Bangladesh

উদ্বোধনের পরই ভাঙ্গতে হবে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

দৃষ্টিনন্দন পূর্বাচল সড়কও ভাঙা পড়বে –

রাজধানীর কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাধুনিক আট লেন পূর্বাচল সড়কটির কাজ শেষ পর্যায়ে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে উদ্বোধন করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে বাকি কাজগুলো জোরেশোরে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কিন্তু জানা গেছে, উদ্বোধনের পরপরই সড়কটি ভেঙে ফেলতে হবে। কারণ ওই সড়কের ঠিক মাঝ দিয়ে বসবে মেট্রোরেলের খুঁটি বা স্প্যান। ২০২৪-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শুরু হতে পারে তা স্থাপনের কাজ। সড়কটিতে পড়েছে অনেক সেতু, আন্ডারপাস ও গ্রেড ইন্টারসেকশন। সেগুলোও ভাঙা পড়বে।

গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম পাতাল রেলের (এমআরটি-১ লাইন) নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। ওই রেলপথের বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত থাকবে ভূগর্ভে। আর রূপগঞ্জের পীতলগঞ্জ থেকে জোয়ারসাহারা নতুনবাজার পর্যন্ত রেলপথটি হবে পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের মাঝের বিভাজক বরাবর ওপর দিয়ে তথা উড়ালপথ হিসেবে।

সড়কটি তৈরিতে রাজউকের ব্যয় ধরা আছে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। কাজ শেষে তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৫০০ কোটিতে। সড়কটিতে রয়েছে ১২টি সেতু, ছয়টি আন্ডারপাস (ভূগর্ভ দিয়ে পারাপার), পাঁচটি গ্রেড ইন্টারসেকশন (একাধিক মোড়ের সংযোগ) ও ছয়টি ফুট ওভারব্রিজ বা পথচারীর উড়াল সেতু। প্রতিটি আন্ডারপাসের নিচে তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের জলাধার ট্যাঙ্ক ও দুটি পাম্পিং স্টেশন। রাস্তার মাঝ বরাবর মেট্রোরেলের খুঁটিগুলো বসালে এগুলো তো ভাঙা পড়বেই, রাস্তাটিও মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজউকের ভুল পরিকল্পনার খেসারত দিতে হবে।

জানা যায়, পূর্বাচল নতুন শহর উন্নয়নের জন্য কুড়িল থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত সাড়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ আট লেন সড়ক তৈরির প্রস্তাব ২০১৩ সালে একনেকে পাস হয়। পরে অর্থ স্বল্পতার কারণে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আট লেনের পরিবর্তে চার লেনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৫ সালে ওই সড়কটির কাজ শেষ হয় বর্ধিত ৪২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পরই পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে রাস্তাটি সম্প্রসারণ, সার্ভিস রোড ও দুই পাশে ১০০ ফুট প্রশস্ত খাল খননসহ আরও অনেক কিছু সংযুক্ত করে নেওয়া হয় ‘৩০০ ফুট সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প’। আগের প্রকল্পে মোট ৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ের পর নতুন সম্প্রসারিত প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা।

সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, সড়কের মাঝে ৪ মিটার (১ মিটার= ৩.২৮ ফুট) প্রশস্ত মিডিয়ান বা বিভাজক রাখা হয়েছে মেট্রো রেলের খুঁটি বসানোর জন্য। একেকটি খুঁটি বসাতে যে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহূত হয়, তা ওই জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। যন্ত্রগুলো ব্যবহারে অন্তত ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের বর্গাকার সমতল জায়গা প্রয়োজন। তাতে খুঁটি বসানোর সময় ৬০ ফুট রাস্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া ব্রিজ, আন্ডারপাস ও গ্রেড ইন্টারসেকশনের জায়গাগুলোতে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ কীভাবে খুঁটি বসাবে, তা এখনও অনিশ্চিত। ফলে অনেক কিছুই ভাঙা পড়বে।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, পূর্বাচল সড়কে ৪৫০ থেকে ৫৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের প্রতিটি অন্ডারপাস, নিচে জলাধার পাম্প স্টেশন, ওপরে গ্রেড ইন্টারসেকশন- সব কংক্রিটের তৈরি। যেগুলোর প্রতিটিতে ব্যয় হয়েছে ৯০ থেকে ১০০ কোটি টাকা। এসব কংক্রিটের স্থাপনা কেটে কীভাবে মেট্রোরেলের খুঁটি বসানো হবে, তা কারও কাছেই বোধগম্য নয়। স্প্যান বসানোর পাইলিংই কীভাবে করা হবে, তাও একটি বড় প্রশ্ন।

পূর্বাচলে প্রথম তৈরি ৩০০ ফুট সড়ক প্রকল্পের কনসালট্যান্ট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন সমকালকে বলেন, পূর্বাচল সড়কে থাকা গ্রেড ইন্টারসেকশনগুলোর দৈর্ঘ্য চার-পাঁচশ মিটার। অথচ মেট্রোরেলের একটি স্প্যান থেকে আরেকটি স্প্যানের দূরত্ব হতে পারে ১৫০ মিটার। কাজেই গ্রেড ইন্টারসেকশনগুলো ভাঙা পড়বেই। আর আন্ডারপাসগুলোকে অক্ষত রেখে কীভাবে সেখানে স্প্যান বসাবে, প্রকৌশলী হিসেবে তাঁর কাছেও বোধগম্য নয়। মেট্রোরেলের কাজ শেষে আবারও এসব নতুন করে তৈরি করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না।

তিনি আরও বলেন, প্রথম তৈরি করা চার লেনের রাস্তাটির স্থায়িত্ব ধরা হয়েছিল ২০ থেকে ২৫ বছর। ওই রাস্তাটিই চলতে পারত, উচিত ছিল মেট্রোরেল তৈরির পর পরবর্তী সম্প্রসারিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।

পূর্বাচল সম্প্রসারিত রাস্তার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এহসান জামিল বলেন, ‘এই সমস্যাগুলো নিয়ে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে। আমরা সেখানে বলেছি, পূর্বাচল থেকে জোয়ারসাহারা অংশও মাটির নিচ দিয়ে নেওয়া যায় কিনা। তারা বলেছে, সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন আর নকশা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। আমার তো মনে হয় না, ৫৫০ মিটার দীর্ঘ দূরত্বে মেট্রোরেলের স্প্যান বসানো সম্ভব।’

তিনি এখনও নিজের মত সমর্থন করে বলেন, তা না হলে রাস্তার তো ক্ষতি হবেই, পাশের জমিরও ক্ষতি হবে।

এমআরটি লাইন-১-এর প্রকল্প পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, ‘বালু নদীর ব্রিজে সমস্যা হতে পারে। সে জন্য সেখানে ১৭০ মিটার দূরত্বে স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা আছে। আর কোথাও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাড়ে পাঁচশ মিটার লম্বা আন্ডারপাস থাকলে তাদের কনসালট্যান্ট এভাবে করল কেন? আমাদের তো এখন আর মেট্রোর নকশায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। ভূগর্ভে রেললাইন তৈরিতে খরচ অনেক বেশি। সরকার তো এসব দেখেই প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।’

তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী পাতাল রেলের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করার পর পীতলগঞ্জ ডিপো এলাকার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আগামী বছরের প্রথম ভাগেই হয়তো স্প্যানগুলো বসানোর কাজ শুরু হতে পারে।

রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মনিরুল হক বলেন, সাবেক পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও অনেক চেষ্টা করেছিলেন, যাতে মেট্রোরেলটা মাটির নিচ দিয়ে যায় এবং সড়কটি যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কিন্তু কাজ হয়নি। আর সম্প্রসারিত সড়ক প্রকল্পের কনসালট্যান্ট ছিল ডাটা এক্সপার্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা কেন এমন সমন্বয়হীন ডিজাইন করল, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

ডাটা এক্সপার্টের পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ডিজাইন হয়ে গেছে। এমআরটি কর্তৃপক্ষ এটা মাথায় রেখে ডিজাইন করলে সমস্যা হবে না। যেখানে আন্ডারপাস, সেখানেও তো মিডিয়ান আছে। আর আমরা যখন ডিজাইন করেছি, তখন তো এমআরটির ডিজাইন হয়নি। তাদের তো সব কিছু আমলে নিয়েই ডিজাইন করার কথা।’

বুয়েটের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক সমকালকে বলেন, পূর্বাচল সড়কে স্প্যানগুলো বসাতে গেলে সড়কের মধ্যে থাকা সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আধা কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের আন্ডারপাসগুলো এড়িয়ে কোনোভাবেই মেট্রোরেলের স্প্যান বসানো সম্ভব নয়। একটা পদ্ধতি থাকতে পারে সেটা হলো, কেবল বেজড এলিভেটেডওয়ে নির্মাণ। কিন্তু সেটা অনেক ব্যয়বহুল। মেট্রোরেল চলাচলের জন্য অনেক কঠিনও। এখানে সমন্বয় ও জবাবদিহি না থাকার কারণে এসব হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন যে এটার অনুমোদন দিল, তারা এটা বুঝল না। কারণ সেখানে পরিকল্পনাবিদ নেই। যে কারণে কিছু দিন পরপরই দেখা যায়, একটি প্রকল্পের সঙ্গে আরেকটির সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। এতে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে। জনগণ সরকারি অর্থের সুফল পাচ্ছে না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor