উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বিপাকে ৮৫ শতাংশ পরিবার
করোনার পর উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিপাকে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ৮৫ শতাংশ পরিবার প্রভাবিত হয়েছে। দুই শতাংশ পরিবার সারা দিন না খেয়ে থাকছে বলে জানিয়েছে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে সানেম আয়োজিত তিন দিনব্যাপী অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের একটি অধিবেশনে জরিপের এসব তথ্য তুলে ধরেন সংস্থার চেয়ারম্যান ড. সেলিম রায়হান।
সানেমের এ জরিপে উঠে আসে, এখনো ৩৭ শতাংশ পরিবার সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পাচ্ছে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হারও বেড়েছে।
বাংলাদেশ জনসংখ্যার ৮৪ শতাংশ কভিড-১৯ টিকার অন্তত দুটি ডোজ পেয়েছে। সানেম এটিকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে মনে করে। জরিপে সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির চাপের বিষয়টিও উঠে এসেছে। কভিডের সময় প্রায় ৮৫-৮৬ শতাংশ পরিবার মহামারীতে প্রভাবিত হয়েছিল, দরিদ্র পরিবারগুলো আরও বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিল।
বর্তমান দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতির কারণে দরিদ্র পরিবারগুলোর ২ শতাংশ সারা দিন না খেয়ে থাকে জানিয়ে সানেম বলছে, এটি ভয়াবহ পরিস্থিতির তীব্রতা নির্দেশ করে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, সঞ্চয় হ্রাস, খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হ্রাস করা, ঋণ নেওয়া এবং অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হচ্ছে বলে জানান সেলিম রায়হান।
ড. সেলিম রায়হান ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একটি স্থির দারিদ্র্যের হার দেখিয়ে বলেন, ২০২৩ সালে শহুরে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এই স্থবিরতার জন্য কভিড-১৯ মহামারী এবং মহামারী-পরবর্তী মূল্যস্ফীতির ধাক্কাকে দায়ী করেছেন তিনি। ২০২৩ সালে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার ছিল, যা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
সেলিম রায়হান জরুরিভাবে সরকারের উদ্দেশে তিনটি পরামর্শ দেন। এ তিনটি প্রস্তাব হলো শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো এবং নির্দিষ্ট নীতি, প্রত্যাবর্তনকারী অভিবাসী কর্মীদের জন্য উন্নত নীতি এবং দরিদ্র, দুর্বল, বিশেষ করে শহুরে দরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা কর্মসূচির পুনর্গঠন।
তিনি বলেন, ‘শহুরে পরিবারগুলোর জন্য উচ্চস্তরের অস্বস্তি রয়েছে। পাশাপাশি তারা একটি ভাসমান জনসংখ্যা। তাই এটি চিহ্নিত করা কঠিন।’
অর্থনীতির নীতির মধ্যে থেকেই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পক্ষপাত : সানেমের গতকাল বিকেলের অধিবেশনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থানবিষয়ক সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, দেশের সামস্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা নীতিতেই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা আলোচনা হচ্ছে, বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে কর্মসংস্থান বা শ্রমিকদের নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকও কর্মসংস্থান নিয়ে কোনো কথা বলে না। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা কাজের মধ্যে অন্যতম হলো কর্মসংস্থান তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়া।
সানেম আয়োজিত তিন দিনব্যাপী অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের গতকাল বিকেলের একটি অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে রিজওয়ানুল ইসলাম এ মন্তব্য করেন। এতে আলোচনার বিষয় ছিল শ্রমবাজার ও অর্থনীতির নীতি : সেখানে কি কোনো শ্রমিকবিরোধী বিষয় আছে?। এতে বক্তা ছিলেন আইএলও সাবেক কর্মকর্তা ও অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ানাতুল ইসলাম।
অধ্যাপক ইয়ানাতুল ইসলাম শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আইএলওর ভূমিকা নিয়ে কথা বলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের কর্মসংস্থান চিত্র ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কথা বলেন।
অধ্যাপক ইয়ানাতুল ইসলাম তার উপস্থাপনায় বলেন, এক সময় মনে করা হতো সর্বনিম্ন বেতন-ভাতা তুলে দিলে বেকারত্ব দূর হবে। তবে ২০০০ সালে পর সেটি পরিবর্তন হয়। এখনো শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা কম। আইএলও শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ নিয়ে কথা বলে, কিন্তু শ্রমিকদের ক্ষমতা নিয়ে কথা বলে না।
তিনি বলেন, এখনো শ্রমিকদের অধিকার কম। কর্মকর্তাদের যতটা অধিকার আছে, শ্রমিকদের অধিকার ততটা নেই। কেউ শিশুদের কর্মক্ষেত্রে দেখতে চায় না। নিরাপদ কর্মপরিবেশ এখনো সবার দাবি। পাশাপাশি শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষাও দিতে হবে।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি : অধ্যাপক ইয়ানাতুল ইসলাম তার উপস্থাপনায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে বেশকিছু তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আইএলওর সূচকে বাংলাদেশের শ্রমবাজার এখনো মানে পৌঁছাতে পারেনি। এখানে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা এখনো অপ্রতুল। তাদের কোনো দর-কষাকষির ক্ষমতাও নেই। দেশের শ্রমিকদের যে গড় বেতন তা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন। মাসে বেতন মাত্র ৪৫ মার্কিন ডলার। গত ১০ বছর ধরে প্রকৃত বেতন-ভাতা ঋণাত্বক হয়ে আছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এত বাড়ে, শ্রমিকদের বেতন কেন বাড়ে না?
অধ্যাপক ইয়ানাতুল ইসলাম শ্রমিকদের অধিকারের চর্চার ওপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি শ্রমিকদের বেতন-কাঠামোয় সংস্কার আনার সুপারিশ করেন।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে অধ্যাপক ইয়ানাতুল ইসলামের কাছে নানা প্রশ্ন করেন উপস্থিত শিক্ষার্থী ও গবেষকরা। তার কাছে প্রশ্ন ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কি বেকারত্ব বাড়িয়ে দেবে। এর জবাবে ইয়ানাতুল ইসলাম বলেন, এআই কর্মসংস্থান কমাবে, আবার এআই চালাতে দক্ষ জনবলের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সবশেষ, আসলে এআই দিয়ে কর্মসংস্থান কমবে না।