Trending

উন্মুক্ত দরপত্রে সাশ্রয় হয় শত শত কোটি টাকা, উদাহরণ কক্সবাজার রেল প্রকল্প 

উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া গ্রহণ করায়, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে সরকারের ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বেঁচে যাওয়ারও উদাহরণ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন- আইএমইডি। 

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লিমিটেড দরপত্রের চেয়ে উন্মুক্ত দরপত্র গ্রহণ করলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।

প্রকল্প ব্যয় বাড়ার পেছনে যে বিষয়টি প্রধান ভূমিকা রাখে, অথচ বেশিরভাগক্ষেত্রেই যা খেয়াল করা হয় না, তা হলো- দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া। অনিয়ম, যথাযথ প্রকল্প পরিকল্পনা না করা এবং বারবার সংশোধনীর ফলেও অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর খরচ বেড়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে দরপত্র প্রক্রিয়া বড় ভূমিকা রাখে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া গ্রহণ করায়, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে সরকারের ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বেঁচে যাওয়ারও উদাহরণ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন- আইএমইডি। 

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি)  অর্থায়নের এই প্রকল্পের একটি ক্রয় কাজে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, তার চেয়ে ৪১ শতাংশ কম খরচে চুক্তি হয়েছে। উন্মক্ত দরপত্রে ঠিকাদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকায় এটা সম্ভব হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট ও অংশীজনরা বলছেন, উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় যেকোন দেশের ঠিকাদাররা দর দিতে পারেন। সাধারণত বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-র মতোন বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়ন করা প্রকল্পগুলোয় এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।   

এর বিপরীতে, অন্যদিকে ভারত, চীন, রাশিয়া, দ. কোরিয়ার মতো দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নের প্রকল্পে লিমিটেড টেন্ডারের তাদের দেশের ঠিকাদার নিয়োগে বাধ্যবাধকতা রয়েছে।  

লিমিটেড টেন্ডার পদ্ধতিতে প্রকল্পে প্রায়ই প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক বেশি দর প্রস্তাব করে ঠিকাদাররা। যে কারণে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ভোগান্তি বেড়েছে।

অংশীজনরা বলছেন, দেখা যায়– একাধিকবার দরপত্র আহ্বান করেও প্রাক্কলনের মধ্যে দরদাতা পাওয়া যায় না। আবার কোনো ধরণের দরপত্র আহ্বান না করে সরাসরি বিদেশি ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া হচ্ছে। এসব নির্মাণ কাজে খরচ বেশি হওয়ার অভিযোগও অনেক।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক যেসব দেশের ঋণে অর্থায়নকারী দেশটির ঠিকাদার নিয়োগের শর্ত থাকে, সেগুলো এড়িয়ে চলার ওপর গুরুত্ব দেন। তার বদলে অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি দ্বি-পাক্ষিক, বা জি-টু-জি অর্থায়নের প্রকল্পে স্বাস্থ্যসম্মত প্রতিযোগিতা হয় না। যেমন ভারত ও চীনের ঋণের এমন কিছু শর্ত থাকে, যেখানে ওদের দেশ থেকে পরামর্শক এবং ঠিকাদার নিতে হবে। এসব ঠিকাদার সিন্ডিকেট হয়ে কাজ করে। তখন এক ঠিকাদার উচ্চ মূল্য প্রস্তাব করে, এবং বাকিরা ডামি দর প্রস্তাব করে।’ 

উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ব্যয় সাশ্রয়

আইএমইডির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে,  দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি বেশ কয়েকটি প্যাকেজে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে প্যাকেজ-১ হলো চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। এই প্যাকেজে দুটি লট ছিল। লট-১ এ কাজের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবে ক্রয় বাবদ বরাদ্দ করা হয় ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। কিন্তু, উন্মুক্ত পদ্ধতির দরপত্রে নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদারের সঙ্গে এ কাজের জন্য ২ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকায় চুক্তি হয়েছে। 

একই কারণে এ প্রকল্পের অন্যান্য ক্রয় কাজেও নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দরে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে জানান রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, লিমিটেড টেন্ডারের কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে ভোগান্তি বাড়ছে। কিন্তু, উন্মুক্ত দরপত্রের কারণে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ক্রয় কাজে জটিলতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, লিমিটেড টেন্ডারের ছোট ক্রয় কাজেও জটিলতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না ।  

উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্পেও খরচ সাশ্রয় করেছে। ভারতীয় ঋণের এই প্রকল্পের সিগন্যালিং ও টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ২০২০ সালে ভারতীয় কোম্পানিগুলো প্রস্তাবিত ২২ কোটি টাকা বরাদ্দের চেয়ে ৩৩.৮২% বেশি দর প্রস্তাব করে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হলে, ৫৭ শতাংশ বেশি দর প্রস্তাব করে ভারতীয় ঠিকাদাররা। 

পরে রেলওয়ে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করলে প্রাক্কলনের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা কমে দরদাতা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়।

প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করলে কম খরচে নির্মাণ কাজ করা যায়। কিন্তু,  ভারত, চীন ও দ. কোরিয়ার অর্থায়নের প্রকল্পে এসব দেশের ঠিকাদার নিয়োগ করতে হয়। এতে প্রতিযোগিতা কম থাকে বলে বেশি দর প্রস্তাব করে।

একই কারণে ভারতীয় ঋণের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতের রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইন নির্মাণ কাজ– লিমিটেড টেন্ডারের পরিবর্তে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্রে যেতে বাধ্য হয়েছে– পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।  এতে ভারতের শর্ত অনুযায়ী, সেদেশের ঋণও বাতিল হয়েছে।

চীন ও জাপানের অর্থায়ন করা প্রকল্পগুলোয় উচ্চ খরচ

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জি-টু-জি পদ্ধতিতে চীনের ঋণের প্রকল্পে– দেশটি সরকারের মনোনয়ন পাওয়া ঠিকাদাররাই সরাসরি কাজ করে। পদ্মা রেল-সংযোগ, কর্ণফুলী টানেলসহ সব প্রকল্পে চীনা কর্তৃপক্ষের মনোনয়ন পাওয়া ঠিকাদারই কাজ পায়। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরাসরি ঠিকাদার কাজ পায় বলে চীনা ঋণের প্রকল্পের ব্যয়ও উচ্চ। 

অবশ্য, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেওয়া একটি প্রস্তাবের পর, সম্প্রতি চীন তাদের দেশের ঠিকাদারদের মধ্যে লিমিটেড টেন্ডার প্রক্রিয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে।  

কর্মকর্তাদের মতে, সরাসরি ঠিকাদার নিয়োগের শর্ত থাকার কারণেই চীনের অর্থায়ন করা প্রকল্পের ব্যয় বেশি। এতে করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কোনো কোনো প্রকল্পের ব্যয়ও কমানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২১ সালে তিনটি প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা কমিশন। পরে প্রকল্পেগুলোর ব্যয় কমানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে, চীন তিন প্রকল্পে আগ্রহ হারায়। এর মধ্যে অনুমোদিত দুই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ থেমে রয়েছে।  

প্রকল্পগুলো হলো -গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে পাবনার ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ; আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর; এবং জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর পর্যন্ত ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ। 

এদিকে, জাপানের অর্থায়নের প্রকল্পে উন্মুক্ত দরপত্রের কথা বলা থাকলেও– সাধারণত বড় অবকাঠামো প্রকল্পের ক্রয় কাজ সেদেশের ঠিকাদাররাই পায়। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাপানের অর্থায়নের প্রকল্পে যে  উন্নত প্রযুক্তি ও উপকরণের কথা উল্লেখ থাকে, তা অন্য কোনো দেশের ঠিকাদার সরবরাহ করতে পারে না। এ কারণে জাপানের ঠিকাদাররা অনেক বেশি ব্যয় প্রস্তাব করে।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইম্প্রুভমেন্ট  প্রকল্পে’ অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়। জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এই প্রকল্পের সমীক্ষা করে। পরে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পের ব্যয় ১২ হাজার ১৩৬.৫ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৮ হাজার  ৫৫৬ কোটি টাকায় নামিয়ে নিয়ে আনে, এবং জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী সভায় (একনেক) তা অনুমোদন পায়। 

ড. মো. শামসুল হক বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগীদের অনেক ঋণের শর্ত বোঝার বিষয়ে আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। এটা আমাদের পেশাদারিত্বের সমস্যা। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো আমাদের দেশে যে শর্তগুলো চাপিয়ে দেয়, অন্য দেশগুলোতে তা পারে না। আর একারণে আমাদের দেশে অবকাঠামো নির্মাণ খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় বেড়ে যায়।’ 

উদারহণ দিয়ে তিনি বলেন, জাইকা মেট্রোরেল নির্মাণে বাংলাদেশেও অর্থায়ন করেছে, আবার  ইন্দোনেশিয়াতেও অর্থায়ন করেছে। কিন্তু, ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি কিলোমিটারের ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। কারণ, জাইকা যে শর্তগুলো দিয়ে ঋণ দিতে চেয়েছে, ইন্দোনেশিয়া তা মানেনি। কিন্তু, আমরা মেনে নিয়েছি। এসব শর্তের কারণে প্রকল্পের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। 

তিনি আরও বলেন, ১০ বছরের গ্রেস প্রিরিয়ড এবং ৪০ বছরে ঋণ পরিশোধের পরিশোধের সুযোগ, চোখের দেখায় নমনীয় ঋণ মনে হয়। কিন্তু, শর্তের কারণে এমন ঋণের খরচ অনেক বেশি হয়। জাইকা প্রকল্প নির্মাণ কাজে ঠিকাদারদের যোগ্যতা এমনভাবে নির্ধারণ করে, যেখানে তাদের দেশের কয়েকটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই অংশ নিতে পারে।   

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor