ইরানে আমেরিকার আক্রমণের পরিণতি কী হবে?
আমেরিকার ঢালাও আগ্রাসন ইরানকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে, যে পরিণতি ওয়াশিংটন আরও অনেক দেশে তৈরি করেছে।
জর্ডানের সিরিয়া সীমান্তে ড্রোন হামলায় তিন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যেকার উত্তেজনা এক বিপজ্জনক মোড় নিয়েছে। মার্কিন রাজনীতিবিদরা এখন ইরানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হামলার আহ্বান জানাচ্ছেন।
এই অবস্থায়, প্রেসিডেন্ট বাইডেন যদি সরাসরি ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত নেন- তাহলে আঞ্চলিক শক্তিটির সাথে বৈশ্বিক পরাশক্তির যুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে অবধারিত। মধ্যপ্রাচ্যে স্নায়ুযুদ্ধের খোলস ছেড়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়– তাহলে বিশ্বের ব্যস্ততম নৌপথে তারই বা কী প্রভাব পড়বে?
অবশ্যই, পরিণাম শুভ হবে না বিশ্বের জন্য।
পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত নৌপথ হরমুজ প্রণালীর পাশেই ইরানের ভৌগলিক অবস্থান। পারস্য উপসাগরে রয়েছে ইরানের বৃহৎ জলসীমা। ফলে যুদ্ধের সময় ইরান এখানে জাহাজ চলাচলে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। পুরো বিশ্বে যার অর্থনৈতিক অভিঘাত ছড়িয়ে পড়বে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথ। কারণ, হরমুজ প্রণালী দিয়েই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ৪০ শতাংশ রপ্তানি হয়। যুদ্ধের সময় ইরান এ জলপথে বেছাতে পারে জাহাজ বিধ্বংসী মাইন। তেল ও গ্যাসবাহী ট্যাংকার জাহাজের চলাচল যাতে অনিরাপদ হয়ে উঠবে। আর তাতে ব্যাহত হবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি প্রবাহ।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দ্রুত এর বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থাও যদি নেয়, তবুও জ্বালানির দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে এটাই হয়তো ইরানের প্রথম পদক্ষেপ হবে না।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা রে তাকেহ বলেন, “সাধারণত আমেরিকার এই ধরনের আক্রমণের মুখে, ইরান তাৎক্ষনিকভাবে এবং সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বরং তেহরান অসম কৌশলে এবং দীর্ঘ সময় ধরে- পাল্টা জবাব দেয়।”
ইরান সাধারণত সরাসরি ও প্রচলিত যুদ্ধকে এড়িয়ে চলে। এবং, প্রক্সি বাহিনীর মাধ্যমে গেরিলা কৌশলে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে চাপ সৃষ্টি করে।
তবে ইরানে সরাসরি আক্রমণ হলে- এর তীব্রতা বাড়তে পারে। তাতে করে, মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। বিশেষত, ইরানের চেষ্টা থাকবে প্রক্সি বাহিনীগুলোর মাধ্যমে একাধিক ফ্রন্টে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যতিব্যস্ত রেখে, তার শক্তিক্ষয়ের।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের প্রক্সি বাহিনীর বড় একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। যা গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় নিহত ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল কাশেম সোলায়মানি।
ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী উচ্চ প্রশিক্ষিত এবং ইরানের তৈরি সর্বাধুনিক অস্ত্র তাদের রয়েছে। ইরানের প্রচলিত সামরিক বাহিনীর সাথে সাথে বিপ্লবী গার্ডও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। তবে নিজ দেশের বাইরে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সামরিক, আর্থিক ও অন্যান্য ধরনের সহায়তা দেওয়া– তাদের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। দরকারের সময়, বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডাররাও প্রক্সিদের অপারেশন পরিকল্পনায় সাহায্য করেন।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদের পক্ষে ইরানের প্রক্সি হিজবুল্লাহ’র সদস্যদের সাথেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে বিপ্লবী গার্ডের সদস্যরা। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিপ্লবী গার্ডের অনেক লুকানো এজেন্ট। তাঁদের সক্রিয় করে এসব দেশে অবস্থানরত মার্কিন সেনা, কূটনীতিক ও নাগরিকদের হত্যা করতে পারে তেহরান।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকাতেও স্লিপার সেল রয়েছে ইরানের। তেহরান থেকে সবুজ সংকেত পেলেই যারা সক্রিয় হয়ে নাটকীয়ভাবে সহিংস হামলা চালাবে।
ডিজিটাল মাধ্যমেও আক্রমণ করতে পারে ইরান। ইসলামী প্রজাতন্ত্রটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার স্পেসের জন্য অন্যতম হুমকি হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ম্যালওয়্যার হামলার সাথেও ইরানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে পশ্চিমাদের।
মার্কিন সেনারা যদি ইরানে প্রবেশ করে, তাহলে তাদের গেরিলা যুদ্ধ কৌশলের সম্মুখীন হতে হবে।
ইরানের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, মার্কিন সেনাদের মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাড়ানো। এই লক্ষ্য অর্জনে, ২০২৪ সালকে সুবর্ণ সময় হিসেবে বিবেচনা করতে পারে তেহরান। কারণ, গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন-বিরোধী জনমত যেমন তীব্র হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে ইরানের প্রতি জন-সমর্থন।
ইরানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে ইরাকের জোট সরকারে। যারা ইতোমধ্যেই দেশটি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রী শিয়া আল-সুদানির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বাইডেন প্রশাসন ইরাক থেকে সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে বলেও এর আগে জানা গিয়েছিল। যদিও পরে তা অস্বীকার করা হয়।
মধ্যপ্রাচ্য হয়ে জ্বালানি ও পণ্য পরিবহনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ জলপথ লোহিত সাগরের বাব এল মান্দেব প্রণালী। ইয়েমেনের হুথিরা সেখানে ইসরায়েল ও পশ্চিমা মালিকানাধীন বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়ে মুসলিম বিশ্বের জনতার কাছে তুমুল সমর্থন ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইরান সমর্থিত হুথিদের বিরুদ্ধে এখন বিমান হামলা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
হুথিরাও দমবার পাত্র নয়। রাজধানী সানাসহ বিভিন্ন স্থানে লাখ লাখ ইয়েমেনি জড়ো হয়ে এই হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। সমবেত জনতা ফিলিস্তিনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। হুথি নেতারা জানিয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধ নাহলে– লোহিত সাগরে তারা হামলা অব্যাহত রাখবেন। কোনো ধরনের শক্তিপ্রয়োগই তাঁদের দমাতে পারবে না।
এই পরিস্থিতিতে, ইরান হয়তো আশা করছে সহিংসতা বাড়তে থাকলে, যুক্তরাষ্ট্র হয় এই অঞ্চল থেকে পিছু হঠবে, নয়তো তার মিত্ররাই তাকে বাধ্য করবে।
আরব দেশগুলোর নেতারা হয়তো এই অনুমান করছেন যে, নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে দিয়েই শেষ হতে পারে এই বছর। এবং ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পক্ষেই ছিলেন।
অবশ্য ইসরায়েল যখন যুদ্ধের মধ্যে, তখন ট্রাম্প আগের অবস্থানে অটল থাকবেন কিনা– তা নিয়েও সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া রাজনীতির সমীকরণ সেনা প্রত্যাহারে কতোটা প্রভাব ফেলবে– তা এখনই বলার সময় আসেনি। বিশেষত, যখন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট উভয় দলই ইসরায়েলকে রক্ষা করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। বরং, ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাতেই রাজনীতিবিদরা একাট্টা হবেন– এমন সম্ভাবনাই তীব্র।
ইরানে আগ্রাসন চালানোর সিদ্ধান্ত নিলে, প্রথমেই বিমান ও নৌবাহিনীর মাধ্যমে তীব্র আঘাত হানবে যুক্তরাষ্ট্র। চাইবে শুরুতেই ইরানের প্রতিরোধ সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিতে।
এই লক্ষ্য অর্জনে ইরানের জাহাজ, ঘাঁটিতে থাকা যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ স্থল, পারমাণবিক স্থাপনা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হাজার হাজার বোমা ফেলবে। সামরিক নেটওয়ার্ক অকার্যকর করতে চালাবে মারাত্মক সাইবার হামলা।
এই ধরনের আগ্রাসনের মুখে হাজার হাজার বেসামরিক ইরানি নাগরিকও নিহত হবেন। আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানে স্থল সেনা পাঠাতে চায়, তখন ভৌগলিক বাধা পেরোতে হবে তাদের।
আফগানিস্তান দিয়ে আগ্রাসন চালানো সহজ হবে না। কারণ, সেখানে ক্ষমতায় এখন তালেবান সরকার। তবে যদি কোনোভাবে সেটা করা সম্ভবও হয়, তবু মার্কিন বাহিনীকে পেরোতে হবে দুই দুটি মরুভূমি এবং বিপজ্জনক পর্বতমালা।
পশ্চিম দিক থেকে স্থল আগ্রাসন চালাতে তুরস্ক নিজ ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না বলেই মনে হয়।
আবার দক্ষিণপশ্চিম দিক দিয়ে ইরানে প্রবেশ করতে চাইলে, বাধা হয়ে দাঁড়াবে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস (দজলাও ফোরাত) নদীর জলাভূমি। তারপর আরো সামনে থাকবে জাগ্রোস পর্বতমালার সুউচ্চ প্রাচীর।
সর্বাত্মক যুদ্ধ নাকি সীমিত পাল্টা-হামলা, যুক্তরাষ্ট্র কোন পথে হাঁটবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে যেকোনো ধরনের সংঘাতই হোক না কেন– তারপরে পরিণতি কী হবে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
নিঃসন্দেহে এতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। রাষ্ট্র হিসেবে ইরানকে ধবংস করার ভয়াল পরিণাম বহু যুগ ধরে মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বকে বয়ে বেড়াতে হবে। দেখা দিতে পারে, চরম মানবিক বিপর্যয় ও শরণার্থীর ঢল।
সর্বোপরি, আমেরিকার ঢালাও আগ্রাসন ইরানকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে, যে পরিণতি ওয়াশিংটন আরও অনেক দেশে তৈরি করেছে।