Science & Tech

একটি বুগাটি গাড়ি, একজন ফার্স্ট লেডি ও মার্কিন নির্বাচন ঘিরে সত্যের মতো ভুয়া তথ্য

ইউক্রেনের ফার্স্ট লেডি ওলেনা জেলেনস্কা জুন মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয় উদ্‌যাপন উপলক্ষে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে যাওয়ার সময় বুগাটি ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনেন। ওলেনা ৪৫ লাখ ইউরোর বিনিময়ে বুগাটি ট্যুরবিলন স্পোর্টস কার কেনেন। এ খবর ছিড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউক্রেনে পাঠানো সামরিক সহায়তার অর্থ দিয়ে বুগাটির এই গাড়ি সংগ্রহ করেছেন বলেও ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে। বিষয়টি পুরোপুরি ভুয়া। অচেনা এক ফরাসি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় এই ভুয়া তথ্য।

বুগাটি গাড়ি বিক্রির ভূযা রসিদের ছবি

একজন সত্য তথ্য প্রকাশকারী বা হুইসেলব্লোয়ারের মাধ্যমে অদ্ভুতভাবে সম্পাদিত ভিডিওতে গাড়ি কেনার গল্প উপস্থাপন করা হয়। পরে বিশ্লেষকেরা ভিডিওটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন। ফরাসি গাড়ি নির্মাতা বুগাটি বিষয়টি ‘ভুয়া’ বলে অভিহিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটি মিথ্যা গল্পের গল্পকারদের জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এসব আইনি পদক্ষেপের ঘোষণার আগেই ওলেনার বুগাটি কেনার মিথ্যা গল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এক্সসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে গাড়ি কেনার ভুয়া গল্প, ছবি ও গাড়ি বিক্রির রসিদের ছবি প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক রুশপন্থী এক কর্মী জ্যাকসন হিঙ্কেল এক্সে পোস্টটি শেয়ার করলে ৬৫ লাখের বেশি ব্যবহারকারী তা দেখেন। বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে ভুয়া গল্পটি প্রকাশ করা হলে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী তা দেখেন। এই ভুয়া সংবাদের সূত্র ছিল একটি রুশ ওয়েবসাইট। বিবিসি ভেরিফাই গত বছর এই সংবাদের বিশ্লেষণ প্রথম প্রকাশ করে। বিশ্লেষণে বলা হয়, মার্কিন সরকারের ভাবমূর্তি ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অংশ হিসেবে এই ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়।

আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখতে পাবে সারা বিশ্ব। নির্বাচনে ভোটারদের মনোযোগ টানতে নানা রকমের প্রচারণা এরই মধ্যে চোখে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রচারণার নানা অনুষঙ্গে মার্কিন নির্বাচন এখন আলোচনার তুঙ্গে। নির্বাচনের প্রচারণার অংশ হিসেবে এক দশক ধরে ভুয়া তথ্য বড় সংকট তৈরি করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইসহ নানা প্রযুক্তি দিয়ে ভুল, ভুয়া বা বানোয়াট, অর্ধসত্য, অপতথ্য ছড়িয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার নজির আছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি জন মার্ক ডুগান নামের এক সাবেক মার্কিন পুলিশ সদস্যের তথ্য প্রকাশ করেছে। জন এখন রাশিয়ার মস্কোতে থাকেন। বিবিসির ভাষ্যে, জন এআই–নির্ভর ভুয়া সংবাদমাধ্যম পরিচালনা করেন।

ভুয়া তথ্যের কেন্দ্রে রাশিয়া

রাশিয়াভিত্তিক বিভিন্ন ওয়েবসাইট যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সংবাদপত্রের মতো ছদ্মবেশ ধারণ করে নানা তথ্য প্রচার করছে। এআই ব্যবহার করে ভুয়া ও বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করে মার্কিন নির্বাচনকে লক্ষ্য করে কাজ করা হচ্ছে। বিবিসির এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। জন ফ্লোরিডায় পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। রাশিয়ার মস্কো থেকে বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নির্বাচনকেন্দ্রিক ভুয়া সংবাদ তৈরি ও প্রচারে কাজ করছেন।

ষড়যন্ত্রের আভাস

মার্কিন ভোটারদের প্রভাবিত করতে এরই মধ্যে কয়েক ডজন ভুয়া, বানোয়াট সংবাদ ও গল্প ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। এত জোরালোভাবে বিভিন্ন গল্পের ফাঁদ পাতা হচ্ছে যে অনেক প্রভাবশালী মার্কিন কংগ্রেস সদস্য বিভিন্ন ভুয়া তথ্য প্রচার করেছেন। মার্কিন রাজনীতির ওপর প্রভাব তৈরি করতে আরও একটি সংবাদ এ বছর আলোচনায় আসে। বছরের শুরুতে ‘দ্য হিউস্টন পোস্ট’ ওয়েবসাইটে বলা হয়, এফবিআই অবৈধভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফ্লোরিডা রিসোর্টে আড়ি পাতে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও নির্বাচনের প্রচারণায় বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি সংবাদে প্রকাশ করা হয়। ট্রাম্পকে দুর্বল করার জন্য নোংরা কৌশলের কথাও প্রকাশ করা হয়। এফবিআইকে ট্রাম্প অভিযুক্ত করেন। এই ভুয়া সংবাদের উৎসস্থল ছিল রাশিয়া। যদিও তেমন কোনো শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারপরও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এসব ভুয়া তথ্য ও সংবাদকেন্দ্রিক ওয়েবসাইট রাশিয়া থেকে পরিচালিত হয়। পশ্চিমা দুনিয়ায় বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য এসব কাজ রুশ সরকারের ক্রেমলিন সদর দপ্তর–সমর্থিত বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে।
প্রচারণা আরও সৃজনশীল, এআইয়ের চমক দেখা যাচ্ছে

২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনের প্রচারণায় বিভ্রান্তিমূলক ও ভুয়া খবর আলোচনায় ছিল। এবার তাই ভুয়া তথ্য প্রকাশে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে বেশি সৃজনশীলতা দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার সিকিউরিটি ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সির সাবেক পরিচালক ক্রিস ক্রেবস বলেন, ‘রাশিয়া ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে প্রভাব রাখতে চাইছে। আমরা ইতিমধ্যেই নমুনা দেখছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় বিতর্কিত বিষয় প্রবেশ করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিবিসি ভেরিফাই জানিয়েছে, হাজার হাজার সংবাদ তৈরি করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হচ্ছে। কয়েক ডজন সাইটে এসব সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এসব সংবাদপত্রের নাম যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানের নামে। যেমন ‘হিউস্টন পোস্ট’, ‘শিকাগো ক্রিয়ার’, ‘বোস্টন টাইমস’, ‘ডিসি উইকলি’সহ ইত্যাদি নাম দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় সত্যিকারের সংবাদপত্রের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে, যারা হয়তো এখন বিলুপ্ত। শিকাগো ক্রনিকল বেশ পুরোনো সংবাদপত্র হলেও নির্বাচনের জন্য ভুয়া তথ্য প্রকাশে এর নাম ব্যবহার করছে আক্রমণকারীরা। যদিও এই সাইটের বেশির ভাগ সংবাদ ভুয়া নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অন্যান্য সাইট থেকে সংবাদ প্রকাশ করে সাইটটি। এ ধরনের সাইটে ‘রিপাবলিকান’, ‘ট্রাম্প’, ‘ডিস্যান্টিস’ ও ‘রাশিয়া ভালো’—এমন শব্দযুক্ত সংবাদ দেখা যায়। ‘ডেমোক্র্যাট’, ‘বাইডেন’, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ খারাপ’ শব্দও দেখা যায়। অনেক সময় সংবাদ প্রকাশের সময় এআই দিয়ে তৈরির নির্দেশনাও সরাসরি প্রকাশ করতে দেখা যায় এসব সাইটে। সত্যিকারের সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমে এমনটা দেখা যাবে না।

বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্টের চেষ্টা

শুধু ভুয়া তথ্য নয়, সত্যিকারের মানুষের ছবি ও তথ্য নকল করা হচ্ছে। মার্কিন লেখক জুডি ব্যাটালিয়নের ছবি ও নাম জেসিকা ডেভলিন হিসেবে বিভিন্ন সাইটে দেখা যায়। তাঁর নকল নামে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করতে দেখা যায়। আরেকটি ভুয়া সংবাদ দেখা যায় ইউক্রেনের ফার্স্ট লেডির নিউইয়র্ক শহরে ভ্রমণ নিয়ে। সেখানে তিনি একটি গয়নার দোকানে বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন। সেই ভুয়া সংবাদ ইউটিউবের মাধ্যমে লাখো মানুষের সামনে পৌঁছে যায়। এ ধরনের অনেক সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। ভুয়া তথ্য প্রকাশ করে, এমন ১২০টি ওয়েবসাইটের খোঁজ মেলে গত মে মাসে। রাশিয়া থেকে এসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভুল তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া আরও ১৭০টি ওয়েবসাইটের কথা জানা যায়, যারা দিনরাত মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর কাজ করছে। এ ধরনের ওয়েবসাইটের তথ্য আবার রুশ গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে হরহামেশাই বলে অভিযোগ আছে। ভুয়া সংবাদকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য স্বাধীন সাংবাদিক, ফ্রিল্যান্সার বা হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ভিডিও ইউটিউবে লাখ লাখ ভিউ নিয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে। এসব ভিডিওতে হরহামেশাই এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও ও কণ্ঠস্বর ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ভুয়া তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করে বিবিসি। প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পর হুবহু বিবিসির অনুকরণে নকল ওয়েবসাইটে ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করতে দেখা যায়। মাইক্রোসফট ডিজিটাল থ্রেট অ্যানালাইসিস সেন্টারের প্রধান ক্লিন্ট ওয়াটস বলেন, ভুয়া তথ্যের পরিমাণ ও রাশিয়াভিত্তিক ক্রমবর্ধমান আক্রমণ নভেম্বরের নির্বাচনে সমস্যা তৈরি করতে পারে। তথ্যের মহাসাগরে এসব ভুয়া তথ্য বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d