (কেএলও), ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ), ইউনাটেড ওয়াহ স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ), কাচিন ডিফেন্স আর্মির (কেডিআই), কাচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ), আরকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), চিন ন্যাশনাল আর্মি, চিন ডিফেন্স ফোর্স (সিডিএফ), চিন লিবারেশন আর্মি, মিজু ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ)। দেশের সীমান্ত এলাকার মাদক অপরাধ নিয়ে গবেষণা করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর অঞ্চলের উপ-পরিচালক হুমায়ন কবির খোন্দকার।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের আরকান রাজ্যের সিত্তে থেকে উত্তর রাখাইন পর্যন্ত সীমান্ত ও আশপাশ এলাকায় সংঘাত চলছে সেনাবাহিনী ও আরকান আর্মির মধ্যে। একই কারণে সাগরেও কড়াকড়ি চলছে। তাই পুরনো রুট দিয়ে কার্যত মাদক পাচার বন্ধ। এ রুট বন্ধ থাকলেও ইয়াবা ও অন্যানা মাদক পাচার থেমে নেই। বরং ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, ত্রিপুরা রাজ্য হয়ে কিছু চালান দেশে প্রবেশ করছে। এরই মধ্যে ওই রুটগুলো দিয়ে আসার সময় ইয়াবার চালান জব্দও করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।’ হুমায়ন কবির খোন্দকার বলেন, ‘মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠনগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে অধিক হারে। তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে তাদের সংগঠন পরিচালনা ব্যয়ও বেড়েছে। এ ব্যয়ের জোগান দিতে তারা মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা করছে। আগের কিছু রুট বর্তমানে বন্ধ থাকলেও থেমে নেই তাদের তৎপরতা। বরং নিত্যনতুন রুট সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠনগুলো ইয়াবা চালান পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে।’