Bangladesh

ঋণের চাপে পিষ্ট ছিলেন দুই সন্তানকে বিষ খাইয়ে আত্মহত্যা করা সালমা বেগম

‘প্রতিদিন সকাল থেইকা বাড়িতে মানুষ আসা শুরু করত। কেউ এসে কিস্তির টেকা, কেউ পাওনা টেকা চাইত। কখনো সালমা তাগো টাকা দিতে পারত, কোনো সময় কারোডা দিতে পারত না। শেষ পর্যন্ত চাপ কুলাইতে না পাইরা বাচ্চা দুইডা লইয়া মইরা গেল।’

কথাগুলো বলছিলেন মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় দুই সন্তানসহ নিহত সালমা বেগমের (৩৩) প্রতিবেশী ঝর্ণা বেগম। ঝর্ণাসহ প্রতিবেশীদের ভাষ্য, ঋণের চাপে দুই ছেলেমেয়েকে বিষপান করিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন সালমা।
সালমা কেয়াইন ইউনিয়নের উত্তর ইসলামপুর গ্রামের সৌদিপ্রবাসী অলি মিয়ার স্ত্রী। তাঁর মেয়ে ছাইমুনা আক্তার (১১) ও ছেলে মো. তাওহীদ (৭)। সালমা বেগমের মা-বাবা প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর আগে।

আজ সোমবার দুপুরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে সালমা বেগমের বাড়িতে গিয়ে সুনসান পরিস্থিতি দেখা যায়। দোচালা যে টিনের ঘরে তাঁরা থাকতেন, সেই ঘরটি তালাবদ্ধ। পাশে আরও একটি ছোট্ট ঘরে সালমা বেগমের শাশুড়ি সবুজা বেগম (৭০) বিলাপ করছেন। সবুজা বেগম বলেন, ‘ছাইমুনারে তিন বছরের আর তাওহীদরে পেটে রাইখা আমার ছোড পোলা অলি বিদেশ গেছে। ওগো কোলেপিঠে কইরা বড় করছি। আমার ঘরেই বেশি থাকত। সারা দিন দাদি দাদি কইরা ডাকত। বাড়ির উডানে দৌড়াইত।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সালমার শাশুড়ি বলেন, ‘শনিবার রাইতে আমার বিছানায় শুইয়া আছিল। বউ ওগো ডাইক্কা ঘরে নিয়ে গেল। ওগো আলু খাওয়াইল। শোয়ার আগে গ্লাসে কইরা দুধ খাওয়াইল। সকালে উইঠা শুনি আমার কলিজার টুকরাগুলো আর নাই। মাইনসের টেকার চাপে বউ মরল, আমার নিষ্পাপ নাতি-নাতনিদেরও লইয়া গেল। আমার পোলাডার সব শেষ হইয়া গেল।’

স্থানীয় ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সালমা বেগম ছয়টি এনজিও ও কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে ১২-১৪ লাখ টাকা ঋণ নেন। আট বছর আগে বিভিন্ন ব্যক্তি ও এনজিও থেকে চার-পাঁচ লাখ টাকা ধার করে সৌদি আরবে যান তাঁর স্বামী অলি মিয়া।

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অলি মিয়া প্রতি মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পাঠাতেন। পাওনাদারের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আরেক এনজিও, এক ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আরেক ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ করতে হতো তাঁকে। এই আট বছরে ঋণের চাপে অলি মিয়াও দেশে আসতে পারছিলেন না। ঋণের টাকা নিয়ে প্রায়ই স্বামী অলি মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে ঝগড়া হতো সালমার। শনিবার দিনের বেলায়ও স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয় তাঁর।

কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, রোববার সকালে কেরানীগঞ্জের একটি এনজিওর লোকজন বাড়িতে ঋণের টাকা নিতে আসেন। তাঁরা ভেতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ দেখতে পান। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। পরে তাঁরা জানালার একটি অংশ খুলে দেখেন সালমা ঘরে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে আছেন। আর পাশে দুই শিশুর লাশ।

সৌদিপ্রবাসী অলি মিয়ার সঙ্গে তাঁর এক আত্মীয়র মুঠোফোনের মাধ্যমে কথা হয়। অলি মিয়া বলেন, ‘আমার স্ত্রী শুধু আমার জন্য নয়, তার ভাই–বোনদের জন্যও বিভিন্ন এনজিও ও ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ করেছিল। আমি অল্প আয়ের মানুষ। এত ঋণ কীভাবে পরিশোধ করব। এটি নিয়ে কথা–কাটাকাটির হয়েছিল।’

আজ বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নেওয়া হয় তিনজনের লাশ। মা ও সন্তানদের আত্মহত্যার ঘটনায় সিরাজদিখান থানায় রোববার রাতে একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে বলে জানান সিরাজদিখান সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুস্তাফিজুর রহমান।

ঋণের চাপে গ্রামটির অধিকাংশ পরিবার

উত্তর ইসলামপুর গ্রাম ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামটিতে ৭০টির মতো পরিবার বসবাস করে। তাদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের। গ্রামের ৯০ ভাগ পরিবারের কোনো না কোনো এনজিও অথবা সুদের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ ঋণ নিয়েছেন। এসব অর্থ কেউ মাসিক, কেউ সাপ্তাহিক কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করছেন।

গ্রামের চানমালা, ফুলন নেসা, রোজিনা বেগমসহ কয়েকজন বলেন, এ গ্রামে এমনও সুদের কারবারিরা আছেন, যাঁরা এক লাখ টাকা ঋণ দিয়ে বছরে সুদই নেন ৬০ হাজার। সুদের টাকা পরিশোধ করতে গেলে আসল দেওয়া হয় না, আসল দিতে গেলে সুদ জোগাড় করা যায় না।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button