ইসির প্রস্তুতি চূড়ান্ত এ সপ্তাহেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ

‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে/হবেই হবেই দেখা, দেখা হবে বিজয়ে’ গানের মতোই দৃঢ়তা নিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত বছরের নভেম্বর মাসে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চলছে ইসি। অন্তর্বর্তী সরকারের বেঁধে দেয়া টাইমফ্রেমে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ইসি। সে অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে নির্বাচনের রোডম্যাপ (অ্যাকশন প্লান) প্রকাশ করা হতে পারে।
নির্বাচনের স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দলগুলো বসে নেই। পতিত আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) নির্বাচনের দাবি আমদানি করা হলেও নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই, প্রার্থী ঘোষণার কার্যক্রম চলছে। বিএনপি শরিক দলগুলোকে আসন ছেড়ে দেয়াসহ ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে দলীয়ভাবে জরিপ করছে। জামায়াত ইতোমধ্যেই ৩০০ আসনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। আরো কয়েকটি দল নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। আগামী রমজানের আগে নির্বাচন হবেÑ প্রধান উপদেষ্টার এমন ঘোষণার পর সারা দেশে কার্যত নির্বাচনের আবহ শুরু হয়ে গেছে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সময়ে নির্বাচনের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। সিইসি বার্তা দিয়েছেন, তিনি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কারো অযাচিত দাবি কর্ণপাত করবেন না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের আয়োজন করবে। বিগত কয়েক বছর সাংবিধানিক পদে থেকে সাবেক সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কে এম নূরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল মেরুদ-হীনভাবে ক্রীতদাসের মতো সরকারপ্রধানের আদেশ-নির্দেশ পালনের জন্য মুখিয়ে থাকতেন। কিন্তু ২০২৪ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণ করেই এ এম এম নাসির উদ্দীন নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
দায়িত্ব গ্রহণের তিন মাসের মাথায় সিইসি ঘোষণা দেন, ইসি প্রস্তুত, অন্তর্বর্তী সরকার যখনই চাইবে তখনই নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। গত ২৩ আগস্ট রাজশাহীতে সিইসি বলেছেন, ‘পিআর নিয়ে কে নির্বাচন চাইল সেটি দেখার বিষয় নয়; সংবিধানের প্রচলিত পদ্ধতিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ সিইসির লক্ষ্যÑ পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (১৯৯১) আয়োজক সাবেক সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফ ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০০১) আয়োজক সাবেক সিইসি এম এ সাঈদের মতোই দৃঢ় অবস্থানে থেকে ভোটের আয়োজন করা। ওই সময় রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন দাবি ও বিতর্কিত বক্তব্য থোড়াই কেয়ার করে তারা বলেছিলেন, ‘ইসি কোনো রাজনৈতিক দলকে বদার করে না।’ সম্প্রতি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে কক্সবাজার ও রাজশাহীতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় সিইসি বলেছেন, ‘মানুষ ২০১৪, ২০২৮ ও ২০২৪ সালের মতো প্রহসনের নির্বাচন দেখতে চায় না; মানুষ চায় ১৯৯১, ১০৯৬ ও ২০০১ সালের মতো নিরপেক্ষ নির্বাচন। দেশে ভোটকেন্দ্র দখলের প্রার্থী, ভোটারবিহীন, রাতের ভোট, আমি-ডামির নির্বাচন হবে না। আমাকে সরকার থেকে কোনো ধরনের চাপ দেয়ার চেষ্টা হলে পদত্যাগ করে চলে যাব।’
২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনে সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন। অন্য চার নির্বাচন কমিশনার হলেনÑ সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহমদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ইসি নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের মানুষ যখন নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে তখন হঠাৎ আগামী সংসদে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ভারতের নীলনকশা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) সামনে নিয়ে আসা হয়। জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন ভারতের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দাবিতে রাজনৈতিক অঙ্গন গরম করার চেষ্টা করে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় শত শত নেটিজেনকে দাবির পক্ষে প্রচারণা ও জনমত গঠনের জন্য নামায়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচনের পথে অনড়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীনকে বাসভবনে ডেকে নির্বাচনী প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দেন। নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করবে এমন কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা দেন। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গত ২৮ জুলাই ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে প্রেস সচিব শফিকুল আলম নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত করে জানান, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবে এমন দেড় লাখ পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে পরবর্তী তিন মাস পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ চলবে। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৬০ হাজার সেনা সদস্য মোতায়েন করা হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগে জেলার প্রশাসনে লটারির মাধ্যমে ডিসি, এসপি নিয়োগ দেয়া হবে। তবে যে কয়ক’টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে আপত্তি এসেছে, সেগুলোর শুনানি করা হবে। গতকাল ইসিতে কয়েকটি আসনের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে শুনানি হয়েছে। শুনানি চলার সময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। তবে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, যারা পিআর পদ্ধতি নির্বাচনের দাবি করছেন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনের অনুকূলে নয় দাবি করে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করছেন, তারাই পরিকল্পিতভাবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ শুনানিতে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করেন।
গত শনিবার রাজশাহীতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে রাজশাহী অঞ্চলের নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সিইসি বলেছেন, ‘আনুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) নির্বাচন সংবিধানে নেই। সংবিধানের বাইরে আমরা যেতে পারি না। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। আমি এর মধ্যে ঢুকব না। আমরা কিন্তু একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমরা যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের অফিসাররাসহ ৭৭ হাজারের বেশি লোক আমরা কাজে লাগিয়েছি। আগামী সপ্তাহেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে।’
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত করতে বৈঠকে বসেন চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসি কর্মকর্তারা। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এই বৈঠক চলে। বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাসুদ বলেন, দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। রোডম্যাপের সবই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহে ঘোষণা হবে। তবে ইসি সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে প্রতিদিন ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন। এ ছাড়া কমিশনের সচিব আখতার আহমেদ দেশের বাইরে (জাপান) অবস্থান করায় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। রোডম্যাপ নিয়ে বৈঠক শুরুর সময় নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সিদ্ধান্ত জানতে সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সার্বিক অগ্রগতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকেও জানাতে হবে। আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে রোজার আগে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সংক্রান্ত চিঠিও দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। সিইসি নাসির উদ্দীন বলেছেন, নির্বাচনের তারিখের প্রায় দুই মাস আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচন কমিশন সভায় আলোচনা শেষে জানানো হয়, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল দেবে ইসি।
নির্বাচন কমিশনের ‘জাতীয় নির্বাচন-সংক্রান্ত’ তথ্য ঘেটে জানা যায়, নির্বাচন কমিশন প্রাক-নির্বাচন এবং তফসিল পূর্ববর্তী প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য ‘কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সূচি’ সংক্রান্ত চেকলিস্ট তৈরি করে কাজের সুবিধার জন্য ঘোষণা করা হবে। ফখরুদ্দিন-মঈন ইউ আহমদ ক্ষমতা গ্রহণের পর ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি প্রথমবার রোডম্যাপ ঘোষণা করে। ২০০৭ সালের ১৫ জুলাই দেড় বছরের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়। ওই সময় ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, আইন-বিধি সংস্কার, দল নিবন্ধন করে ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। অতঃপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়।
এদিকে গতকাল আগারগাঁওস্থ নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ শুনানিকালে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছি।