Bangladesh

ইসি ডেকেছে আলাপে আলোচকরা আঁধারে, বিশিষ্টজনের পরামর্শ বাস্তবায়নে কোনো হেলদোল নেই ইসির

এর আগেও ঢাকঢোল পিটিয়ে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে বিশিষ্টজনের পরামর্শ বাস্তবায়নে কোনো হেলদোল নেই ইসির। তার পরও যেন আলাপ-আলোচনা থেমে নেই। আজ বুধবার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে আবার আলোচনায় বসছে ইসি। এতে চারজন আলোচক, চারজন পর্যালোচক ও ২০ জন আমন্ত্রিত অতিথির অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
 ইসির আমন্ত্রণ পাওয়া এসব বিশিষ্টজন বলছেন, এই আয়োজনের উদ্দেশ্য তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। কারণ, এর আগে সংলাপ করলেও পরামর্শ বাস্তবায়নে তাদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। উল্টো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধন ও নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের ভূমিকা হতাশাজনক। অন্যদিকে ইসির শীর্ষ কর্তারা বলছেন, বিদ্যমান সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ বর্তমান কমিশনের নেই। সংলাপের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া ইসির একার পক্ষে সম্ভব নয়।

ইসি-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আজকের এই আয়োজন নিয়ে খোদ কমিশন সদস্য এবং ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেই নানা সংশয় রয়েছেন। শুরুতে এই আয়োজনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মতবিনিময়’। এর পর তারা ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন : প্রত্যাশা ও বাস্তবতা’ শিরোনাম দিয়ে সেমিনার হিসেবে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে গতকাল কমিশনের তরফ থেকে অতিথিদের কাছে লিখিত আমন্ত্রণপত্রে এই আয়োজনকে ‘ওয়ার্কশপ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাঁচ পর্বে এই আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। আজকের আয়োজনের সফলতা বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী চার ধাপের আয়োজন করা হবে। এই আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে কমিশন সদস্যরা কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি হননি।

নির্বাচনের তিন মাস আগে এ ধরনের আয়োজনের কোনো ফল আসবে না বলে কমিশনের একাধিক সদস্য মনে করছেন। তাদের মতে, নির্বাচনের বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থানের পক্ষে নয়, এমন ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হলে কমিশন অহেতুক সমালোচনার মুখে পড়বে। আর তারা অংশ নাও নিতে পারেন। অন্যদিকে, সরকার সমর্থকদের নিয়ে এমন আলোচনার আয়োজন করা হলে তাতেও কমিশন সমালোচনার মধ্যে পড়বে।

ইসির আজকের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান গতকাল জানান, আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট নয়। এটা কি সেমিনার, না মতবিনিময় হবে, কারা বক্তব্য দেবেন– তাও স্পষ্ট নয়। তবু তিনি আজকের আয়োজনে অংশ নিতে যাবেন। এর আগে ইসি আয়োজিত সংলাপে তিনি গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি যেসব মত দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নে ইসির পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখতে পাননি।

সোহরাব হাসান আরও বলেন, এর আগে কে এম নূরুল হুদা কমিশনের সংলাপেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন, তারা সংলাপের কোনো পরামর্শ আমলে নেয়নি।

এই কমিশন কিছু আমলে নেবে কিনা, সেটা নির্বাচন এলে পরিষ্কার হবে। তিনি বলেন, সম্প্রতি আরপিও সংশোধন এবং রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় ১৪ চ্যালেঞ্জ বা বাধা চিহ্নিত করেছিল ইসি। সেসব বাধা উত্তরণে কিছু উপায়ের কথাও তারা বলেছিল। এর প্রথমটি ছিল– ‘বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী যে সুপারিশগুলো অধিকাংশজন করেছেন, তা বাস্তবায়ন’। তবে বাস্তবে সংলাপে আসা সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই ইসির।

কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্চ মাস থেকে সংলাপের আয়োজন করে। ওই সংলাপে পর্যায়ক্রমে দেশের শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। অবশ্য বিএনপিসহ ৯টি রাজনৈতিক দল সংলাপ বর্জন করে। গত বছরের ৩১ জুলাই সংলাপ শেষ হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে ইসি। পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আর কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, বর্তমান কমিশনের মেয়াদে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ তাঁর কাছে দৃশ্যমান নয়। সংলাপের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এই কমিশনের সদস্যরা আদৌ বুঝতে পারছেন না, নির্বাচনের সময় তাদের কী ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। পুলিশ কারও কথা শুনছে না। নির্বাচনের সময় এই পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসন তারা কীভাবে হ্যান্ডেল করবেন, কীভাবে তাদের কথা শোনাবেন। আইন সংস্কারের সময় আরপিওতে ছোট এক পরিবর্তন করে তারা যেভাবে নিজেদের শক্তিশালী ঘোষণা করছেন, তাতে মনে হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি তারা অনুধাবন করতে পারছেন না।’ এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই কমিশনার বলেন, ‘সেমিনারে আমি অংশ নিতে যাবে, তবে কী ইস্যুতে ডাকা হয়েছে, কমিশন কী শুনতে চায়, তা পরিষ্কার নয়। অংশ নেওয়ার পর হয়তো বোঝা যাবে।’ তিনি বলেন, নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ৩ থেকে ৪ মাস। এ সময়ের মধ্যে তারা কী শুনবেন, আর কী বাস্তবায়ন করবেন। আগের সংলাপের বিষয়গুলোর কিছুই তো বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে কমিশনকে জোর করে কথা শোনানো যাবে না। কমিশন সদস্যদের পরবর্তী পর্যায়ে সোসাইটিতে কী ধরনের অবস্থান হবে, তা তাদেরই নির্ধারণ করতে হবে।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত (রোডম্যাপ) কর্মপরিকল্পনায় সংলাপের সুপারিশ নিয়ে তাদের দেওয়া পর্যবেক্ষণের মধ্যে অন্যতম ছিল নির্বাচনকালীন সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনা, ইভিএমের ব্যবহার, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, রাজনৈতিক মামলা, ইসির ক্ষমতা প্রয়োগ। ইসি বলেছিল, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। নির্বাচনের সময় কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে ইসির অধীনে ন্যস্ত করার বিষয়টিও সংবিধানের আলোকে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।

ইসির আজকের আয়োজনে আমন্ত্রণ পাওয়া আরেক অতিথি অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, বর্তমান কমিশনের কাছে প্রত্যাশিত আচরণ পেতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা প্রয়োজন। অতীত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের আগে দুই মার্কিন সিনেটরের মধ্যস্থতায় এ ধরনের নিশ্চয়তার ভিত্তিতে ওই বছরের ৩০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেছিলেন। যার ভিত্তিতে সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন বর্তমান কমিশনের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। হয়তো তারা এ লক্ষ্যে কাজ করছে। এ কাজ দৃশ্যমানভাবে করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। অদৃশ্য চেষ্টায় সফলতার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়, বর্তমান কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য এই সিদ্ধান্ত একটা বড় অগ্রগতি।

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মতে, এবার ইসি ব্যালট বাক্স ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে অনিয়ম রাতে হলে তাকে চুরি বলা যায়, কিন্তু দিনের বেলায় একই ঘটনা ঘটলে তা হবে ডাকাতি। এই ডাকাতি বন্ধে ইসির জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, ইসির সংলাপে বেশির ভাগ দল নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো না কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছিল। অবশ্য নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দেওয়া প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করার এখতিয়ার ইসির নেই। তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসি যদি মনে করে এসব প্রস্তাবের বাস্তবায়ন না হলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়, তাহলে তাদের দায়িত্ব হলো এটি সরকারকে জানানো।

তবে আরপিও সংশোধনে ইসির সরকারের কাছে পাঠানো প্রস্তাবে সংলাপের সুপারিশ পুরোপুরি উপেক্ষিত ছিল। তাই আজকের আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার আশা নেই বললেই চলে।    

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d