Trending

উন্নত দেশে হচ্ছে কাটছাঁট: মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়াল সরকার

উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করে কমিয়ে আনা হচ্ছে। অথচ একই সময়ে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার সংশোধন করে বাড়ানো হয়েছে। অর্থবছরের শুরুতে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও চলতি মাসে তা ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়। একবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ফের তা বাড়ানোর ঘটনা নজিরবিহীন। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গেল মার্চে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ওপরে অবস্থান করছে। তবে অর্থ বিভাগ আশা করছে, জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসবে।

সংশোধিত এ লক্ষ্যমাত্রার অনুমোদন দেওয়া হয় আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিয়ম হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেন্স কাউন্সিল বৈঠকে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সূত্র আরও জানায়, দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ে ওই বৈঠকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে সুদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯ শতাংশ সুদহারের ক্যাপ তুলে নেওয়া হয়। তবে এ হার যাতে অতিমাত্রায় বৃদ্ধি না পায়, সেজন্য একটি রেফারেন্স রেটভিত্তিক সুদের হার চালু করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর কারণে কৃষি খাত, মাঝারি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তারা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য সরবারহ সাইটে বিভিন্ন হস্তক্ষেপ অব্যাহত আছে। তবে এ উদ্যোগের ফলে ব্যাংকের তারল্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। এর ফলে বাজারে ভোক্তার চাহিদা হ্রাস পাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। তিনি আরও বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির আওতায় সরকারের উন্নয়ন খাতে ঋণ বন্ধ রাখা হয়েছে।

পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের ফলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক কারণগুলোকে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে মোকাবিলা সম্ভব। কিন্তু অ-অর্থনৈতিক (রাজস্ব ও মুদ্রানীতিবহির্ভূত) কারণগুলো মোকাবিলা সম্ভব নয়। এজন্য অ-অর্থনৈতিক কারণগুলো মোকাবিলা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ ওই বৈঠকে বলেন, ভোজ্যতেল, চিনি, মসলাসহ অন্যান্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া শুল্ক, পরিবহণ ব্যয়সহ অন্যান্য কারণে বাজারে পণ্যমূল্য কমানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তিনি আরও বলেন, খাদ্যপণ্যের ডিউটি খুব অল্প পরিমাণে কমানো হয়। এতে ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব পড়ে না। তিনি অভিমত দিয়ে বলেন, এমনভাবে ডিউটি কমানো দরকার এবং সেটি পুরো বছরের জন্য করতে হবে। এতে একটি স্থায়ী প্রভাব বাজারে দেখা যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।

ওই বৈঠকে অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এটি নিয়ন্ত্রণে সরকার ইতোমধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, সহায়ক রাজস্বনীতিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য বিতরণের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আকার বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী আমদানি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে নিত্যপণ্যের। পাশাপাশি বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে।

কোভিড-১৯-এর পর সবকিছুর চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এর মধ্যে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যে কারণে বিশ্বব্যাপী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় ২০২২ সালে। সেটি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশই সুদের হার বৃদ্ধি করে। বর্তমানে সে পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও পণ্য সরবরাহ সংকট কেটে যাচ্ছে। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে আসছে। সার্বিক এ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবল (আইএমএফ) বলেছে, ২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে।

এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। যেখানে ২০২২ সালে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। এছাড়া আইএমএফ-এর পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসছে। এছাড়া উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ থাকলেও ২০২৪ সালে প্রাক্কলন করেছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ।

এদিকে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়, ফেব্রুয়ারিতে কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়। কিন্তু মার্চে আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। এডিবির পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ৮ দশমিক ৪ শতাংশে উঠতে পারে।

দেশের মূল্যস্ফীতি কেন কমছে না-জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বুধবার বলেন, ট্রেজারি বন্ডের টাকা সরকারকে দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে টাকা ছাপানো হবে না। ভালো কথা। টাকা ছাপানোর কারণে মূল্যস্ফীতি আজ এ পর্যায়ে আসছে। সারা পৃথিবীতে মূল্যস্ফীতি কমলেও আমাদের কেন বেড়েছে। কারণ, সারা পৃথিবী যেদিকে গেছে, আমাদের পলিসি সেদিকে যায়নি। আমরা ব্যাংক ঋণের সুদ ৯-৬-এর মধ্যে আটকে রাখি। এটি কোভিডের সময় হয়তো ঠিক ছিল। কারণ, ওই সময় সারা পৃথিবী এ পলিসি নিয়েছে। কিন্তু এরপর আমেরিকার সুদের হার শূন্য থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের সুদের হার ৯-৬-এর মধ্যেই রেখে দিয়েছি। যদিও সম্প্রতি এর পবির্তন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সুদের হার বাড়তে দিতে হবে, যদি মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে এবং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে চাই। তবে সরকার যদি অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে সুদের হার অনেক বেড়ে যাবে। এজন্য বাজেট ব্যয়কেও সংকোচিত করবে।

আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিয়ম হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেন্স কাউন্সিল বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছরে প্রতি মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে বিরাজ করে। কিন্তু কোভিড মহামারির পর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে এর প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপর। সেখানে আরও বলা হয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা জুনে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। জানুয়ারিতে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সার্বিকভাবে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ মুদ্রা সরবরাহ প্রবৃদ্ধি জুনের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও কম। এছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসাবে দেখা হয়। মুদ্রাস্ফীতি বলতে পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়াকে বোঝায়, যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে। সহজ ভাষায় বললে, একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুত এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায়, অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায়; তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। এর ফলে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে আপনাকে আগের চেয়ে বেশি মুদ্রা খরচ করতে হবে। এর মানে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। সব মিলিয়ে ওই মুদ্রার মান বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button