Bangladesh

উন্নয়নে মাথা উঁচু গণতন্ত্রে উল্টো যাত্রা

উনিশশো বাহাত্তরের জানুয়ারি মাস। শীত-সকালের জমাট কুয়াশা ভেঙে বেরিয়ে আসে আলো, আবার তা মিশে যায়, ত্বরিত বিকালের হিমেল অন্ধকারে। পৃথিবী কি জানতে পারছে কী বিরাট ওলটপালট ঘটে যাচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে, পূর্ব গোলার্ধের একটি মানবঘন কোণে? দেশ ভেঙে বেরিয়ে আসছে নতুন দেশ, জাতি  ভেঙে আবার নতুন জাতি, নতুন নাম, নতুন নেতা, নতুন নাগরিক! ভারতের পুব সীমান্ত পেরিয়ে ঘরছাড়া মানুষজন ফিরতি পথ ধরছেন ঘরের দিকে। তফাৎ কেবল, চলে এসেছিলেন তাঁরা যে দেশ ছেড়ে, ফিরছেন একটা নতুন দেশে! অসম্ভব আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত, আশঙ্কায় উদ্‌ভ্রান্ত তাদের মন। ভাঙা-গড়ায় দোলায় দুলছে বাংলা আর বাঙালি।  (সেমন্তী ঘোষ, আনন্দবাজার) একটি জাতির জন্ম। নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাওয়া-না পাওয়া, আশা-হতাশা, অর্জন-বিসর্জনের মহাকাব্য। কোনো সংশয় নেই, বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় ১৯৭১। আহা কতো বলিদান, কতো আত্মত্যাগ।

স্বাধীনতা। অভিধানের সবচেয়ে মিষ্টি শব্দ। বিজয় ধরা দিলো ১৬ই ডিসেম্বর। আজ আরেকটি বিজয় দিবস। এ দিনে একদিকে আনন্দ, উদ্‌যাপন। অন্যদিকে প্রশ্ন কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ?
পদ্মা সেতু। মেট্রোরেল। বঙ্গবন্ধু টানেল। এক্সপ্রেসওয়ে।  মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো এক বাংলাদেশ। শুধু বড় বড় অবকাঠামো নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সূচকেও অনেক এগিয়েছে দেশ। একেকটি অবকাঠামো বদলে দিয়েছে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো। বদলে দিয়েছে সামাজিক কাঠামো। অতিসম্প্রতি বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে চালু করা হয়েছে ঢাকা থেকে সরাসরি রেল যোগাযোগ। এক সময় ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের বাংলাদেশ আজ হয়েছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মঙ্গার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠেছে এক কল্পকাহিনী। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রের ছোঁয়ায় এসেছে নতুন গতি। এক পদ্মা সেতুই দেশের একুশটি জেলাকে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করেছে। ফলে ওইসব জেলার সকল ক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থনৈতিক ভিতকে নাড়া দিয়েছে। এসবই সাফল্যে গাথা। সাফল্যের আরেক স্তম্ভ পায়রা বন্দরও দেশকে এগিয়ে নিয়েছে অনেকদূর। কিন্তু উন্নয়নের যে ঊর্ধ্বগতি ঠিক তার বিপরীত নিম্নগতিতে নেমেছে গণতন্ত্রের যাত্রা। মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ইচ্ছাকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে নানা কর্মকাণ্ডে। বাংলাদেশের সংবিধান কি এমনটা চেয়েছে? 

না! বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুটা অসাধারণ। যেখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানেরও মূলনীতি হইবে।’ প্রশ্ন হলো আসলে কি তা হয়েছে? বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অধিকার বঞ্চনার প্রশ্ন সামনে এসেছে বারবার। আশির দশক জুড়েই পরবাস থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম করতে হয়েছে বাঙালিকে। স্বৈরাচার হঠাও আন্দোলনে দিনের পর দিন রাজপথ ছিল উত্তাল। একদিকে হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ অন্যদিকে কারফিউ, গুলি চলে নির্বিচারে। নূর হোসেন, ডাক্তার মিলনসহ অনেকের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচার মুক্ত হয় দেশ। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর দিনটি তাই এদেশের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এবার মানুষ আশার আলো দেখতে থাকে জনগণ। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী সে সময়ের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। আর এ দায়িত্ব পালন করতে তার দেয়া শর্তও মেনে নেন রাজনীতিকরা। 

১৯৯১ সালে বলতে গেলে স্বাধীন ভোটের স্বাদ নেন দেশের মানুষ। নির্বাচনী উৎসবে ভিন্নরকম এক পরিবেশ দেশজুড়ে। ভোটের দিন দলে দলে ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট নিজে দেন। সে নির্বাচনে বিএনপি প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। দেশ এগুতে থাকে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় মাগুরার উপনির্বাচন নিয়ে। সে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগ রাজপথে নামে। তার সঙ্গে যোগ দেয় জামায়াত। সামনে আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। দেশ আবার হয়ে ওঠে আন্দোলনে উত্তাল। হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ চলতে থাকে। একপর্যায়ে রাজধানীর প্রেস ক্লাবের সামনে গঠন হয় জনতার মঞ্চ। সেই মঞ্চে যোগ দেন সরকারি আমলাদের কেউ কেউ। বাধ্য হয়ে সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন দিয়ে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে। এরপর ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। দায়িত্ব নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সে সরকারের অধীনে নির্বাচনে দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার স্বাদ নেয়। গঠন করে সরকার। এরপর সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন হয়। যার একটিতে বিএনপি তথা চারদলীয় জোট ও আরেকটিতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। অবশ্য এতে উচ্চ আদালতের একটি রায়কে উদাহরণ হিসেবে সামনে আনে সরকার। সে যাই হোক এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়েছে। এ দু’টি নির্বাচন কীভাবে হয়েছে তা সবাই জানে। 

আগামী ৭ই জানুয়ারি দেশের ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। যে নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনাদলগুলো নেই। সরকারি দল আওয়ামী লীগ, তাদের শরিক ও মিত্ররা এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বাতিলের মাধ্যমে। এর প্রমাণ মেলে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে। সে নির্বাচনে ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে পারেননি। কিংবা অনেকে ইচ্ছা করে ভোট দিতে যাননি। কারণ সে নির্বাচন বিএনপিসহ অনেক দল বর্জন করে। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। যে আন্দোলন এখনো চলছে। যে কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তারা অংশ নেয়নি। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ ক’টি দেশ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার তাগিদ দিয়েছে। দিচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না যে তা ইতিমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। কারণ তফসিল ঘোষণা হয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই কার্যক্রম শেষ। আগামী ১৭ই ডিসেম্বর প্রত্যাহারের শেষ দিন। ১৮ই ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ। এরপর শুরু হবে প্রচারণা। এসব ঘটনা মানুষের মনে দাগ কাটছে। 

১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা নিয়ে যে স্বপ্ন বুনেছিল দেশবাসী তা আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। নির্বাচনী উৎসবও এখন বিভক্ত হয়ে গেছে। একপক্ষ আন্দোলনে। অন্যপক্ষ নির্বাচনে। কিন্তু এরই মধ্যে নির্বাচনে বাধা সংক্রান্ত যাবতীয় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর এমন ঘটনা এই প্রথম। নির্বাচন কমিশন কেন এটা করতে গেল তা নিয়ে নানা প্রশ্ন এখন সর্বমহলে। সবমিলিয়ে গণতন্ত্র এখন উল্টোপথে হাঁটছে। যে দেশ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর মঙ্গার দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত ছিল। যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দেয়া হয়েছিল। সে দেশ এখন এসব কিছুকে ছাপিয়ে উন্নতির পথে অনেক দূর এগিয়েছে। বাংলাদেশ আজ মর্যাদার এক নাম। কিন্তু গণতন্ত্রের উল্টোযাত্রা এ সবকিছুকে তুচ্ছ করে তুলেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় কি নেই?

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports