Science & Tech

একটু একটু করে স্বর্ণ সঞ্চয় করা যায় যে অ্যাপে

যুগের পর যুগ মানুষের সঞ্চয়ের কেন্দ্রে আছে স্বর্ণ ও জমি। শহর তো বটেই গ্রামীণ জনপদের মানুষ টাকা জমিয়ে, ফসল বিক্রি করে স্বর্ণ কেনেন। স্বর্ণ কেনার মাধ্যমে সঞ্চয়কে নতুন মাত্রা দিতে ২০২২ সালে তিন উদ্যোক্তা চালু করেন গোল্ড কিনেন নামের একটি অ্যাপ। এখন অ্যাপের মাধ্যমেই মুঠোফোন থেকে স্বর্ণ সঞ্চয় করতে পারছেন যে কেউ। আর তা অল্প টাকায় একটু একটু করে। ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে যে কোনো পরিমাণ টাকা জমার বিনিময়ে গ্রাহকের নামে স্বর্ণ সঞ্চয় করা যাচ্ছে এই অ্যাপের মাধ্যমে।

শুরুর গল্প

সবার জন্য স্বর্ণ জমানো সহজ, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও ঝামেলাহীন করতে দেশের অ্যাপ গোল্ড কিনেনের এই উদ্যোগ। এ অ্যাপটির মাধ্যমে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে যে কোনো পরিমাণ টাকার বিনিময়ে স্বর্ণ সঞ্চয়ের সুযোগ পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। গোল্ড কিনেনের তিন উদ্যোক্তা রাফাতুল বারি লাবিব, আতেফ হাসান ও কামরান সঞ্জয় রহমান।

১৮ বছরের ব্যাংকিং পেশায় অভিজ্ঞ কামরান সঞ্জয় রহমান। তিনি গোল্ড কিনেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সঞ্জয় নব্বই দশকে রক ব্যান্ডে যুক্ত ছিলেন। দেশ-বিদেশের অনেক ব্যাংকে কাজ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে। ২০২১ সালে লাবিবের মাথায় স্বর্ণ সঞ্চয়ের এই অ‍্যাপের ধারণাটি প্রথম আসে। এরপর একদিন চায়ের আড্ডায় লাবিব তাঁর বন্ধু আতেফকে এই ধারণার কথা শোনান। তখন দুই বন্ধু আতেফ ও লাবিব নতুন এই ধারণা নিয়ে পরামর্শ করেন সঞ্জয়ের সঙ্গে। এরপর তারা এটাকে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা ও কার্যক্রম শুরু করেন। লাবিবের ছোট খালু হচ্ছের কামরান সঞ্জয়। ১২ বছর বয়স থেকে লাবিব তাঁর কাছ থেকে নিজের জীবনের যত পরিকল্পনা, ব্যবসার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজেক্ট থেকে শুরু করে করপোরেট দুনিয়ার সব শলাপরামর্শ নেন। আতেফ পড়েছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে, লাবিব পড়েছেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে।

গোল্ড কিনেন অ্যাপের উদ্যোক্তারা

গোল্ড কিনেন অ্যাপের উদ্যোক্তারাসংগৃহীত

যেভাবে এল গোল্ড কিনেনের ধারণা

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি শেষ করে দুজন যোগ দেন দেশের অন্যতম মুঠোফোনে অর্থ আদান-প্রদানের একটি প্রতিষ্ঠানে। আতেফ বলেন, ‘আমরা সঞ্জয় কামরান খালুর সঙ্গে আলোচনা করে সম্মিলিতভাবে গোল্ড কিনেন নিয়ে একসাথে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেই। আমরা শুরুতে বেশ সময় দেই বাজার বোঝার জন্য, যেহেতু এটা  সম্পূর্ণ নতুন ধরণের একটি উদ্যোগ আমরা যথাযথ অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এগিয়ে যাই এই আইডিয়াটি বাস্তবায়নের পথে। আমাদের দেশের মানুষ স্বর্ণ কেনে সঞ্চয়ের জন্য। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই দোকানে যেতে চান না। তাই অ্যাপের মাধ্যমে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন বাজুসের নির্ধারিত দামে কেনা-বেচা ও উত্তোলনের সুযোগ দিচ্ছি আমরা।’

২০২২ সালের জানুয়ারিতে যাত্রা শুরু করে গোল্ড কিনেন। মুঠোফোনে অ্যাপ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ শুরু করে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে। বাণিজ্যিকভাবে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে কাজ শুরু করে। কামরান সঞ্জয় রহমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, রাফাতুল বারি লাবিব প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ও আতেফ হাসান প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে ৪১ জন কর্মী কাজ করছেন। শুরুর দিকে বাজার বিশ্লেষণ করতে ভারত, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাতসহ অনেক দেশের বাজার সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। প্রবাসী বাংলাদেশি ও বাংলাদেশের মানুষের স্বর্ণ কেনার আগ্রহ ও প্রযুক্তি নির্ভরতা সম্পর্কে জানতে বেশ সময় দেন তাঁরা।

জেন–জি থেকে শুরু করে সবার মধ্যে সাড়া

অ্যাপনির্ভর স্বর্ণ সঞ্চয়ের সেবা নিয়ে কাজ শুরুর পরে গ্রাহকদের বেশ সাড়া পান তিন উদ্যোক্তা। রাফাতুল বলেন, ‘গোল্ড কিনেন অ‍্যাপে এখন ১ লাখ ৮০ হাজার ব্যবহারকারী রয়েছে। দেখা যায়, বিশেষ করে ২৮ থেকে ৪৫ বছরের গ্রাহকেরাই স্বর্ণ সঞ্চয় করছেন। আমরা চাই যাদের বয়স কম, দেশের আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে একটু একটু করে স্বর্ণ সঞ্চয়ের অভ্যাস শুরু করুন। স্বর্ণ এমন একটি বস্তু যার আর্থিক মূল্য সব সময় থাকবে, এ কারণে স্বর্ণে বিনিয়োগ নিরাপদ। অ‍্যাপে “অটো গোল্ড সেভ” পরিষেবার সঙ্গে প্রতি মাসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত তারিখে স্বর্ণ সঞ্চয় করা যাচ্ছে। সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা থেকে ৫০০০০ টাকা পর্যন্ত, ৩, ৬, এবং ১২ মাস মেয়াদে স্বর্ণ সঞ্চয়ের সুযোগ আছে।’

যেভাবে কাজ করে গোল্ড কিনেন

অনলাইনের মাধ্যমে যেকেউ গোল্ড কিনেন অ্যাপের মাধ্যমে সঞ্চয় শুরু করতে পারেন। আতেফ বলেন, আমরা অন্য সব জুয়েলার্সের মতোই নিবন্ধিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী। অনলাইন থেকে অ্যাপ নামিয়ে তিনটি ধাপ অনুসরণ করে অ্যাপে নিবন্ধন করতে হবে। আমাদের অ্যাপ দেশের বাইরে ব্যবহারের সুযোগ নেই। রেজিস্ট্রেশন শেষেই স্বর্ণ ক্রয় করতে পারবেন গ্রাহক। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে স্বর্ণ ক্রয় করতে পারেন। অ্যাপের মাধ্যমে কেনা স্বর্ণ আমাদের বিমাকৃত ভল্টে সংরক্ষণ করা হয়। আমরা বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধনভুক্ত স্বর্ণ ডিলার।  প্রচলিত শপিং মল-দোকাননির্ভর কেনাবেচা যেভাবে কাজ করে সেভাবেই আমরা অনলাইনে কাজ করছি। এই অ্যাপের মাধ্যমে স্বর্ণ বিক্রয় করতে পারেন। বিক্রীত স্বর্ণের টাকা মোবাইল ওয়ালেট বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নেওয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া যেকেউ অ্যাপ থেকে কেনা স্বর্ণ উত্তোলন করতে পারেন কয়েন অথবা বার আকারে। গ্রাহকেরা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অন্তুর্ভুক্ত এলাকায় বিমাকৃত ডেলিভারির মাধ্যমে স্বর্ণ নিতে পারেন। সারা বাংলাদেশের সব জেলায় পিক-আপ পয়েন্টের মাধ্যমে স্বর্ণ কয়েন ও বার উত্তোলন করতে পারেন। গ্রাহকেরা গোল্ড কিনেন থেকে ২২ ক্যারাটের হলমার্ক প্রত্যয়িত স্বর্ণের কয়েন ও বার কিনতে পারছেন। প্রতিদিনের বাজারমূল্যের ওপর ভিত্তি করে স্বর্ণ কেনা বা বিক্রির সুযোগ আছে অ্যাপে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে উদ্যোক্তারা জানান, তাঁরা চান ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বেশি বেশি সঞ্চয়ের দিকে আগ্রহী হোক। এ জন্য গ্রাহকদের সঞ্চয় ভাবনা উন্নত করার জন্য কাজ করছি আমরা।  

গোল্ড কিনেনের মাধ্যমে সঞ্চয় করেন ফারহান কুরেশী। তিনি বলেন, আমার মেয়ের নাম ফালাক। ফালাকের জন্য আমি স্বর্ণ সঞ্চয় করছি। গোল্ড কিনেনের মাধ্যমে সহজে অ্যাপ দিয়েই স্বর্ণ সঞ্চয় করা যাচ্ছে। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে অ্যাপের মাধ্যমে সঞ্চয় করছি।

৩৩ বছরের তরুণ উদ্যোক্তা রাকিন এস কবির বলেন, আমি ২০২৩ সাল থেকে গোল্ড কিনেনের মাধ্যমে স্বর্ণ সঞ্চয় করছি। এটা খুবই নিরাপদ অ্যাপ, কোনভাবে পাসওয়ার্ড চুরি বা হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি নেই। আমি নিজের জন্য সঞ্চয় শুরু করি।

ঢাকায় বাস করেন উন্নয়নকর্মী ফারিয়া জাহান। তিনি বলেন, আমি আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে প্রথম অ্যাপটির কথা শুনি। সাধারণভাবে স্বর্ণ কেনা-বেচা অনেক কঠিন। অ্যাপের মাধ্যমে এই সুযোগ পেয়ে কিছুটা রিসার্চ করেই বিনিয়োগ করা শুরু করি। এখন নিয়মিত অ্যাপের মাধ্যমে স্বর্ণ কিনি, স্বর্ণ বার সংগ্রহ করতে পারছি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button