Hot

ঋণ জালিয়াতিতে এবার ‘ছক্কা’ সাদ মুসার

সাদ মুসা গ্রুপ। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের এই শিল্পগোষ্ঠীর নেই খুব একটা নামডাক। তবে কাজের কাজ ঠিকই সেরে ফেলেছেন গ্রুপটির কর্ণধার মুহাম্মদ মোহসিন। তিনি ব্যাংক খাতে ‘সুচ হয়ে ঢুকে ফাল’ হয়ে বের হয়েছেন। তাঁর জোচ্চুরির কাছে আলোচিত ক্রিসেন্ট, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারিও ফেল। স্বেচ্ছা ঋণখেলাপির নতুন ‘রাজা’ এখন তিনি। গেল এক দশকে রপ্তানিতে কাঁচামাল কেনাবেচা দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছেন ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার ঋণ। এ ঋণের সবটাই এখন খেলাপি। 

ঠগবাজি করে নেওয়া ঋণ ব্যবসায় না খাটিয়ে চতুর মোহসিন দেশে কিনেছেন জমি-ফ্ল্যাট। পাচারের টাকায় যুক্তরাষ্ট্রে গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। প্রধান কার্যালয় বা শাখার সহায়তায় সাদ মুসা গ্রুপকে ঋণ দিয়ে দেশের ২৪ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন মহাবিপদে। বিভিন্ন পক্ষের যোগসাজশে মুহাম্মদ মোহসিনের নানা জালিয়াতির কীর্তি উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।

সাদ মুসা গ্রুপের ধোঁকায় সবচেয়ে বোকা বনেছে সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক (এনবিএল)। অনিয়মও বেশি হয়েছে এ ব্যাংকের ঋণে। এনবিএলের আগ্রাবাদ শাখায় গ্রুপটির চার প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। মোহসিন খেলাপির তথ্য লুকিয়ে সাদ মুসা গ্রুপের কর্মকর্তা ও চাচাতো ভাই মঈন উদ্দীন আহমেদ চৌধুরীকে এমডি দেখিয়ে ‘রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল’ নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠান খোলেন। পরে রেডিয়ামের নামে এনবিএল থেকে নেন ৭৫৫ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে ভুয়া বিল বেচাকেনায় রেডিয়াম কম্পোজিট ও সাদ মুসা গ্রুপের কর্মচারী মোহাম্মদ শওকত আলীর নামে খোলা ইইএসএম করপোরেশনের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয় সবচেয়ে বেশি। আর করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের সুদ ভর্তুকির আওতায় দেওয়া প্রণোদনা ঋণের ১৮৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যবসায় না লাগিয়ে নগদে তুলে নেওয়া হয়েছে। এনবিএলের বাইরে ১৬টি ব্যাংক সাদ মুসা গ্রুপকে ৩ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা এবং সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২৬৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে এখন গ্যাঁড়াকলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুহাম্মদ মোহসিন ঋণের বেশির ভাগই নিয়েছেন ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল কেনার জন্য একের পর এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও শুধু আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ১৯২ কোটি ১৫ লাখ টাকার রপ্তানি হয়েছে।

 যেসব কারখানার নামে এত টাকার ঋণের আয়োজন, এর সবই এখন বন্ধ। 

বেশ আগে থেকে জালিয়াতির পথে হেঁটেছে সাদ মুসা গ্রুপ। তবে ২০২১ সালে প্রথমবার বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তাঁর বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) প্রতিবেদন দেয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিএফআইইউ নড়েচড়ে বসলে নতুন ঋণ বের করার ফন্দি থেকে সরে এসে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেন মোহসিন। পরে ভিন্ন কৌশলে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে তিনি প্রচারণা চালান– চীন, বেলজিয়াম ও জার্মানির কয়েকটি ব্যাংক থেকে তাঁর ৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ আসছে। এ জন্য দ্রুত তাঁকে খেলাপিমুক্তভাবে কারখানা চালু রাখতে হবে। তবে ব্যাংকগুলো জানতে পারে, এটি ভুয়া প্রচারণা। ফলে কোনো ব্যাংক নতুন করে তাঁকে ঋণ দেয়নি। উল্টো বিভিন্ন ব্যাংক তাঁর নামে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। 

কে এই মোহসিন
একসময় ‘ভালো ব্যবসায়ী’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া মোহসিনের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। এক দশক ধরে শুধু ভুয়া ঋণের পেছনে দৌড়িয়ে দ্রুত ফুলেফেঁপে ওঠা এ ব্যবসায়ীর শুরুটা ছিল ১৯৮২ সালে। চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার থেকে মালপত্র কিনে বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করতেন। তাতে সুবিধা করতে না পেরে ১৯৮৬ সালে মুদির দোকান দেন। এক পর্যায়ে শুরু করেন গার্মেন্ট ব্যবসা। পরে ১৯৯৪ সালে বাবা ও চাচার নামের অংশ নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সাদ মুসা গ্রুপ’। 

মুহাম্মদ মোহসিন ২০১৩ সালে কার্যক্রমে আসা সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন। খেলাপি হয়েও তাঁর স্ত্রী শামীমা নারগিস মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক ছিলেন। তবে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি পদ ছাড়েন। 

সর্বশেষ গেল ২৩ এপ্রিল ঢাকা ব্যাংকের ৮৩ কোটি ২০ লাখ টাকা খেলাপি ঋণের এক মামলায় মোহসিন ও তাঁর স্ত্রী শামীমা নারগিসের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের মামলায় তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে।

মুহাম্মদ মোহসিনের সঙ্গে গত ২২ এপ্রিল কথা বলেছে সমকাল। তাঁর দাবি, আমি প্রতিহিংসার শিকার। আমার ব্যাংকে ঋণ রয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। আর সম্পদ রয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। আমার কোনো বেনামি ঋণ বা সম্পদ নেই। ভুয়া স্বীকৃত বিলের বিপরীতে ঋণ বের করার কয়েকটি ঘটনা বিএফআইইউর অনুসন্ধানে এসেছে জানালে তিনি অবশ্য বলেন, কিছু টাকা এদিক-সেদিক হতে পারে। তবে সব টাকাই তাঁর ব্যবসায় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি স্বেচ্ছা ঋণখেলাপি চিহ্নিত করার উপায় ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার বিষয়ে নীতিমালা করেছে। স্বেচ্ছা খেলাপির ওপর কী ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ হবে, তা স্পষ্ট করা হয়েছে ওই নীতিমালায়। সাদ মুসা গ্রুপের ঋণ কারসাজির বিষয়ে জানেন– কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন কয়েকজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, স্বেচ্ছা খেলাপি চিহ্নিত করতে যত ধরনের আলামত থাকা দরকার, মুহাম্মদ মোহসিনের মধ্যে সবই আছে।

আনোয়ারায় নামেই শিল্পপার্ক
আনোয়ারা উপজেলা সদরে ঢোকার ঠিক আগে বরকল সড়কের পাশেই সাদ মুসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। পরিচয় গোপন করে গত ৩১ মার্চ দুপুরে পার্কের ভেতরে গিয়ে দেখা মিলল এক নিরাপত্তা প্রহরীর। মূল ফটক থেকে সামনে এগোতেই চোখে পড়ল দুই পাশে টিনশেডের কারখানায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। এর মধ্যে রয়েছে মাহমুদ সাজিদ কটন, রোকেয়া স্পিনিং মিল, সায়মা-সামিরাহ টেক্সটাইল মিল, সুলতান হাবিবা, এমএ রহমান ডায়িংয়ের সাইনবোর্ড। প্রতিটি কারখানায় ঝুলছে তালা। আরেকটু সামনে স্টিল স্ট্র্যাকচারের পাঁচতলা নির্মাণাধীন ভবনে জং ধরেছে। ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ড সাঁটা– ‘প্রস্তাবিত সাদ মুসা অর্থনৈতিক অঞ্চল’। এখানে ব্যাংক ঋণের টাকায় কেনা প্রায় ২০০ বিঘা জমি রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

সামান্য একটু ঘুরে প্রধান ফটকের সামনে কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিনের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে এসে যোগ দেন কারখানার পাশের বাসিন্দা মিঠু। তারা জানান, পাঁচ কারখানায় সব মিলিয়ে ১ হাজার ৭০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করতেন। কয়েক বছর ধরে রপ্তানি বন্ধ। তবে অন্যদের অর্ডারে কিছু কাপড় উৎপাদন হতো। গত নভেম্বরে সব কারখানা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক দিন ধরে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা হয় না।

সাদ মুসা শিল্পপার্কের ঠিক উল্টো পাশে ‘আল্লাহর দান’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। মূলত সাদ মুসা গ্রুপের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিল এ রেস্টুরেন্টের মূল ক্রেতা। কারখানার খারাপ অবস্থার কারণে ২০২২ সালের দিকে রেস্টুরেন্ট মালিক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ চৌধুরী জাবেদ এ ব্যবসা গুটিয়ে জাহাজে ব্যবহৃত পুরাতন আসবাব বিক্রি শুরু করেন।

সাদ মুসা শিল্পপার্কের সামনের খালে মাছ ধরছিলেন ৬০ বছর বয়সী মো. ইউসুফ। তিনি বলেন, ‘যতটুকু শুনেছি, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় জমি কিনেছেন। অনেক টাকা বিদেশে নিয়ে গেছেন। ঋণের টাকা না দেওয়ায় তাঁর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।’ শিল্পপার্ক থেকে একটু সামনে বাড়িয়ে উপজেলা ভূমি অফিসের উল্টো পাশের বাজারে গেলে ইয়াছিন মিস্ত্রি, মুদি দোকানদার আবদুর রউফসহ স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, হঠাৎ করেই মোহসিন ২০১২ সালের দিকে জমি কিনতে থাকেন। শুরুতে তারা মনে করতেন, ব্যবসার টাকায় এসব সম্পদ করছেন। পরে জানতে পারেন, ব্যাংকের টাকা মেরে জমি কিনেছেন।

ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণে বিস্তর জালিয়াতি
২০১১ সালে ১২০ কোটি টাকার কম্পোজিট ঋণসীমা অনুমোদনের মাধ্যমে ন্যাশনাল ব্যাংকের সঙ্গে মুহাম্মদ মোহসিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক শুরু। ব্যাংকের মালিকপক্ষ সিকদার পরিবারের আনুকূল্যে তাঁর গ্রুপের ঋণসীমা সর্বশেষ ৯৫৯ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। যদিও সীমা না মেনে নামে-বেনামে এখন তাঁর ঋণ গিয়ে ঠেকেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্যে ২০১৬ সালে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান সাদ মুসা হোমটেক্স অ্যান্ড ক্লথিংয়ের অনুকূলে ৪১৫ কোটি টাকার চলতি মূলধন ঋণ অনুমোদন হয়। ব্যবসায় না খাটিয়ে ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর সাদ মুসার এ ঋণ ছাড়ের দিনই ঢাকার এমপি প্রয়াত আসলামুল হকের মালিকানাধীন মাহিম রিয়েল এস্টেটের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর হয় ১০৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। সেই টাকা আসলামুল হকের মাইশা প্রপার্টির ঋণ সমন্বয় হয়। আরও ৫০ কোটি টাকায় সিএলসি পাওয়ারে স্থানান্তর করে খেলাপিমুক্ত হন আসলামুল। এর বিনিময়ে মোহসিনকে গাজীপুরের কাশিমপুরের পানিশাইলে ২০ একর জমি দেন তিনি। এ জমি বেচাকেনায় অনিয়মের বিষয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ তদন্ত হয়। সেখানে বলা হয়, ২০১১ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ৪ কোটি ২৬ লাখ টাকায় জমিটি কেনেন আসলামুল হক। ব্যাংকের উন্মুক্ত নিলামে তখন জমির দর উঠেছিল ৪৬ কোটি টাকা। বাজারদরের চেয়ে কমে বিক্রি করে ব্যাংকের মালিকপক্ষের কেউ ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। সাদ মুসার ওপর বিএফআইইউর ২০২১ সালে পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, যে উদ্দেশ্যে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তাতে না খাটিয়ে অপব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই ঋণের টাকায় আরেকজনের ঋণ সমন্বয় করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে মুহাম্মদ মোহসিন বলেন, আসলামুল হকের ঋণ সমন্বয়ের জন্য আমি ওই টাকা স্থানান্তর করিনি। ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে এ লেনদেন হয়। তবে কোন ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক– জানতে চাইলে তিনি ভিন্ন প্রসঙ্গ আলোচনায় আনেন। একই বিষয়ে বারবার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবসা করতে গেলে অনেক সময় একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াতে হয়। আমি অন্যায় কিছু করিনি।
জানা যায়, ২০১৮ সালে এসে সাদ মুসা গ্রুপ ন্যাশনাল ব্যাংকে খেলাপি হয়ে পড়ে। এ তথ্য লুকিয়ে চাচাতো ভাই মঈন উদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর কাগুজে কোম্পানি রেডিয়ামের অনুকূলে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর ৪১০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর পর ২৬ ডিসেম্বর এনবিএলের দিলকুশা শাখা থেকে প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় সাদ মুসা গ্রুপের রোকেয়া স্পিনিং মিল ও এক্সিম ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার গ্রাহক ইইএসএম করপোরেশনের অনুকূলে ১২টি ভুয়া স্থানীয় এলসি খোলা হয়। এর বিপরীতে ৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা স্থানান্তর করে ঋণ সমন্বয় ও ঋণ পুনঃতপশিলের ডাউন পেমেন্ট দেওয়া হয়। এ ছাড়া তাঁর বেনামি কোম্পানি রেডিয়ামের নন-ফান্ডেড এলসির দায় ফান্ডেড ঋণে রূপান্তর করে তুলে নেওয়া হয় ১২৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর বাইরে সাধারণ ঋণ (লোন জেনারেল) হিসেবে দেওয়া হয় ১৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬ ডিসেম্বর ১০ কোটি ও ৯ ডিসেম্বর ১৬০ কোটি টাকা একটি চলতি হিসাবে স্থানান্তর হয়। এর মধ্যে ১০ কোটি টাকা নগদে তুলে নেন মোহসিন। বাকি ১৬০ কোটি টাকা সাদ মুসা ফেব্রিক্সের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়। আর চলতি মূলধন ঋণের ১৮০ কোটি টাকা কয়েক হাত ঘুরিয়ে ৮০ কোটি টাকা সাদ মুসা হোমটেক্সের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এসবিএল থেকে নেওয়া ঋণের মধ্যে ৬২ কোটি টাকা ব্যাংকটির চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে নির্মাণাধীন ভবনের চারটি ফ্লোর কেনার দাম পরিশোধ করেন। কিছুদিন পর এ সম্পত্তি আবার এনবিএলের কাছে বন্ধক রাখে ব্যাংক। যেখানে বন্ধকি দর দেখানো হয় ৪১ কোটি টাকা। ৬২ কোটি টাকার একটি অংশ এনবিএলের তৎকালীন দুই পরিচালকের হিসাবে যায় বলে জানতে পারে বিএফআইইউ। তবে ব্যাংকের অসহযোগিতার কারণে কার হিসাবে কত টাকা গেছে, তা বের করতে পারেনি। দুদকে পাঠানো প্রতিবেদনে এ টাকার গতিপথ বের করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

করোনার সময় দেওয়া সরকারি প্রণোদনার ঋণের অপব্যবহারের তথ্য তুলে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, এনবিএলের আগ্রাবাদ শাখার গ্রাহক সাদ মুসা হোমটেক্স অ্যান্ড ক্লথিংয়ের প্রণোদনা বাবদ ২০২০ সালের নভেম্বর ১২৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং তাঁর বেনামি কোম্পানি রেডিয়ামের ঋণের বিপরীতে ওই বছরের অক্টোবরে ৬৪ কোটি টাকা ছাড় হয়। বেতন-ভাতাসহ ওই কোম্পানির দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে এ টাকা খরচ করার কথা। তা না করে কয়েক হাত ঘুরিয়ে প্রায় সব টাকা নগদে তুলে নেওয়া হয়। রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল ও সাদ মুসা গ্রুপের কর্মচারী মোহাম্মদ শওকত আলীর নামে খোলা ইইএসএমের মাধ্যমে এ টাকা বের করে নেওয়া হয়। আর সাউথ বাংলা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় সাদ মুসা হোমটেক্সের দুটি আমানত হিসাবে তিন দফায় ৬৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা স্থানান্তর করে তুলে নেন মোহসিন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ আমানত হিসাবে গত ২০ এপ্রিল স্থিতি ছিল মাত্র ৮ হাজার ৬৯ টাকা। বাকি টাকা ওই সময়ই নগদে তুলে নেন। রেডিয়ামের প্রণোদনার ঋণের ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা সাতটি চেকের বিপরীতে প্রথমে আগ্রাবাদ শাখার সাদ মুসার ঋণ পুনঃতপশিলের ডাউন পেমেন্ট বাবদ দেওয়া হয়। ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা নগদে তুলে নেন মোহসিন। আর ২৩ কোটি টাকা তাঁর কর্মচারীর নামে খোলা অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে তুলে নেন। বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, এনবিএলের ৪২১তম সভায় উপস্থিত পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, ওই সময়ের এমডি, দিলকুশা ও আগ্রাবাদ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও ঋণ বিভাগের জ্ঞাতসারেই ওই ঋণ জালিয়াতি তথা আমানতকারীর টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।

এনবিএলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম গত ২৭ এপ্রিল বলেন, বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে। এ পর্ষদ ঋণ আদায়ে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে, বিশেষ করে শীর্ষ খেলাপি থেকে ঋণ আদায়ে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক এ টি এম এমদাদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রধান কার্যালয়ে কথা বলার অনুরোধ জানান। সদ্য যোগ দেওয়া ব্যাংকের এমডি তৌহিদুল আলম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মুহাম্মদ মোহসিন প্রথমে ইইএসএম ও রেডিয়ামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলে কাছে দাবি করেন। পরে টাকা লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য জানানোর পর বলেন, ইইএসএম দীর্ঘদিন ধরে আমার প্রতিষ্ঠানের সাপ্লায়ার। সে হিসেবে সম্পর্ক আছে। এ কারণে আমি বিপদে পড়ার পর কিছু সহায়তা করেছেন। আর রেডিয়ামের সঙ্গে রয়েছে ব্যবসায়িক সম্পর্ক। সেই সূত্রে ঋণের টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে এসেছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে ৪৬৪ কোটি টাকা
প্রিমিয়ার ব্যাংকে সাদ মুসা গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৬৪ কোটি টাকা। ছলচাতুরীর মাধ্যমে এ ঋণ নেওয়ার তথ্য উঠে আসে দুদকে পাঠানো বিএফআইইউর প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, ২০১৫ সালের জুনে সাদ মুসা ফেব্রিক্স ইউনিট-২ ও রোকেয়া স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ২৪০ কোটি টাকার সমন্বিত ঋণ সুবিধা দেয় প্রিমিয়ার ব্যাংক। ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখার মাধ্যমে এলসি, এলটিআর ও চলতি মূলধন হিসাবে এ ঋণ দেওয়া হলেও আজ পর্যন্ত কোনো রপ্তানি হয়নি। শুধু নিজেদের সহযোগী বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে লোকাল এলসির বিপরীতে এ টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এতদিনেও কোনো রপ্তানি না হলেও ২০১৮-১৯ সালে গ্রুপটি আরও ২৮টি ভুয়া এলসির বিপরীতে পণ্য কেনাবেচা দেখিয়ে স্বীকৃত বিল করে আরও ৯৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বের করে নেয়।

স্বীকৃত বিল সৃষ্টির মাধ্যমে টাকা বের করার উদাহরণ টেনে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল রোকেয়া স্পিনিং মিলের চারটি স্বীকৃত বিল কেনে প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা। তাঁরই বেনামি কোম্পানি ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক রেডিয়াম কম্পোজিটের ভুয়া এলসির বিপরীতে ৯ কোটি ২০ লাখ টাকার বিল কেনা হয়। ওই দিনই পুরো টাকা একই শাখায় আরেক সহযোগী কোম্পানি সায়মা-সামিরাহ টেক্সটাইল মিলের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর হয়। সেখান থেকে আবার এনবিএলের সাদ মুসার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে টাকা তুলে নেওয়া হয়। এভাবে টাকা বের করে নিলেও কখনও শোধ করেননি। ২০২০ সালের নভেম্বরে সাদ মুসা গ্রুপের ৩৫৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ১০ বছরের জন্য পুনঃতপশিলের অনুমোদন দেয় প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এ জন্য ডাউন পেমেন্ট বাবদ যে ১১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা, তা নিজ থেকে না দিয়ে ব্যাংকের সাসপেন্স অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ২১টি কাগুজে লোকাল বিল কিনে শাখার সান্ড্রি হিসাব থেকে ৫২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা সাদ মুসার অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়। এখান থেকে আবার পুনঃতপশিলের ডাউন পেমেন্টের টাকা জমা দেখানো হয়। অনিয়ম-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের জ্ঞাতসারে এভাবে আমানতকারীর টাকা বের করে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আবু জাফর বলেন, ‘আমি সবে ব্যাংকটিতে যোগ দিয়েছি। কোথায় কী আছে, সব জেনে পরে বলতে পারব।’ ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগে ওই ঋণ পেয়েছিল সাদ মুসা। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা চলছে।
এ ব্যাপারে মুহাম্মদ মোহসিন বলেন, ঋণ নিয়ে বাড়ি, গাড়ি বা বিদেশ পাচার করিনি।

এক্সিম ও প্রাইমের ৬২০ কোটি টাকা খেলাপি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সময়ে সাদ মুসা গ্রুপের তিনটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে ৫০০ কোটি টাকার সমন্বিত ঋণ সুবিধা দেয় এক্সিম ব্যাংক। এর আওতায় সাদ মুসার সহযোগী কোম্পানি মাহমুদ সাজিদ কটন ২০১৪ সালে মূলধনি যন্ত্রপাতি, স্পেয়ার পার্টস ও তুলা আমদানির জন্য সাতটি এলসি খোলে। এসব এলসির বিপরীতে ৩৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা শোধ না করায় ফোর্স ঋণ সৃষ্টি করা হয়। এর মাধ্যমে নন-ফান্ডেড দায় ফান্ডেড ঋণে পরিণত করে ব্যাংক। রপ্তানি না থাকলেও গ্রুপের সহযোগী কোম্পানিতে পণ্য বেচাকেনা দেখিয়ে স্বীকৃত বিল সৃষ্টির মাধ্যমে বের করা হয় আরও ৯৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে তাঁর কাছে ব্যাংকের পাওনা ৪৯৮ কোটি। কয়েক দফায় ঋণ পুনঃতপশিল করা হলেও তা আদায় হয়নি। ২০২০ সালে পুনঃতপশিলে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ডাউন পেমেন্ট নিজ উৎস থেকে দেননি মোহসিন; বরং এক্সিম ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা তাঁর বেনামি কোম্পানি ইইএসএম করপোরেশনের ছয়টি ভুয়া বিল কিনে ২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা দিলে সেখান থেকে ডাউন পেমেন্ট জমা করেন। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে ফোন করলে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে লিখিতভাবে দিতে বলেন। হোয়াটসঅ্যাপে সুনির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখ করে দেওয়ার পরও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

প্রাইম ব্যাংকের ঋণেও নানা জালিয়াতির তথ্য মিলেছে। সাদ মুসার সহযোগী কোম্পানি সায়মা-সামিরাহ টেক্সটাইল মিলের ফ্যাক্টরি ভবন নির্মাণের জন্য ২০১২ সালে ৮০ কোটি টাকা ঋণ দেয় প্রাইম ব্যাংক। নির্মাণকাজের অগ্রগতি যাচাই না করে ঋণ অনুমোদনের মাত্র তিন কর্মদিবসের মধ্যে ঋণ ছাড় হয়। ভবনের জন্য ছাড় করা ঋণ থেকে বেআইনিভাবে সাতটি চেকের বিপরীতে পূবালী ব্যাংকের সিডিএ করপোরেট শাখায় তাঁর আরেক কোম্পানি এমএ রহমান ডায়িং ইন্ডাস্ট্রির ২৫ কোটি ৫৯ লাখ সমন্বয় করে। এ ছাড়া এনসিসি ব্যাংকের ওআর নিজাম রোড শাখায় সাদ মুসা হোমটেক্স অ্যান্ড ক্লথিংয়ের ২৪ কোটি ৪২ লাখ টাকার ঋণ সমন্বয় করা হয়। এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রাইম ব্যাংক থেকে বের করা ১২২ কোটি টাকা এখন খেলাপি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করেও প্রাইম ব্যাংকের এমডি হাসান ও. রশিদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মুহাম্মদ মোহসিন বলেন, করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সংকটে পড়েছি। আবার আমার ব্যবস্থাপনায়ও কিছু ঝামেলা হয়েছে। এখন বিদেশ থেকে দক্ষ জনবল এনে কারখানা চালুর চেষ্টা চালাচ্ছি।

আরও যত ঋণ
ন্যাশনাল, প্রিমিয়ার, প্রাইম, এক্সিম ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নানা উপায়ে ঋণ বের করার তথ্য পেয়েছে সমকাল। এসব ক্ষেত্রেও নিজের কোম্পানিতে ভুয়া স্বীকৃত বিল বেচাকেনাসহ নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে বের করা হয়েছে ব্যাংকের টাকা। অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের। ব্যাংকটির পাওনা রয়েছে ৪৪০ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে অগ্রণী ব্যাংক ৩৭৮ কোটি টাকা, পূবালী ৩৭২ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ৩৫৬ কোটি, সাউথইস্ট ২০৫ কোটি, এনসিসি ১১০ কোটি ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ১০২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। শতকোটি টাকার নিচে ঋণ থাকার তালিকায় রয়েছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৯৬ কোটি টাকা, উত্তরা ৯১ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ৮৭ কোটি, ঢাকা ব্যাংক ৮৩ কোটি ও কৃষি ব্যাংক ৬২ কোটি টাকা। এ ছাড়া একটি সময় সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকে ২২ লাখ ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৯ লাখ টাকার ঋণ থাকলেও পরে তা সমন্বয় হয়েছে বলে ব্যাংক দুটি জানিয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মুরশেদুল কবীর বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপির একটি সাদ মুসা গ্রুপ। আমি এমডি হিসেবে যোগ দেওয়ার অনেক আগে এসব ঋণ দেওয়া হয়। এখন তা আদায়ের চেষ্টা চলছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে উত্তরা ফাইন্যান্সে। প্রতিষ্ঠানটিতে তাঁর ঋণের পরিমাণ ১৪৪ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সে ৫২ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ৩৪ কোটি, ইসলামিক ফাইন্যান্সে ২০ কোটি, ইউনিয়ন ক্যাপিটালে ১৮ কোটি, ইউনাইটেড ক্যাপিটালে ১৩ কোটি ও আইডিএলসি ফাইন্যান্সে রয়েছে ৬ কোটি টাকা। এসব ঋণও খেলাপি। ঋণ আদায়ে এরই মধ্যে কেউ কেউ মামলা ঠুকেছেন। 

উত্তরা ফাইন্যান্সের কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ মহিবুর রহমান বলেন, সাদ মুসার ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এ ঋণ আদায়ে এরই মধ্যে মামলা করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে মুহাম্মদ মোহসিন বলেন, আমি ২৬টি ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকিং করতাম। এনবিআর থেকে অর্থ পাচার মামলার পর ব্যাংকগুলো ভয় পেয়ে আমাকে ঋণ ছাড়ে অনীহা দেখায়। এর পর গুছিয়ে আনতেই ২০২০ সালে শুরু হয় করোনার প্রভাব। এর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সব মিলিয়ে ব্যবসায় ধরা খেয়েছি। বছরখানেক হলো রপ্তানি বন্ধ। এখন সরকার আমার পাশে দাঁড়ালে দ্রুত সব ঠিক করে ঋণ পরিশোধ করতে পারব। কেননা আমার কারখানা আছে; মেশিনারিজ আছে।

পাচারের টাকায় যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ 
নথিপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, পাচারের টাকায় ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি শিল্প প্লট কেনেন মুহাম্মদ মোহসিন। ৬ লাখ ৪০ হাজার ডলারে কেনা এ স্থাপনার অবস্থান ২৮৭৫, সাম্পসন অ্যাভিনিউ। ভবন কেনার জন্য মধ্যস্থতা করে স্টারাটা রিয়েলিটি ইন্টারন্যাশনাল নামে এক প্রতিষ্ঠান। মোহসিনের নামে জমির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২০১২-০৪৪৮৫৬০। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তাঁর একটি মামলা ঘিরে পুরো তথ্য জানতে পারে এনবিআর। এর পর বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা হয়, যা চলমান।

এনবিআরের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মোহসিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ দেখভালের জন্য সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেন। সাইফুল ২০১৪ সালে গোপনে তা বিক্রি করে দিলে প্রতিকার চেয়ে ওই বছর ৮ এপ্রিল ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে মামলা করেন মোহসিন, যার নম্বর আরআইসি-১৪০৪২২৭। এর পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আদালতের মধ্যস্থতায় মোহসিন ও সাইফুলের আপসরফা হয়। তখন সাদ মুসা গ্রুপের সাবেক এক কর্মকর্তা পুরো ঘটনা এনবিআরকে জানিয়ে দেন। এর পর ২০১৬ সালে অর্থ পাচারের মামলা করে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল। তিনি বলেন, পাচারের টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করছেন তারা। তবে আদালতের মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টি প্রমাণ করা অনেক সময়সাপেক্ষ। 

যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিক ভবন বেচাকেনার ওয়েবসাইট ‘লুপনেট’-এর তথ্যানুযায়ী, মোহসিনের কেনা ওই প্লটে ভাড়াযোগ্য জায়গা রয়েছে ৭ হাজার ৮২০ বর্গফুট। আর প্রতি এক হাজার বর্গফুটের বিপরীতে ৩ দশমিক ২টি পার্কিং রয়েছে। একতলা এ ভবন নির্মিত হয় ১৯৯০ সালে। এই জমির মালিকানাসহ বিস্তারিত জানতে চেয়ে স্টারাটা রিয়েলিটি ইন্টারন্যাশনালের কাছে এ প্রতিবেদক গত ২৩ এপ্রিল ই-মেইল করলে তাৎক্ষণিক জবাবে জানানো হয়, দ্রুত সময়ে বিস্তারিত জানানো হবে। তবে গতকাল পর্যন্ত আর সাড়া দেয়নি তারা।

এ ব্যাপারে মুহাম্মদ মোহসিন বলেন, সাদ মুসা গ্রুপের সাবেক কর্মকর্তার মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে এনবিআর ওই মামলা করে। বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশে আমার সম্পদ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যাংকগুলোর কাছে মোহসিন অত্যন্ত ‘ধূর্ত’ হিসেবে পরিচিত। ধারণা করা হয়, ব্যবসার নামে নেওয়া ভুয়া ঋণের একটি অংশ বিদেশে পাচার করেছেন। চাপে পড়ার পর সেই টাকা আবার ঋণ আকারে ফেরত আনার জন্যই হয়তো বিদেশি ঋণ আসছে এমন ধুয়া তুলেছিলেন। কোনো কারণে এখন আবার হয়তো পিছিয়ে গেছেন। তিনি জানান, বিদেশি ঋণ আনার প্রচারণা চালানোর মধ্যে নতুন ঋণ নিতে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেন। তখন তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয়, আংশিক জমি বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত করতে। তিনি তাতে রাজি হননি।

দায়মুক্তি দিচ্ছে দুদক
ঋণ জালিয়াতির সুনির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ করে ২০২১ সালে দুদককে প্রতিবেদন দেয় বিএফআইইউ। সাদ মুসার কর্ণধারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে এনবিআরের অর্থ পাচার মামলা চলছে। অথচ দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে দুদক মোহসিনের বিরুদ্ধে করা ওই মামলা নথিভুক্তির মাধ্যমে সমাপ্তির সুপারিশ করেছে। দুদকের অনুসন্ধান দলের সুপারিশে বলা হয়েছে, সাদ মুসা গ্রুপের ৯ প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণ নিয়ে নতুন জায়গা কিনে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। আইসিবি থেকে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অনুমোদিত ঋণ দিয়ে যন্ত্রপাতি কিনে উৎপাদন চালুর পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞার কারণে ওই ঋণ বাতিল হয়। পরে করোনার প্রকোপ ও নতুন ঋণ না পাওয়ায় উৎপাদন চালু করতে পারেননি। অনুসন্ধান চলার সময় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে এগ্রিকালচারাল ব্যাংক অব চায়না সাদ মুসা গ্রুপ সম্প্রসারণের জন্য ৬ কোটি ৬৫ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ ডলারের ঋণ দেওয়ার জন্য বিডা কার্যালয়ে চুক্তি করে। ফলে শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানে মোট ৫০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতিতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পরিসমাপ্তির সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ঋণ জালিয়াতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলেও কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না। শুধু জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়ে থাকে। আর জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুদকে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এখন দুদক যদি দায়মুক্তি দেয়, সেটি তাদের নিজস্ব বিষয়।

এ ব্যাপারে দুদকের তদন্তকারী দলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সাদ মুসা গ্রুপের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছি। তবে সেটি চূড়ান্ত কিছু না।’ আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের জন্য তিনি জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘কোনো বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই।’

এমন জালিয়াতি নতুন নয়
আলোচিত ঋণ জালিয়াতি হলমার্ক, বিসমিল্লাহ কিংবা ক্রিসেন্ট লেদার কেলেঙ্কারির সবই ঘটে এক কায়দায়। রপ্তানি না করেই সাদ মুসা গ্রুপের মতো ভুয়া স্বীকৃত বিল তৈরি করে ব্যাংকের টাকা বের করেছেন তারা। এসব ঘটনার পর ভুয়া বিলে টাকা বের করা ঠেকাতে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবু একই কায়দায় বড় জালিয়াতি করেছে সাদ মুসা গ্রুপ।

ভুয়া রপ্তানি বিলে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৫৭২ কোটি আত্মসাৎ করে ঢাকার ক্রিসেন্ট লেদারের পাঁচ প্রতিষ্ঠান। হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ ২০০৯ থেকে ২০১২ সময়ে সোনালী ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। বিসমিল্লাহ গ্রুপের কর্ণধার খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী ভুয়া রপ্তানির আড়ালে জনতাসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১৭৪ কোটি হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য ফাঁস হয় ২০১২ সালে। এ ছাড়া আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল সময়ে ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মাসাৎ হয়। প্রতি ঘটনায় একাধিক মামলা করেছে দুদক। কোনো কোনো মামলায় এরই মধ্যে সাজা হয়েছে। তবে মুহাম্মদ মোহসিনের বিষয়ে ২০২১ সালে বিস্তারিত প্রতিবেদন পাওয়ার পরও ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button