USA

ইলেক্টোরাল কলেজই ভরসা ট্রাম্পের, ইতিহাস গড়ার হাতছানি কমলার সামনে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সামনে অপেক্ষা করছে ইতিহাস গড়ার হাতছানি। অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতীয় জরিপে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটই তার ভরসা বলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
রবিবার পর্যন্ত সর্বশেষ জাতীয় জনমত জরিপের ভোটে কমলা হ্যারিস ট্রাম্পেটর চেয়ে এক শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন। জরিপে কমলা ৪৮ শতাংশ এবং ট্রাম্প ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। 
এদিকে দেশব্যাপী প্রচারের পর ব্যাটেল গ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যগুলোতে শেষবারের মতো সমর্থন আদায়ে ব্যস্ত উভয় প্রার্থী। কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫ নভেম্বর মঙ্গলবারের নির্বাচনের ঠিক দুই দিন আগে শনিবার নর্থ ক্যারোলাইনার সফরে যান।
ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার নির্বাচনী ল্যাব অনুসারে, শনিবার পর্যন্ত ৭ কোটির বেশি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছে। এর মধ্যে নর্থ ক্যারোলাইনায় ৩৮ লাখের বেশি মানুষ ভোট দেয়। 
হ্যারিস নর্থ ক্যারোলাইনার সবচেয়ে বড় শহর শার্লটে রক স্টার জন বন জোভিকে সঙ্গে নিয়ে সমাবেশ করেন। এখানে জর্জিয়ার মতো ১৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। নর্থ ক্যারোলাইনা ২০২০ সালে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিল। ট্রাম্প শার্লটের পশ্চিমে গ্যাস্টোনিয়ায় সমাবেশ করেন। সেখানে তিনি গ্রিনসবোরোতে ফার্স্ট হরাইজন কলিজিয়াম এরেনায় বক্তৃতা করেন।
হ্যারিসের শনিবারই সুইং স্টেট জর্জিয়াও যাওয়ার কথা। সেখানে তার ফিল্ম ডিরেক্টর স্পাইক লি এবং গায়ক ভিক্টোরিয়া মোনেট ২ চেইঞ্জ, বিগ টাইগার, মনিকা এবং যাজক ট্রয়ের উপস্থিতিতে সমাবেশে বক্তৃতা করার কথা। 
ইলেক্টোরাল কলেজই ভরসা ট্রাম্পের ॥ যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি প্রদেশ মিলিয়ে মোট ৫৩৮ জন ইলেক্টর রয়েছেন। ক্ষমতা দখল করতে প্রয়োজন হয় ২৭০টি ভোট। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, জনগণের ভোট বেশি পেয়েও শেষ পর্যন্ত হারতে হয়েছে কোনো প্রার্থীকে। ২০০০ ও ২০১৬-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এভাবেই হেরে যান দুই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অ্যাল গোর এবং হিলারি ক্লিনটন।
একজন প্রার্থী যে প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নিজের দিকে টানতে পারবেন, সেই প্রদেশের সব ক’টি ভোট তার হয়ে যাবে। যেমনÑ ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫৫ জন ইলেক্টর রয়েছেন। কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি এই প্রদেশে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই প্রদেশের ৫৫ জন ইলেক্টরকে জিতে নেবেন। ১৩ ডিসেম্বর ইলেক্টররা প্রাদেশিক রাজধানীতে জড়ো হয়ে তাদের দলের প্রার্থীকে ভোট দেবেন। তবে নির্বাচনের এই পর্যায়টি নেহাতই আনুষ্ঠানিক। কারণ ৫ নভেম্বরের জনসাধারণের ভোট থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাবে, রিপাবলিকান না ডেমোক্র্যাট, কোন প্রার্থী জিতছেন।
ইলেক্টোরাল পদ্ধতিতে ভোট হওয়ার প্রধান অসুবিধা, অনেক সময় গোটা দেশের জনমত আর ইলেক্টর সংখ্যায় ফারাক থেকে যায়। যেমন হয়েছিল ২০১৬ সালে। সেবার জনগণের ভোটের নিরিখে ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন পেয়েছিলেন ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট, আর রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৪৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ ট্রাম্পের থেকে ২ দশমিক ১ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েও ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটাভুটিতে হেরে যান হিলারি।

তিনি পেয়েছিলেন ২২৭টি ইলেক্টোরাল ভোট, কিন্তু ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৩০৪টি। টেক্সাসের মতো রিপাবলিকানদের শক্ত ঘাঁটি তো বটেই, পেনসিলভানিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনার মতো ‘সুইং স্টেট’ তাদের বড় অঙ্কের ইলেক্টোরাল ভোট নিয়ে ট্রাম্পের ঝুলিতে চলে যাওয়ার ফলেই হোয়াইট হাউস দখল করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।
জনমত সমীক্ষা বলছেÑ ট্রাম্পের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে কমলা হ্যারিসের। কিন্তু নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে এগিয়ে ট্রাম্পই। নেভাডা, অ্যারিজোনা, মিনেসোটা, পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা, উইসকনসিনÑ এই ‘অনিশ্চিত’ প্রদেশগুলোই ঠিক করবে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ফিরছেন কি না।
বিশ্বনেতাদের ভাবনায় ‘কমলা-ট্রাম্প’ ॥ ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে বিশ্বের বিভিন্ন নেতারা নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনা করছেন। নির্বাচনে কমলা হ্যারিস বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় তাদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়েও ভাবছেন। বেশিরভাগ নেতা সরাসরি সমর্থন জানান দিচ্ছেন না। তবুও তাদের বিভিন্ন মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, তারা কার প্রতি ঝুঁকছেন- 
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন সম্ভবত ট্রাম্পের জয়কে সমর্থন করবেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প রাশিয়ার জন্য তুলনামূলকভাবে নরম মনোভাবাপন্ন। যার ফলে ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তা এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা- দুটোই কমতে পারে। 
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও প্রকাশ্যে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করেননি। তবে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, হ্যারিসের বিজয় তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং আমেরিকা চীনের ওপর বিভিন্ন শুল্ক আরোপ করেছিল। কমলা হ্যারিস প্রশাসন সম্ভবত এই শুল্ক নীতিকে আরও কঠোরভাবে অনুসরণ করবে না। 
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্ভবত ট্রাম্পের প্রতি ঝুঁকে আছেন। কারণ ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ইসরাইলের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। এমনকি ইসরাইলের প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন নিয়ে নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেছেন। 
ইউরোপের বেশিরভাগ নেতা বিশেষ করে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ হ্যারিসের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে ন্যাটো নিয়ে তার সন্দেহজনক মনোভাব এবং পলিসির অস্থিরতা ইউরোপীয় নেতাদের উদ্বিগ্ন করেছিল। এক্ষেত্রে হ্যারিস বাইডেনের মতোই স্থায়ী সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে। পরিবেশ এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ইস্যুতেও হ্যারিস প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপীয় নেতাদের আরও ভালোভাবে কাজ করা সম্ভব হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে চলছেন। কারণ ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উভয় দলেরই সম্পর্ক বেশ শক্তিশালী। তবে ট্রাম্পের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার মনোভাব ভারতের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। যদিও কমলা হ্যারিসের প্রশাসন ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। 
দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়া ও চীনের মতো হুমকির বিরুদ্ধে। সেক্ষেত্রে হ্যারিসের বিজয় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন নীতি অব্যাহত রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। 
অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসের প্রেসিডেন্সিই সম্ভবত যুক্তিযুক্ত। কারণ ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হলে তিনি প্যারিস চুক্তি থেকে পুনরায় সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। যা জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় অস্ট্রেলিয়ার চেষ্টাকে দুর্বল করতে পারে। 
সর্বশেষ জনমত জরিপ ॥ আগামীকাল মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবেন ভোটাররা। শেষ মুহূতেই সবার মনে প্রশ্নÑ কমলা হ্যারিস কি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, নাকি দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যকার জয়ের সম্ভাবনা বেশি, তা যাচাইয়ে নিয়মিত জনমত জরিপ হয়। সে হিসেবে সর্বশেষ জনমত জরিপে কে এগিয়ে কমলা নাকি ট্রাম্প? 
জাতীয়ভাবে ভোটারদের নিয়ে যে জরিপ হয়েছে, তাতে ট্রাম্পের চেয়ে অল্প ব্যবধানে এগিয়ে আছেন কমলা। জুলাইয়ে কমলা হ্যারিস ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী হওয়ার পর থেকে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। জাতীয়ভাবে যেসব জনমত জরিপ হয়েছে, রবিবার পর্যন্ত তার গড়ে দেখা যাচ্ছে কমলা হ্যারিসের পক্ষে সমর্থন ৪৮ আর ট্রাম্পের ৪৭ শতাংশ।
আগস্টের শেষ দিকে ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় চার পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন কমলা। পরের দুই মাসও অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের শুরুর দিকে আগের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন কমলা হ্যারিস। তবে, শেষ কয়েক সপ্তাহের জরিপে কমলার সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবধান কমে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অঙ্গরাজ্য আছে ৫০টি। অতীতের নির্বাচনগুলোয় দেখা গেছে, বেশিরভাগ রাজ্য নির্দিষ্ট কোনো একটি দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকেন। এসব রাজ্যে নির্দিষ্ট দলের প্রার্থীই জয়ী হয়ে থাকেন। এ কারণে যেসব রাজ্যের নির্দিষ্ট দলকে ভোট দেওয়ার ইতিহাস নেই, সেসব রাজ্য ভোটের ফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমন সাতটি রাজ্যকে ‘দোদুল্যমান রাজ্য’ বলা হয়ে থাকে।

অঙ্গরাজ্যগুলো হলো- অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন। দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর ভোটারদের নিয়ে করা সর্বশেষ জনমত জরিপগুলোয় দেখা গেছে, এসব অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্প ও কমলার মধ্যে ব্যবধান এতই কম যে কোনো প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন, তা বলা মুশকিল। ফলে আন্দাজও করা যাচ্ছে না যে কোন প্রার্থীর পাল্লা ভারি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button