International

ইসরাইলের দুই শহরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

বর্ষপূর্তিতে হিজবুল্লাহর রকেট হামলা গাজায় আরো অর্ধশত ফিলিস্তিনি নিহত ষ আক্রমণের ঝাঁজ আরো বাড়ানোর হুঁশিয়ারি নেতানিয়াহুর ষ ইসরাইলকে আর অস্ত্র দেবে না ফ্রান্স

গতবছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল হামাস। পাল্টা জবাবে টানা এক বছর ধরে গাজায় নৃশংস হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। এই যুদ্ধ এখন বিস্তৃত লাভ করেছে লেবানন-সিরিয়াতেও। পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি হামলার জেরে অশান্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। এবার গাজা যুদ্ধ শুরুর প্রথম বার্ষিকীর প্রাক্কালে সোমবার ভোরে ইসরাইলের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হাইফায় হামলা চালিয়েছে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উপেক্ষা করে হাইফা ও তিবেরিয়াস শহরে আঘাত হেনেছে হিজবুল্লাহর রকেট। আহত হয়েছে ১০ জন। হিজবুল্লাহর দাবি, তারা ‘ফাদি ১’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হাইফার দক্ষিণে একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেছে। যার মধ্যে দুটি রকেট ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে হাইফাতে, অন্য পাঁচটি ইসরাইলের তিবেরিয়াস শহরে আঘাত হানে। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, রোববার হিজবুল্লাহর রকেটের আঘাতে হাইফায় বেশ কয়েকটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামান্য আহত হওয়ার কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্য নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আল জাজিরার সাংবাদিক নুর ওদেহ জানিয়েছেন, এই প্রথম হাইফার বাসিন্দারা শহরের ভিতরে হিজবুল্লাহর রকেট হামলা দেখেছেন। তিনি আরো বলেন, প্রায় ৩ লাখ বাসিন্দাসহ উত্তর ইসরাইলের বৃহত্তম শহর হাইফা। কৌশলগত-ভাবে এই শহর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটি বন্দর, তেল শোধনাগার এবং শিল্প কমপ্লেক্স রয়েছে। এটি হিজবুল্লাহর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে যা ইসরাইলিরা ভাবতে পারেনি। এই আক্রমণ ইসরাইলকে প্রভাবিত করতে পারে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে ইসরাইলের পুলিশের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, রকেটের আঘাতে কিছু ভবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। টাইমস অব ইসরাইল স্থানীয় রামবাম হাসপাতালের বরাত দিয়ে জানায়, হাইফায় রকেট হামলায় পাঁচজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে একজনের আঘাত গুরুতর হলেও অপর চারজন সামান্য আঘাত পেয়েছেন। তাদের সবার শরীরেই ক্ষেপণাস্ত্রের শার্পনেলের আঘাত লেগেছে। প্রবল আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়া আরেক ব্যক্তিকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

নজরদারি ক্যামেরা থেকে পাওয়া ভিডিওতে হাইফায় হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার মুহূর্তটি ধরা পড়েছে। টাইবেরিয়াসে রকেট হামলায় অন্তত একজন আহত হয়েছেন বলে মেগান ডেভিড অ্যাডম অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা জানিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, রকেটের আঘাতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, হাইফায় আঘাত হানা পাঁচটি রকেট প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা, এই নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। আইডিএফ বলেছে, ‘প্রতিরোধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কী ঘটেছিল তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’ ইসরাইলের লেবানন সীমান্তবর্তী কিরিয়াত শমোনা এলাকা লক্ষ্য করে আরও ১৫টি রকেট ছোড়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে টাইমস অব ইসরাইল। দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অধিকাংশ রকেট প্রতিরোধ করতে পারলেও কয়েকটি ওই এলাকায় আঘাত হেনেছে বলে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে। এ হামলায় হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কি না, তাৎক্ষণিকভাবে কোনো খবর হয়নি।

গাজায় আরও অর্ধশত ফিলিস্তিনি নিহত : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বর্বর হামলায় আরও প্রায় অর্ধশত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা প্রায় ৪১ হাজার ৯০০ জনে পৌঁছেছে। এছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরও ৯৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান হামলায় কমপক্ষে আরও ৪৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪১ হাজার ৮৭০ জনে পৌঁছেছে বলে রোববার অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিরলস এই হামলায় আরও অন্তত ৯৭ হাজার ১৬৬ জন ব্যক্তিও আহত হয়েছেন। মন্ত্রণালয় বলেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত আগ্রাসনে ৪৫ জন নিহত এবং আরও ২৫৬ জন আহত হয়েছেন। অনেক মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন কারণ উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মনে করছে, গাজা উপত্যকা জুড়ে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন। মূলত গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।

৭ অক্টোবর স্মরণে আক্রমণের ঝাঁজ আরও বাড়ানোর হুঁশিয়ারি নেতানিয়াহুর : গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরাইলের মাটিতে হামলা চালিয়েছিল হামাস। এর পর থেকেই উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য। গাজাকে কার্যত ধ্বংস করার পর এখন লেবাননে হিজবুল্লা ও ইরান দুই ‘শত্রু’র সঙ্গে লড়তে হচ্ছে তেল আভিভকে। তবে যুদ্ধের এক বছর পেরিয়ে গেলেও দমে যাওয়ার পাত্র নন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। বরং দেশের সেনাবাহিনীকে উজ্জীবিত করে তিনি বার্তা দিলেন, ‘আমরাই জিতব।’

ইসরাইলের মাটিতে হামাসের হামলার বর্ষপূর্তির দিনে অতীত স্মরণ করিয়ে দেশের সেনাকে উজ্জীবিত করেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরাই জিতব। গাজাতে জিতব, লেবাননে জিতব। ইরানেও হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ একইসঙ্গে দেশের সেনাবাহিনীকে তিনি নির্দেশ দেন, ‘শত্রুদের গুঁড়িয়ে দাও, একেবারে ধ্বংস করে দাও। আজ থেকে এক বছর আগে আমরা ভয়ানক ধাক্কা খেয়েছিলাম। কিন্তু গত ১২ মাসে সেই ছবিটাকে আমরা সম্পূর্ণরূপে পালটে দিয়েছি।’ অন্যদিকে, এই দিনকে আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করতে দেখা গিয়েছে হামাসকে। ৭ অক্টোবরের হামলাকে গর্বের দিন বলে উল্লেখ করে হামাস জানিয়েছে, এই দিনটি ফিলিস্তিনের নিরাপত্তায় এক ঐতিহাসিক দিন।

ইসরাইলকে আর অস্ত্র দিবে না ফ্রান্স : ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ যুদ্ধবাজ ইসরাইলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি গাজায় এক বছর ধরে চলমান ইসরাইলি আগ্রাসনের ‘রাজনৈতিক সমাধান’ খুঁজে বের করার ওপর জোর দিয়েছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট শনিবার ফ্রান্স ইন্টার রেডিওতে এক বক্তৃতায় বলেছেন, আমার বিশ্বাস, আজকের অগ্রধিকার হলো একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং গাজায় যুদ্ধ ও হত্যা বন্ধে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ না করা। একইসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন, ইসরাইলকে আর কোন অস্ত্র দিবে না ফ্রান্স।

প্যারিস থেকে এএফপি এই খবর জানায়। এরআগে গতমাসে যুক্তরাজ্যে ও ইসরাইলে কিছু অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করেছে। কারণ, এসব অস্ত্র অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘনে ব্যবহার করা হতে পারে। এদিকে ইসরাইলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানানোতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যখোঁসহ অপর দেশগুলোর কঠোর সমালোচনা করে নেতানিয়াহু বলেছেন, এই আহ্বান আমাদের জন্য অপমানজনক। তবে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাবো। ম্যাখোঁ লেবাননে স্থল অভিযানের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, যুদ্ধের বিস্তৃতি কমিয়ে আনা উচিত। লেবাননের জনগণকে এভাবে ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। লেবানন আরেকটি গাজা হতে পারে না।

এদিকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান শনিবার ইস্তাম্বুলে এক সভায় বলেছেন, গাজায় দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের নীতিকে বৈধতা দেয়ার জন্য ইসরাইল নতুন করে অজুহাত খুঁজছে। তিনি বলেন, হামাস ও হিজবুল্লাহ আগ্রাসনের যে কথা ইসরাইল প্রচার করছে তা কেবলমাত্রই অজুহাত। ইসরাইল প্রতিদিনই তার দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের নীতিতে সমর্থন পাওয়ার জন্য একের পর এক অজুহাত তৈরি করছে। তুরস্ক সব সময় নিপীডকের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button