Bangladesh

একটি ফ্লাইওভারের গল্প

এ এক অন্যরকম গল্প। যে গল্প হার মানায় রূপকথাকেও। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মারপ্যাঁচে যেখানে বন্ধু হয়ে যায় বিশ্বাসঘাতক। বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজে হয়ে গেলেন এক রাজ্যের মহারাজা। অন্যদিকে যার জন্য তিনি পেলেন রাজ্য, তাকে ছুড়ে দেয়া হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এমন কাহিনী গল্প আর সিনেমাতেই দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে এমন এক গল্পের খলনায়ক ওবায়দুল করিম চৌধুরী। আর তার রাজ্যের নাম ওরিয়ন। ওরিয়ন গ্রুপ। ঢাকার প্রবেশ পথ যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান যে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে এই ওরিয়ন গ্রুপের তত্ত্বাবধানেই। এখানেও রয়েছে আরও ভয়ঙ্কর গল্প। তার আগে রাজ্য দখলের গল্প আপাতত কিছুটা জেনে আসা যাক। দুই দশক আগের কথা। তখন ২০০৩ সাল। এ সময় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বাংলাদেশে আসেন সেদেশের ধনকুবের ব্যবসায়ী মাজেদ আহমেদ সাইফ বেলহাসা। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে নির্র্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা। বাংলাদেশে এসে ঘটনাচক্রে যোগাযোগ হয় ওবায়দুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে। বেলহাসা জানান, তার মনের ইচ্ছার কথা। লুফে নেন ওবায়দুল করিম চৌধুরী। দুইজনের মধ্যে কথা হয়। হয় বন্ধুত্ব। একে- অপরকে বিশ্বাস করেন। তাহলে আর দেরি কেন? ২০০৩ সালেই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেন ধনকুবের বেলহাসা। দুবাইভিত্তিক কোম্পানি বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকটিং কোম্পানি এলএলসি ও বেলহাসা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি এলএলসি’র শাখা খোলেন বাংলাদেশে। সঙ্গে নেন বন্ধু ওবায়দুল করিম চৌধুরীকে। বেলহাসা ঢাকার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজে অর্থ বিনিয়োগ করেন। এক বছরের মাথায় কূটচাল চালতে থাকেন ওবায়দুল করিম। ফন্দি আঁটেন পুরো ব্যবসা নিজের করে নেয়ার। ওদিকে ওবায়দুল করিম বেলহাসার প্রকল্পের নামে ব্যাংক লোন নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার শুরু করেন। বিষয়টি জেনে যায় বেলহাসা। এছাড়া বেলহাসা কোম্পানির শেয়ার ভাগাভাগী নিয়েও দু’জনের মধ্যে সৃষ্টি হয় দূরত্ব। ওবায়দুল করিম শুরু করেন কোম্পানি হাতিয়ে নেয়ার চক্রান্ত। খুবই দ্রুত জাল-জালিয়াতি করে পুরো কোম্পানি দখলের চেষ্টা করেন। এ কাজে সহায়তা নেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও। জাল স্বাক্ষর করে কোম্পানির নামও বদলে দেন। বেলহাসা থেকে নাম পাল্টে হয়ে যায় ওরিয়ন গ্রুপ। এ গ্রুপের চেয়ারম্যান হন ওবায়দুল করিম। এরপর শুরু হয় তার অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, শেয়ার প্রতারণা, অংশীদারদের শেয়ার দখল। শুধু তাই নয়, পরিবারের সদস্যদের নামে ভুয়া মালিকানা হস্তান্তর শুরু করেন। এরপর জড়ান একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা। এ থেকেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ওরিয়ন গ্রুপের নাম। ওবায়দুল করিম চৌধুরীর নাম। একজন বিদেশি ধনকুবের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে নিঃস্ব হয়ে ফিরেন তার দেশে। সঙ্গে বয়ে নিয়ে যান নজিরবিহীন এক প্রতারণার ইতিহাস। ওবায়দুল করিমের নেশাই ছিল এটি। শুধু বেলহাসা নয়, একম ইঞ্জিনিয়ারিং নামে আরেকটি কোম্পানি এভাবে দখল করেন ওবায়দুল করিম। তার সেই অংশীদারকেও করেন দেশছাড়া। ওবায়দুল করিমের উত্থানের শুরু এমন নাটকীয়ভাবে। শুরুতেই দুবাইভিত্তিক কোম্পানি বেলহাসার শেয়ার কেলেঙ্কারি করে হাতিয়ে নেন কোম্পানির দেড় হাজার কোটি টাকা। ওদিকে ক্ষমতা খাটিয়ে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা লোপাট করে রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানবজমিন-এর অনুসন্ধানে ওরিয়ন গ্রুপের জাল-জালিয়াতির অনেক তথ্য উঠে এসেছে।

ফ্লাইওভার থেকে হাজার কোটি টাকা উধাও: ঢাকা সিটি করপোরেশন যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় ধরে ৬৭০ কোটি টাকা। সেই অনুযায়ী ওবায়দুল করিম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১০ শতাংশ সুদে ৬০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। এরমধ্যে জনতা ব্যাংক-২০০ কোটি, এসআইবিএল ব্যাংক-৫০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক-১৫০ কোটি, আইসিবি ব্যাংক-৫০ কোটি, রূপালী ব্যাংক-১৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়। তবে ওবায়দুল করিম তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক আসিকুর রহমান ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের যোগসাজশে তথাকথিত আরবিট্রেশনের নামে চুক্তির ৬৭০ কোটি টাকা থেকে ব্যয় বাড়িয়ে ২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করেন। তবে আরবিট্রেশন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সিমপ্লেক্স ইনফ্রাক্টাকচার লি. ইন্ডিয়ার সঙ্গে হওয়া চুক্তিমতে, ফ্লাইওভারে কনস্ট্রাকশন কাজে মোট খরচ হয় ৭৮৮ কোটি টাকা। অথচ প্রকল্প ব্যয় ধরা ছিল ৬৭০ কোটি টাকা। কিন্তু অবৈধভাবে ব্যয় বর্ধিত করা হয় ২৩৭৮ কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বন্ড ডিসকাউন্টের মাধ্যমে বন্ধক রেখে ২১৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এরমধ্যে ১৩৬২ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয় এমন তথ্যও প্রকাশ পায়। এদিকে বেলহাসা ও একম ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যাংক একাউন্টে লেনদেনের স্টেটমেন্ট ঘেঁটে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার প্রকল্পে ৭৯০ কোটি টাকা খরচের তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি ১৩৬০ কোটি টাকার কোনো হদিস মেলেনি। ২০১১ সালের ২৮শে নভেম্বর বেলহাসা-একম জেভি অ্যান্ড এসোসিয়েটের নাম পরিবর্তন করে অবৈধভাবে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার নামকরণ করা হয়। এই নাম পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় ওবায়দুল করিম বেলহাসার প্রধান অংশীদার মাজেদ বেলহাসা ও পার্টনার মুজিবুল হকের স্বাক্ষর জাল করেন। এজিএম ছাড়াই তাদের কোম্পানি থেকে বের করে দেয়া হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওবায়দুল করিম যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার থেকে আদায়কৃত টোলের মাত্র ৪০ শতাংশ হিসাবে দেখান। বাকি ৬০ শতাংশ টোলের টাকা গোপনে সরিয়ে নিচ্ছেন। ১২ বছর ধরেই চলছে এ ঘটনা। এমন বেশকিছু টোল আদায়ের ব্যালেন্স সিট মানবজমিন-এর হাতে এসেছে। ফ্লাইওভার সরজমিন ঘুরেও এমন চিত্র দেখা গেছে। নির্দিষ্ট টোল প্লাজা বাদ দিয়েই ফ্লাইওভারের বিভিন্ন পয়েন্টে চালকদের হাতে রশিদ ধরিয়ে টোল আদায় করছেন ওরিয়নের পোশাক পরিহিত কিছু ব্যক্তি। এভাবে টাকা নেয়ার হিসাব থাকছে না কম্পিউটারের সফ্‌টওয়্যারে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাব বলছে, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলে ৮ থেকে ১০ হাজার। সে হিসাবে টোল আদায় হওয়ার কথা বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। আর ওরিয়ন হিসাব দিচ্ছে বছরে ১৪০ কোটি থেকে ১৭৮ কোটি টাকার। 

এ ছাড়া ফ্লাইওভার নির্মাণ নকশা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। নিচের রাস্তা বন্ধ করে পায়ার ও ডিভাইডার করা হয়েছে যাতে গাড়ি কম চলতে পারে।
বেলহাসা দখল করে ওরিয়ন তৈরি: জালিয়াতি করে একম এবং বিদেশি জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি বেলহাসার প্রধান অংশীদারকে বাদ দিয়ে ওরিয়নের মালিক বনে যান ওবায়দুল করিম। ২০০৩ সালের মে মাসে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভার প্রকল্পটি দুই স্তর বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে যোগদান করা দাতাদের কারিগরি অভিজ্ঞতা ও আর্থিক যোগ্যতা চাওয়া হয়। সে সময় আন্তর্জাতিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে দরপত্রে অংশ নেয় ওবায়দুল করিম। আইনগত শর্ত পূরণের জন্য ওরিয়ন গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান একম অ্যান্ড এসোসিয়েটস লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় কোম্পানি গঠন করে বেলহাসা। যৌথ মালিকানার কোম্পানির নাম দেয়া হয় বেলহাসা একম অ্যান্ড এসোসিয়েটস লিমিটেড। পরে আর্থিক বিবেচনায় বেলহাসা একম কনসোর্টিয়াম প্রকল্পটির কাজ পান। সেই প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ৯ই আগস্ট বেলহাসা বরাবর লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) ইস্যু করেন সিটি করপোরেশন। এমনকি নিয়ম অনুযায়ী কনসোর্টিয়াম অংশীদারদের সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কোম্পানি বেলহাসা একম অ্যান্ড এসোসিয়েটস লিমিটেড (এসপিভিসি) নামে কোম্পানি নিবন্ধিত হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে যাত্রাবাড়ী- গুলিস্তান প্রকল্পটি বেলহাসা একম অ্যান্ড এসোসিয়েটস সরকারের অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করে। দরপত্র দাখিল করে বেলহাসা দুবাই ও একম বাংলাদেশ নামে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় চুক্তি অনুযায়ী বেলহাসা ৬০ শতাংশ ও একম ৪০ শতাংশ বিডার ছিলেন। কিন্তু দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুবাইভিত্তিক কোম্পানি বেলহাসা প্রধান বিডার হিসাবে অংশ নিলেও ওবায়দুল করিম একম ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে নিজে ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে শেয়ার হোল্ডার করে দেন। অথচ কাগজপত্র বলছে, শুরুতে দুবাইয়ের নাগরিক শেখ মাজেদ আহমেদ সাইফ বেলহাসা কোম্পানির ৮০ শতাংশ ও ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যরা মাত্র ২০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ২০০৫ সালের ২০শে মার্চ দুবাই নাগরিক শেখ মাজেদ আহমেদ সাইফ বেলহাসার স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানিটির রেজিস্ট্রশন নিজের নামে করে নেন ওবায়দুল করিম। অথচ দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদনে কোথাও ওবায়দুল করিম, ছেলে সালমান করিম ও মেয়ের জামাই মেহেদী হাসানের নাম ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে বেলহাসাকে বের করে দিয়ে সম্পূর্ণ কোম্পানি দখল করে নেয় ওবায়দুল করিম পরিবার। ভুয়া চুক্তিপত্রের মাধ্যমে বেলহাসার ৮০ শতাংশ শেয়ার থেকে মাত্র ৫ শতাংশ শেয়ার রেখে বাকি শেয়ার নিজের একম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে লিখে নেন। পরে বেলহাসা পরিবার দাবি করেন করিম পরিবারের সঙ্গে তাদের কোনো চুক্তি হয়নি। যে কাগজপত্র দেখানো হয়েছে তা ভুয়া।

অবৈধভাবে বোর্ড মিটিং দেখিয়ে ওবায়দুল করিমের ছেলে সালমান করিম ও জামাই মেহেদী হাসানের নামে কোম্পানির সব শেয়ার স্থানান্তর করা হয়। একইভাবে দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান বেলহাসার শেয়ারও জাল-জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেয়া হয় ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে। এমনকি যৌথ বিনিয়োগকারী কোম্পানির নাম পাল্টে নতুন নাম দেয়া হয় ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। পরে যৌথ কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কর্তৃত্ব নিয়ে নেন ওবায়দুল করিম। এই সময়ের মধ্যে বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানির ৬০০ কোটি টাকা পর্যায়ক্রমে ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়। তখন বিদেশি কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন ওবায়দুল করিম। এই জাল- জালিয়াতি ও অবৈধভাবে কোম্পানি দখলের সমস্ত কাগজপত্র মানবজমিন-এর হাতে সংরক্ষিত আছে। পরবর্তীতে বিদেশি কোম্পানি বেলহাসা ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি করে কোম্পানি দখলের অভিযোগে আদালতে মামলা করেন। মামলা নং ৪৯৬/১০। তবে ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং ওবায়দুল করিম কৌশলে বেলহাসাকে ঠেকাতে তাদের নামে ২০১০ সালের ১৬ই আগস্ট একটি মামলা করেন। মামলা নং ৩৪৯/১০। ওই মামলায় বলা হয় বেলহাসা এই প্রকল্প কোম্পানির বেলহাসা-একম জেভি (পরিবর্তিত নাম) এর কেউ না। এমনকি বেলহাসা যাতে প্রতিকার চেয়ে সরকারের কাছে কোনো চিঠিপত্র দিতে না পারে এজন্য আদালত থেকে একটি নিষেধাজ্ঞা নেয়া হয়। উপায়ন্ত না পেয়ে বেলহাসার মালিক মাজেদ আহমেদ বেলহাসা জুবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া নামের এক আইনজীবীকে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়েন। 

যেভাবে দখল একম ইঞ্জিনিয়ারিং: শুধু বেলহাসা নয়, প্রতারণা করে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান একম ইঞ্জিনিয়ারিং দখল করেন ওবায়দুল করিম ও তার ছেলে সালমান করিম। নথিপত্র থেকে জানা গেছে, ২০০২ সালে বিএনপি’র নেতা শাহ্‌ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের ছোট ভাই শাহ একেএম মুজিবুল হক ও ওবায়দুল করিম যৌথভাবে একম ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করেন। কোম্পানিটির অংশীদারিত্বের শেয়ার ছিল ওবায়দুল করিম ৫০ শতাংশ, একেএম মুজিবুল হক ৪০ শতাংশ ও রবিউল ইসলাম ১০ শতাংশ। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, ইমারত ও বিল্ডিং নির্মাণ কাজ করতো। প্রতিষ্ঠানটি মতিঝিল সিটি সেন্টার, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টার, সোনারগাঁও হোটেল সংস্কার, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণ করেন। ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তারা সফলতার সঙ্গে কাজ করেছে। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বদলে যান ওবায়দুল করিম। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কোম্পানিটির অন্যতম অংশীদার মুজিবুল হককে বিএনপি নেতার ভাই পরিচয় দিয়ে নানা মুখরোচক খবর প্রচার করতে থাকেন। পরে কৌশলে মুজিবুলকে সন্ত্রাসী মদতদাতা বিএনপি নেতা সাজিয়ে ভুয়া এজিএম ডেকে তার ৪০ শতাংশ শেয়ার প্রতারণা করে লিখে নেন ওবায়দুল করিম। এ বিষয়ে মুজিবুল হক ২০১০ সালের ২৫শে এপ্রিল গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডি নং-২৩৮৮/১০। পরে মামলা করতে গেলেও তার মামলা নেয়া হয়নি। এরপরে উচ্চ আদালতে রিট করেও কোম্পানির শেয়ার রক্ষা করতে পারেননি মুজিবুল হক। যার হাইকোর্ট রিট পিটিশন নং- ১৭১/১০। অভিযোগ রয়েছে, ওবায়দুল করিম ভুক্তভোগী মুজিবুল হককে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের দিয়ে একাধিকবার তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছেন। এক পর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন। 

সিটি সেন্টার নির্মাণে ভয়ঙ্কর প্রতারণা: ওবায়দুল করিম ও তার পরিবারের সদস্যরা শুধুমাত্র যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওয়ার নির্মাণ প্রকল্পেই নয়, অনিময় করে বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেছেন সিটি সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পেও। এমন কিছু তথ্য-প্রমাণ মানবজমিন-এর হাতে এসেছে। ঢাকার মতিঝিলে ৪১তলা বিশিষ্ট সিটি সেন্টার নির্মাণের সময় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে লিড কোম্পানি ছিল বেলহাসা। সে সময় বেলহাসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদ আহমেদ বেলহাসার সই জাল করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে পরে সেই ঋণ আর পরিশোধ করেনি ওরিয়ন গ্রুপ। সিটি সেন্টার নির্মাণের জন্য ২০০৩ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি হয় দুবাই-বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান বেলহাসা একম জেভি লিমিটেডের। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটিতে বেলহাসা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেয়ার ছিল ৬০ শতাংশ আর একম ইঞ্জিনিয়ারিং এর ৪০ শতাংশ। আবার একম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিকানায় ওরিয়নের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের সঙ্গে ব্যবসায়ী মুজিবুল হকের ৪০ শতাংশ শেয়ার ছিল। তবে পরবর্তীতে বেলহাসা কিংবা মুজিবুল হক কাউকে না জানিয়ে ওবায়দুল করিম জালিয়াতি করে ওরিয়ন ল্যাবরেটরিজের নামে শেয়ার হস্তান্তর করে নেন। চুক্তি ও ব্যাংকিং কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বেলহাসা ও একম জেভি লিমিটেডের নামে সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) থেকে ৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সিটি সেন্টারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরে শেয়ারধারীদের অজ্ঞাতে ওবায়দুল করিম একাই সিটি সেন্টারের ২২টি ফ্লোর বিক্রি করেন প্রায় ৪৫০ কোটি টাকায়, যার বড় একটি অংশ অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। ভবনটি নির্মাণের পর ২০১৭ সালে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসআইবিএল থেকে দ্বিতীয় দফায় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির নামে আবারো ৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। যা আর পরিশোধ করা হয়নি। এ কারণে চলতি বছরের ৩১শে জুলাই পর্যন্ত বেলহাসা একম জেভি’র খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকারও বেশি। বেলহাসার শেয়ারের বিপরীতে ঋণ ও সিআইবিতে মালিকের নাম দেখে হতবাক দুবাইয়ের কোটিপতি ব্যবসায়ী মাজেদ আহমদ বেলহাসাও। ব্যাংক ঋণ নেয়ার সময় বেলহাসার এমডি’র সই জাল করা হয়। এজন্য বেলহাসাও এখন বাংলাদেশে ঋণখেলাপি। এদিকে অন্য শেয়ারধারীদের বঞ্চিত করে ওবায়দুল করিম একাই সিটি সেন্টারটি জবরদখল করে রেখেছেন। 

যা বলছেন বেলহাসার আইনজীবী: বেলহাসার হয়ে আইনি লড়াই করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, একমের নাম দেয়া হয় ওরিয়ন গ্রুপ, যেখানে একমের মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপ বলতে কোনো শব্দও নেই। তারা বেলহাসার সব সিগনেচার জাল করেছে। একমেরও সব সিগনেচার জাল করেছে। জাল করে ওবায়দুল করিমের ছেলে সালমান করিম ও তার মেয়ের জামাই মেহেদী হাসানকে যুক্ত করেছে। পরে কোম্পানিটা পুরোপুরি নিজে দখল করেছে। বেলহাসার যে শেয়ার হোল্ডিং সেটা মাত্র ৬ শতাংশ করেছে। ৯৫ শতাংশ ওবায়দুল করিম ওরিয়নের সঙ্গে মিলে দখল করে ফেলেছেন। এখানে জালিয়াতি হয়েছে, ক্রিমিনাল অফেন্স হয়েছে, সিভিল অফেন্স হয়েছে। দখল ও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানতে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিমের মুঠোফোনে ফোন দেয়া হলে তাকে পাওয়া যায়নি। ক্ষুদে বার্তা দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
bacan4d
bacan4d