USA

ইসরাইল কি যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব-নিকাশ জটিল করে তুলেছে

বর্তমান সঙ্ঘাত তিনটি সম্ভাব্য গতিপথে মোড় নিতে পারে, যার প্রতিটি ওয়াশিংটনের জন্য আলাদা কৌশলগত বাস্তবতা তৈরি করবে

ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে চলমান সঙ্ঘাত মোকাবেলায় আমেরিকার কৌশল জড়িয়ে আছে নানা প্রতিশ্রুতি, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও দেশী-বিদেশী রাজনৈতিক চাপে।

ওয়াশিংটনের কৌশল নির্ভর করে ‘সমর্থন ও সংযমের ভারসাম্য’ নীতির উপর। এই নীতির লক্ষ্য ঝুঁকি বেড়ে গেলেও যুদ্ধ না বাড়িয়ে স্থলভাগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।

এই ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা দাঁড়িয়ে আছে এক কঠিন দ্বৈত অবস্থানে। একদিকে ইসরাইলের নিরাপত্তায় আমেরিকার ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করতে যুদ্ধ এড়ানো জরুরি।

ইসরাইলের প্রতি ‘শর্তসাপেক্ষ সমর্থন’-এর এই কৌশল আমেরিকার সেই উপলব্ধি থেকে এসেছে যে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে তিনটি বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। তা হলো, বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হবে, উপসাগরীয় মিত্রদের দুর্বল করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে অনিচ্ছাকৃত সামরিক পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করবে।

এই কৌশল থেকে বোঝা যায়, যেকোনো প্রকাশ্য সংঘর্ষ শুধু আমেরিকার স্বার্থে নয়, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি।

ইসরাইলের হামলা ওয়াশিংটনের বোধগম্য হলেও এই সমর্থন নির্ভর করে ইসরাইলের নিজস্ব উত্তেজনা-ব্যবস্থাপনার উপর। হোয়াইট হাউস জানে, সীমা অতিক্রম করলে উপসাগরীয় মিত্রদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে এবং আমেরিকা এমন এক সামরিক সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা সে এড়াতে চায়।

কঠিন সিদ্ধান্তের মুখে যুক্তরাষ্ট্র

আজ যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বড় প্রশ্ন, ইসরাইলকে কতটা সমর্থন দেয়া যাবে, যাতে সরাসরি ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু না হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দু’টি পথ আছে। একটি হলো, ইসরাইলকে গোপনে গোয়েন্দা তথ্য ও সীমিত সামরিক সহায়তা দেয়া। অন্যটি হলো, কেবল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনে সীমাবদ্ধ থাকা।’ কিন্তু সময় এখানে আমেরিকার বিপক্ষে। দিন যত গড়াচ্ছে, পুরো অঞ্চল বড় ধরনের সঙ্ঘাতের দিকে এগোচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ছে।

ওয়াশিংটন-তেল আবিবের স্বার্থের ফারাক

কৌশলগত অংশীদারিত্ব সত্ত্বেও এই সঙ্ঘাতে আমেরিকা ও ইসরাইলের অগ্রাধিকার ভিন্ন। ইসরাইল মনে করে, এটি ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংস করার এবং অঞ্চলজুড়ে প্রতিরোধ গঠনকে দুর্বল করার সুযোগ। আর ট্রাম্প প্রশাসন আশঙ্কা করছে, এই উত্তেজনা বিস্তার পেলে এক বিস্তৃত যুদ্ধ শুরু হবে, যা আমেরিকার স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলবে।

সিএনএন-এ হোয়াইট হাউসের একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা ‘সম্পূর্ণ অনুমোদন’ না দিলেও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে। এই অবস্থান পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যকেই তুলে ধরে। এই বৈষম্য আবারো দেখায়, ইসরাইলের আচরণে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ সীমিত, বিশেষ করে যখন তেল আবিবে একটি ডানপন্থী সরকার সামরিক পথকে রাজনৈতিক আলোচনার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।

ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ মতবিভেদ

ইসরাইলকে কতটা সমর্থন দেয়া উচিত, তা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরেই মতভেদ রয়েছে। পেন্টাগন চায় সীমিত সম্পৃক্ততা, যা গোয়েন্দা ও লজিস্টিক সহায়তায় সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও কিছু রিপাবলিকান নেতা আরো সরাসরি সমর্থনের পক্ষে। ১৩ ও ১৪ জুনের বিবৃতিগুলোতে এসব মতপার্থক্য স্পষ্ট। কেউ যুদ্ধ দীর্ঘায়নের বিরুদ্ধে, কেউ বলছেন ইরানকে শক্তভাবে প্রতিহত করা উচিত। এই মতভেদ একটি সুসংহত কৌশল গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, বিশেষ করে যখন কংগ্রেস ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান চাইছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বৈত চাপে ভারসাম্য রক্ষা

ট্রাম্প প্রশাসন এখন দু’টি বিপরীতমুখী চাপে ভারসাম্য রাখতে চাইছে। একদিকে ইসরাইলপন্থী লবি ও কট্টরপন্থী রিপাবলিকানরা কড়া অবস্থান দাবি করছে। অন্যদিকে দলীয়ভাবে অনেক রিপাবলিকান নতুন যুদ্ধ চায় না। আর প্রগতিশীল মহল যুদ্ধবিরোধী।

এই চাপ প্রশাসনকে এমন এক ‘ভঙ্গুর ভারসাম্যে’ ঠেলে দিয়েছে, যেখানে তারা একদিকে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন জানায়। আবার অন্যদিকে যুদ্ধ এড়াতে কূটনৈতিক চেষ্টা চালায়। এই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা ট্রাম্প প্রশাসনের উত্তেজনা বৃদ্ধির নীতিকে সীমিত করে রেখেছে।

ইসরাইল : শুধু মিত্র নয়, প্রভাবশালী খেলোয়াড়

এই সংকটে ইসরাইল কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রই নয়। তারা তিনটি দিকে ভূমিকা পালন করছে। তা হলো, কৌশলগত অংশীদার, ওয়াশিংটনের নীতির ওপর চাপের উৎস এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর সক্রিয় নির্মাতা।

এইভাবে, ইসরাইলের পদক্ষেপ শুধু ওয়াশিংটনের কৌশলকেই চাপে ফেলছে না। বরং গোটা অঞ্চলের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। যার বোঝা বহন করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকেও।

তেল আবিবের কৌশল এবং মার্কিন সীমার পরীক্ষা

ইসরাইল এমন এক জায়গায় কাজ করছে যেখানে সে আমেরিকার ‘পূর্ণ সমর্থন’ কাজে লাগাচ্ছে, আবার সেই সমর্থনের সীমাও পরীক্ষা করছে। বিশেষ করে কংগ্রেসের সমর্থন এবং ওয়াশিংটনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে।

এই উত্তেজনা বৃদ্ধির মাধ্যমে, ইসরাইল কয়েকটি লক্ষ্য পূরণ করতে চায়। তা হলো, ইরানের সাথে সংঘর্ষের নিয়ম এবং প্রতিরোধ জোটের গতিপথ নতুন করে নির্ধারণ করা, নিজেকে উপসাগরীয় অঞ্চলে অপরিহার্য নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং অভ্যন্তরীণ সঙ্কটকে জাতীয় সংহতির সুযোগে পরিণত করা।

তবে এই কৌশলে এমন ঝুঁকি আছে যা একাধিক অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে পারে এবং আমেরিকাকে এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে যার জন্য সে প্রস্তুত নয়।

ইসরাইল : মিত্র, কিন্তু চাপের উৎসও

ইসরাইল মার্কিন মিত্র হলেও সে একইসাথে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ওপর চাপও সৃষ্টি করে; বিশেষ করে ইরান ইস্যুতে। নেতানিয়াহুর সরকার জানে, যত আপত্তিই করুক না কেন, ওয়াশিংটন তার সাথে কৌশলগত সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। সে কারণেই তেল আবিব ইচ্ছাকৃতভাবে চাপ বাড়াচ্ছে, যেন বাস্তবতার দোহাই দিয়ে আমেরিকাকে নিজেদের অবস্থানে টেনে আনা যায়।

বর্তমান সঙ্ঘাত দেখায় যে ইসরাইল কিভাবে লাল রেখা না মাড়িয়ে মার্কিন সহায়তার সীমা যাচাই করছে। তাদের ধারণা, কংগ্রেস—বিশেষত রিপাবলিকানরা—যেকোনো নতুন অভিযানে তাদের রাজনৈতিক সুরক্ষা দেবে। এখানেই ট্রাম্প প্রশাসনের আসল চ্যালেঞ্জ- সম্পূর্ণ যুদ্ধে না জড়িয়ে কৌশলগত অংশীদারিত্ব বজায় রাখা।

নিরাপত্তা পরিবেশ পুনর্গঠন

ইসরাইল এই সঙ্ঘাতকে ব্যবহার করছে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা সমীকরণে নতুন নিয়ম তৈরি করতে। তারা বলছে, ইরান ও তার মিত্রদের উপর নতুন বাস্তবতা চাপিয়ে দেবে। ওয়াশিংটন এটিকে বুঝতে পারছে। কিন্তু তার আশঙ্কা, এই উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের রূপ নেবে, যা শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকেও টেনে আনবে।

ইসরাইল একইসাথে এই সুযোগে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্কও জোরদার করতে চাইছে, যেন ইরানি হুমকি মোকাবেলায় তাদের পাশে দাঁড় করানো যায়। এতে নতুন আঞ্চলিক জোট গড়ে উঠলেও উত্তেজনা আরো বাড়বে।

প্রতিরোধ নীতিতে দ্বিধা

ইসরাইলের দীর্ঘদিনের কৌশল ছিল ‘যুদ্ধের মধ্যে অভিযান’। অর্থাৎ সরাসরি যুদ্ধ না করে শত্রুর শক্তি ধ্বংস করা। তবে ইরানের উপর সর্বশেষ হামলার মাধ্যমে এই কৌশল এখন খোলামেলা যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে।

এর ফলে ইরানের মিত্র হিজবুল্লাহ, ইরাকি পিএমএফ, হাউছি মিলিশিয়া তাদের অংশগ্রহণের নিয়ম নতুন করে ভাবছে। এখনো হাউছিদের প্রতিক্রিয়া সীমিত হলেও পশ্চিমা গোয়েন্দারা সতর্ক করছে, এভাবে চললে হিজবুল্লাহ সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে।

ওয়াশিংটনের কাছে হিজবুল্লাহর অংশগ্রহণ মানে যুদ্ধ বহুমাত্রিক আকার নেবে এবং আমেরিকার ঘাঁটিগুলোও এতে টার্গেট হতে পারে।

এই ঝুঁকি এড়াতে আমেরিকা এখন আরব ও পশ্চিমা রাজধানীগুলোর সাথে গোপন যোগাযোগে ভরসা রাখছে। কারণ তার প্রতিরোধ নীতির কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে।

ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ হিসাব-নিকাশ

গাজা যুদ্ধের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়া নেতানিয়াহু সরকার ইরানের সাথে উত্তেজনাকে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে দৃষ্টি সরাতে এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। ইরানকে অস্তিত্বের হুমকি বলে তুলে ধরা হচ্ছে।

মার্কিন প্রশাসন জানে, এই উত্তেজনার একটা বড় কারণ ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। আর এটিই ইসরাইলকে নিয়ন্ত্রণ করাকে আরো কঠিন করে তোলে, বিশেষত যখন রিপাবলিকানরা এই সরকারের পাশে থাকে।

ইরানের কৌশল : সংযমের ভেতর প্রতিরোধ

ইরান সরাসরি মার্কিন সঙ্ঘর্ষ এড়িয়ে তার অংশীদারদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে পরিস্থিতি পরিচালনা করছে। তারা একদিকে ‘সম্পূর্ণ প্রস্তুতির’ বার্তা দিচ্ছে। অন্যদিকে ভুল পদক্ষেপ না নিয়ে সংঘর্ষ ঠেকানোর চেষ্টা করছে। এই কৌশল তিনটি বিষয়ে নির্ভর করে। তা হলো, অংশীদারদের মাধ্যমে পরোক্ষ চাপ তৈরি, পারমাণবিক ইস্যুকে দর-কষাকষির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার এবং পশ্চিমা বিভাজন কাজে লাগানো।

এই দ্বৈত কৌশলে আমেরিকা কিছুটা সুযোগ পায় ইরানের উপর চাপ বাড়াতে। আবার ইসরাইলের সাথে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতেও সুবিধা পায়। তবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, ভুল কোনো পদক্ষেপ যেটা ওয়াশিংটনকে সরাসরি যুদ্ধে নিয়ে যেতে পারে।

যদিও হিজবুল্লাহ বা ইরাকি দল এখনো সরাসরি জড়ায়নি। তবে মার্কিন গোয়েন্দারা সতর্কতা দেখাচ্ছে যে হিজবুল্লাহ সীমিত আকারে সক্রিয় হতে পারে।

ওয়াশিংটন বুঝছে, যদি লেবানন বা ইরাকও সঙ্ঘাতে যুক্ত হয়, তাহলে তারা হয় ইসরাইলকে আরো বড় সামরিক সহায়তা দেবে, না হয় বহু ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়াবে, যা তাদের জন্য চরম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এখন মার্কিন প্রশাসন কূটনৈতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাচ্ছে। তবে তারা জানে যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত কঠিন, বিশেষত যদি ইরান তার মিত্রদের আরো সক্রিয় করে তোলে।

কূটনৈতিক সমাধান ব্যাহত : সঙ্ঘাতের কূটনৈতিক পথকে বাধাগ্রস্ত করা

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে একতরফাভাবে সরে যাওয়ার পর থেকে ইরানের সাথে কূটনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে। সাম্প্রতিক ইসরাইলি হামলাগুলো এই সঙ্কটকে আরো জটিল করে তুলেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাথে পারমাণবিক নিরাপত্তা বিষয়ে চলমান সকল প্রযুক্তিগত আলোচনা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে এখন কূটনৈতিক পথ নয়, প্রতিরোধ ও প্রত্যুত্তরের সময়।

ওয়াশিংটনের কৌশলবিদেরা উপলব্ধি করছেন যে যদি এই উত্তেজনার ধারা বজায় থাকে, তাহলে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের ঝুঁকি পুনরায় সামনে চলে আসবে এবং তা একটি নিয়ন্ত্রিত কূটনৈতিক পথে ফেরার সম্ভাবনাকে কার্যত বিনষ্ট করবে। এই পরিস্থিতি বাইডেন প্রশাসনকে একটি কৌশলগত দোটানার মধ্যে ফেলেছে- ইসরাইলের সামরিক পদক্ষেপকে অন্ধভাবে সমর্থন করবে, নাকি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আলোচনার ভিত্তি রক্ষায় সংযম প্রদর্শন করবে।

জ্বালানি ও অর্থনীতি : মার্কিন উদ্বেগের বাস্তব চিত্র

ইসরাইল-ইরান উত্তেজনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশ্বিক প্রভাবগুলোর একটি জ্বালানি বাজারে অনুভূত হচ্ছে। হরমুজ প্রণালী ও বাব আল-মানদাবে যেকোনো রকম সামরিক উত্তেজনা বৈশ্বিক তেল সরবরাহ চেইনে বড় ধরনের বিঘ্নতা ঘটাতে পারে। তেলের দাম হঠাৎ বৃদ্ধির ফলে শুধুমাত্র মার্কিন অর্থনীতি নয়, ইউরোপীয় ও পূর্ব এশীয় অর্থনীতিও চাপের মুখে পড়বে।

এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন জ্বালানি বিভাগ কৌশলগত পেট্রোলিয়াম রিজার্ভ ব্যবহারের প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়ে মূলত সঙ্কটের গাম্ভীর্যকে স্বীকার করেছে। তেল ট্যাঙ্কার বা সমুদ্রপথে জ্বালানিবাহী জাহাজগুলোর ওপর ইরানি হামলার আশঙ্কাও ক্রমশ জোরালো হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক নিরাপত্তার জন্য এক গুরুতর হুমকি।

এই শক্তির অস্ত্র ব্যবহার করেই ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে চাপের মুখে ফেলছে এবং মার্কিন প্রশাসন এক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হচ্ছে- উত্তেজনার সাথে আপস করে আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্থিতাবস্থা রক্ষা করবে, নাকি ইসরাইলের কৌশলগত লক্ষ্যকে সমর্থন করে পরিস্থিতিকে আরও সঙ্ঘাতমুখী করে তুলবে।

ভবিষ্যতের পথ : সংকট কোন দিকে গড়াবে?

বর্তমান সঙ্ঘাত তিনটি সম্ভাব্য গতিপথে মোড় নিতে পারে, যার প্রতিটি ওয়াশিংটনের জন্য আলাদা কৌশলগত বাস্তবতা তৈরি করে,

১. নিয়ন্ত্রিত পারস্পরিক আঘাত-পাল্টা আঘাত : এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প। পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকবে কিন্তু বিস্ফোরিত হবে না।

২. সঙ্ঘাতের সম্প্রসারণ হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য ফ্রন্টে : এই ধরনের বিস্তৃতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। এতে একাধিক ফ্রন্টে সঙ্ঘর্ষ শুরু হবে এবং মার্কিন ঘাঁটিগুলোও সরাসরি হুমকির মুখে পড়বে।

৩. একটি অপ্রত্যাশিত, বড় ধরনের ইরানি পদক্ষেপ : যেমন কোনো শীর্ষস্থানীয় ইসরাইলি কর্মকর্তাকে হত্যা বা মার্কিন ঘাঁটিতে সরাসরি হামলা। এটি ওয়াশিংটনকে সরাসরি যুদ্ধের মুখোমুখি করে তুলবে।

এই বাস্তবতাগুলো আমেরিকার ‘ব্যাক চ্যানেল কূটনীতির’ ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে তুলেছে। তবুও ওয়াশিংটন স্বীকার করছে যে পরিস্থিতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নেই এবং যেকোনো ভুল হিসাব বা অপ্রত্যাশিত উত্তেজনা এই সঙ্কটকে সবচেয়ে ভয়াবহ পথে নিয়ে যেতে পারে।

‘সঙ্ঘাত যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়’ এই সরকারি বক্তব্যের পেছনে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জটিল সংঘর্ষ-নিয়ম এবং প্রতিক্রিয়ার ভারসাম্য রক্ষার এক দুরূহ চ্যালেঞ্জ লুকিয়ে আছে, যা আজকের মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের গভীরতর প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles