Bangladesh

উচ্চতাপে সঙ্কটে জীবন-কৃষি, আকাশপানে চেয়ে আছে মানুষ-প্রাণিকুল

গা-জ¦লা অতি উচ্চ তাপপ্রবাহের কবলে সারা দেশ। দেখা নেই বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটাও। আকাশে বিক্ষিপ্ত মেঘের আনাগোনা আছে। তবে ফের মেঘ কেটে সূর্যের কড়া রোদের সেই দুঃসহ দহন। বৈশাখী প্রচণ্ড খরতাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। চাতক পাখির মতো মানুষ, প্রাণিকুল, প্রাণ-প্রকৃতি আকাশপানে চেয়ে আছে প্রশান্তির মেঘ-বৃষ্টির আশায়। রাত ও দিনে অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙছে প্রতিদিনই! আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, গতকাল শনিবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চুয়াডাঙ্গায় ৪২.৪, পাবনার ঈশ^রদীতে ৪২ ডিগ্রি সে.। যা চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে এ যাবত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। রাজধানী ঢাকায়ও তাপমাত্রার পারদ উঠে গেছে ৪০.৪ ডিগ্রিতে। অথচ আগের দিন ছিল ৩৮.৪ ডিগ্রি। ৪২ ডিগ্রি সে. বা ততোধিক উচ্চ তাপপ্রবাহকে ‘অতি তীব্র ধরনের তাপপ্রবাহ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে আবহাওয়া বিভাগ। যা গতকাল থেকে শুরু হয়। আগের দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪১.৫ ডিগ্রি সে.। গতবছর ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল আগের ৯ বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় পাবনার ঈশ^রদীতে ৪৩ ডিগ্রি সে.।

গতকাল সমগ্র খুলনা বিভাগের জেলাসমূহে তাপমাত্রার পারদ ছিল ৪১ থেকে প্রায় ৪৩ ডিগ্রির ঘরে, ঢাকা বিভাগে ৪০ থেকে প্রায় ৪১ ডিগ্রির ঘরে, রাজশাহী বিভাগের ব্যাপক অংশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৪২-এর ঘরে, বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ৩৬ থেকে ৩৯ ডিগ্রির ঘরে উঠে গেছে। রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ এবং সর্বনিম্নও ২৮.১ ডিগ্রি সে.।

দিনের অতি তীব্র তাপদাহের সঙ্গে রাতের ‘সর্বনিম্ন’ তাপমাত্রাও অধিকাংশ জায়গায় ২৭ থেকে প্রায় ২৯ ডিগ্রির ঘর ছাড়িয়ে গেছে। যা মৌসুমের এ সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। টানা উচ্চ ও অতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে সারা দেশে জনসাধারণের জন্য সতর্কতায় আবহাওয়া বিভাগের জারি করা তিন দিনের (৭২ ঘণ্টা) হিট এলার্ট অব্যাহত রয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যায় পরবর্তী তিন দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি, কোথাও কোথাও অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে অস্বস্তি বেড়ে গেছে। গতকাল সকালে ঢাকায় বাতাসে জলীয়বাষ্পের হার ছিল ৮৯ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৩১ শতাংশ। যা অস্বাভাবিক বেশি। এ অবস্থায় গরমে-ঘামে দ্রুত শরীর দুর্বল ও অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে তীব্র তাপদাহ চলমান থাকতে পারে পুরো বৈশাখ মাসজুড়ে। কেননা আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’র প্রভাব রয়ে গেছে। এর ফলে গরমের তীব্রতা এবং বৃষ্টি-নিরোধক খরাদশা বিরাজ করছে। যা চরম ভাবাপন্ন ও বৈরী আবহাওয়ারই রূপ। টানা উচ্চ ও তীব্র তাপপ্রবাহের সঙ্গে খরা-অনাবৃষ্টির কারণে সঙ্কটে পড়েছে জনজীবন এবং কৃষি-খামার অর্থনৈতিক খাত। গনগনে রোদের উত্তাপে পুড়ছে মাঠ-ঘাট-বিল। শুকিয়ে গেছে নদ-নদী-খাল। গ্রীষ্ম মৌসুমী ফল-ফলাদি, আধাপাকা ইরিবোরো ফসলে হিট শকের আশঙ্কায় চিন্তিত কৃষক। টানা ৩৫ ডিগ্রি সে. বা ততোধিক তাপমাত্রা এবং খরা-অনাবৃষ্টিতে হিটশক হয়ে থাকে। হিট শকে আধাপাকা ধান পুষ্ট হতে পারে না। চিটায় নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া ফল-ফলাদি অপরিপক্ক ও অপুষ্ট অবস্থায় পেকে যায় (অকালপক্ব), রসালো হয়না। আম, লিচুর গুটি ঝরে পড়ার শঙ্কাও থাকে।

টানা খরতাপে মাটির তলার পানি দ্রুতই আরও তলার দিকে নেমে যাচ্ছে। সুপেয় পানি এবং সেচের পানির অভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আগুনঝরা গরমে দিনে এনে দিনে খাওয়া দিনমজুর, শ্রমিক-কৃষক, কর্মজীবী মানুষের আয়-রোজগার এবং জীবনধারণের কষ্ট-যাতনা সীমাহীন। তীব্র তাপদাহের সঙ্গে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় গ্রাম-শহর-নগর-শিল্পাঞ্চল সর্বত্রই মানুষের নানামুখী দুর্ভোগ দুঃসহ। প্রচণ্ড গরমজমিত সর্দি-কাশি-জ্বর-শ^াসকষ্ট, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, হিট স্ট্রোকসহ মৌসুমী রোগব্যাধির প্রকোপ দেখা দিয়েছে প্রায় সবখানেই। হাসপাতাল-কিøনিক, ডাক্তারের চেম্বারে রোগী ও স্বজনদের ভিড় বেড়েই চলেছে।

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে মাত্র এক মিলিমিটার বৃষ্টি ছাড়া দেশের আর কোথাও বৃষ্টির ফোঁটাও পড়েনি! আবহাওয়া বিভাগ বলছে, কখনো কোথাও শিলাবৃৃষ্টি, বজ্র-কালবৈশাখীর সাথে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন বর্ষণে সাময়িক আরাম বোধ হতে পারে। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হলেও গরম আরো উসকে উঠে।

আজ রোববারসহ আগামী ৭২ ঘণ্টার (তিন দিন) পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী, পাবনাসহ খুলনা বিভাগে ও ঢাকা বিভাগের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট বিভাগের অনেক জেলার উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।

ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে মানুষের অস্বস্তি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

পরবর্তী ২ থেকে ৩ দিনে চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এর পরের ৫ দিনে আবহাওয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
আবহাওয়া বিভাগ জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের একটি বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।
উজানে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস পাউবো’র : গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান দেশের উত্তর-পূর্ব হাওর অঞ্চলের নদ-নদীর পূর্বাভাসে জানান, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার প্রধান নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে (অর্থাৎ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে) মাঝারি তেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময়ে দেশের উত্তর-পূর্ব তথা হাওর অঞ্চলের নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে বন্যা পরিস্থিতির শঙ্কা আপাতত নেই।

রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্র ৪১. ৫ ডিগ্রি : এদিকে রাজশাহী ব্যুরো জানায়, বৈশাখের সূর্য যেন আগুন ঝরাচ্ছে। সকাল থেকে তেঁতে ওঠা রোদ দিনভর ছড়াচ্ছে আগুনের হল্কা। রোদে তপ্ত কড়াইয়ের মতো তেঁতে ওঠেছে পথঘাট। দুপুর গড়াতেই তাপমাত্রার পারদ গিয়ে ঠেকেছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও ওপরে। গত শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে অধিকাংশ মসজিদেই চলমান তাপপ্রবাহ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয়। গরমের তীব্রতায় কয়েকদিন ধরেই রাজশাহীজুড়ে জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্ট। প্রখর রোদ-গরমে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হতে মাইকিং করে সতর্কও করা হচ্ছে।

জানা যায়, গত বুধবার থেকে রাজশাহীতে তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। বুধবার রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার ছিল ৩৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর শুক্রবার বিকেল ৩টায় রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল তাপমাত্রা গিয়ে ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দাঁড়ায়। এর আগে ১ এপ্রিলের পর রাজশাহীতে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গেল সপ্তাহ থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ তীব্র তাপপ্রবাহে রূপ নিয়েছে।

এদিকে, তীব্র খরার কবলে পড়ে হু হু করে নেমে যাচ্ছে জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভের পানির স্তর। ফলে অবর্ণনীয় কষ্টে দিনরাত পার করছেন এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষরা। মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিও গরমে হাঁসফাঁস করছে। অচল হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বৃষ্টির জন্য চারিদিকে হাহাকার পড়ে গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, দুর্বিষহ গরমে খা খা করছে মহানগরীর বিভিন্ন প্রধান সড়ক। বাড়ছে হিট স্ট্রোক ও ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই।

এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গেল দুই দিন থেকে রাজশাহীতে তাপপ্রবাহ নিয়ে সতর্ক থাকতে মাইকিং করেছে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি। তারা গরমে হিটস্ট্রোকসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচতে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিচ্ছেন।

রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, সামান্য বিরতি দিয়ে থার্মোমিটারে তাপমাত্রার পারদ এবার ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকেছে। রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের এটিই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজশাহী আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ‘বজ্রমেঘ’ তৈরি হলে কেবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখা দেবে। আর যদি এটা স্থানীয়ভাবে তৈরি না হয় তাহলে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় না। আর এখন বৃষ্টি না হলে আপাতত তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই ওঠানামা করবে।

Show More

2 Comments

  1. Hey there! Quick question that’s entirely off topic.
    Do you know how to make your site mobile friendly?

    My website looks weird when viewing from my iphone4.
    I’m trying to find a theme or plugin that
    might be able to resolve this issue. If you
    have any suggestions, please share. Thanks!

  2. Howdy just wanted to give you a quick heads up.
    The text in your post seem to be running off the
    screen in Safari. I’m not sure if this is a formatting issue or something to do with browser compatibility but I
    thought I’d post to let you know. The layout look great though!
    Hope you get the problem resolved soon. Thanks

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button