ঋণের বোঝা নিয়ে উড়ছে বিমান
ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে উড়ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও পদ্মা অয়েল কোম্পানির কাছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রয়েছে বিপুল পরিমাণ দেনা। এর মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেবিচকে বিমানের দেনা ছিল ৫ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। আয়-ব্যয় বিবরণীতে লাভ দেখালেও গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বিমানের কাছে পদ্মা অয়েলের পাওনা ছিল ১ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে ৩১ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে। আগের অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ২২ লাখ। সে হিসাবে ৯ লাখ বেশি যাত্রী পরিবহন করলেও এর প্রতিফলন নেই বিমানের নিট মুনাফায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে ৪৩৭ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছিল, সেখানে গত অর্থবছরে সংস্থাটি লাভ করেছে কেবল ২৮ কোটি টাকা। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে টাকার অবনমনকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিমানের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিচালন বাবদ গত অর্থবছরে বিমানের মোট লাভ ছিল ১ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে সংস্থাটির ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ফলে গত অর্থবছরে মুনাফা নেমে এসেছে ২৮ কোটি টাকায়। রুটভিত্তিক লাভ-লোকসানের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিমান সবচেয়ে বেশি লোকসান করে ঢাকা-ম্যানচেস্টার রুটে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৫১টি ফ্লাইট পরিচালনা করে এই এক রুটেই বিমান লোকসান করেছে প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা। যদিও ২০১২ সালে লোকসান ও এয়ারক্রাফট স্বল্পতায় বন্ধ রাখা হয়েছিল ম্যানচেস্টার রুটের ফ্লাইট। ম্যানচেস্টার রুটে বিমান চালুর পর থেকে কখনো লাভের মুখ দেখেনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় ফ্লাইট চালুর পর আবারও বিপুল পরিমাণ লোকসানের মুখে পড়ে সংস্থাটি। প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের বিরতিহীন ১৭ ঘণ্টার, ঢাকা-টরন্টো রুটে গত অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১৩০ কোটি টাকা। মধ্যপ্রাচ্যকে বলা হয় বিমানের রেভিনিউ জেনারেটিং রুট। প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশ থাকে এখানে। অথচ কুয়েত, আবুধাবি, দুবাই এর মতো জনপ্রিয় রুটেও বিমানকে লোকসান করতে হয় বছরে প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা।
বিমানের সবচেয়ে ব্যবসাসফল রুট ঢাকা-জেদ্দা। গত এক বছরের হিসাবে দেখা যায়- এই রুটে ৫ শতাধিক ফ্লাইট পরিচালনা করে লাভ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমানের এই লাভজনক রুটগুলো এখন প্রবল ঝুঁকিতে। কারণ কাতার, কুয়েত, ইথিওপিয়ান ও ইজিপ্ট এয়ারের মতো অন্তত ১০টি জনপ্রিয় এয়ারলাইনস যাত্রীদের নানা সুযোগ সুবিধা নিয়ে এখন বাংলাদেশে আসছে। ছোট-বড় ২১টি এয়ারক্রাফট নিয়ে, ২২টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এই ২২ রুটের ১৬টিতে লোকসান গুনছে প্রতিষ্ঠানটি। ৬টি রুটে লাভের পরিমাণ ৩৭৫ কোটি টাকা হলেও বাকি ১৬ রুটে পরিচালনগত লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। বিমান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে গত ৫১ বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় একই।
বিমানের ১৬তম বার্ষিক সাধারণ সভা গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থাপিত লাভ-ক্ষতি বিবরণীতে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিমানের পরিচালন খাতে লাভ হয় ১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। অপরিচালন খাত থেকে লাভ হয় আরও ১৩২ কোটি টাকা। এ টাকা থেকে সুদ বাবদ ব্যয়, আয়করসহ আনুষঙ্গিক খাতগুলো বাদ দিয়ে পরিচালন ও অপরিচালন খাত থেকে নিট মুনাফা হয় ১ হাজার ৩৯৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের কারণে ক্ষতি হয় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গত অর্থবছর বিমানের নিট মুনাফা হয়েছে ২৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
বিমানের সিইও শফিউল আজিম গণমাধ্যমকে বলেন, গত অর্থবছর আমরা অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বাবদ সিভিল এভিয়েশনকে ৫০৪ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। এটা চলতি হিসাব। আর পুরনো দেনা হিসাবে আমরা তাদের দিয়েছি ১৫০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ সালে পদ্মার বিল ছিল ১ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের পেমেন্ট করা হয়েছে ১ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। পুরনো বকেয়ার মধ্যে ১১০ কোটি টাকা শোধ করেছি।?পুরনো যে বকেয়া আছে, সেগুলো নিজের আমলে হয়নি উল্লেখ করে শফিউল আজিম বলেন, এসব বকেয়া কোম্পানি হওয়ার আগে থেকেই ছিল। মূল বকেয়ার পরিমাণ কিন্তু অনেক কম। সারচার্জ, সুদ ইত্যাদি মিলে টাকার অঙ্কটা বেড়ে গেছে। তারপরও চেষ্টা করছি পর্যায়ক্রমে দেনার পরিমাণ কমিয়ে আনতে।