Bangladesh

এক আদেশে ৩২৭ এনজিওর ১০ হাজার কর্মী বেকার

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সহযোগিতা কার্যক্রম স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা ইউএসএআইডি। গত ২৫ জানুয়ারি দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এসংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২১ জানুয়ারি এ বিষয়ে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এরপর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সহায়তা ছাড়া ইউএসএআইডির বাকি সব কার্যক্রম আপাতত তিন মাসের জন্য গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এতে বাংলাদেশের প্রায় ৩২৭ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ১০ হাজার কর্মী বেকার হয়ে পড়েছেন। হঠাৎ চাকরি হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন তাঁরা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশসহ একাধিক সহায়তা কার্যক্রম ঝুঁকিতে।

এনজিওবিষয়ক ব্যুরো সূত্র জানায়, দেশের ২৭৪টি এনজিও বিভিন্ন দেশ থেকে তহবিল (ফান্ড) পেয়ে থাকে। এর মধ্যে ইউএসএআইডির ফান্ড পেত ৮৭টি এনজিও। এসব ডোনার এজেন্সির (দাতা সংস্থা) মাধ্যমে দেশে প্রায় ২৪০টি এনজিওর প্রকল্প পরিচালিত হতো। সেই হিসাবে ৩২৭টি এনজিওর ইউএসএআইডির ফান্ড স্থগিত হয়েছে।

এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৮৭টি ডোনার এজেন্সি ইউএসএআইডির ফান্ড নিত।

তারা অন্যান্য লোকাল এনজিওর মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করত। আপাতত তাদের তিন মাসের ফান্ড স্থগিত করা হয়েছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এতে বিপুলসংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। সেবাগ্রহীতারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’

এনজিওসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ৩২৭টি এনজিওর ইউএসএআইডির ফান্ডে ১০ হাজারের বেশি কর্মী সরাসরি চাকরি করতেন, যাঁদের সবাই বেকার হয়েছেন। এসব কর্মীর বেশির ভাগই বিভিন্ন প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করায় তাঁরা কোনো আর্থিক সুবিধাও পাননি। ফলে হঠাৎ করে চাকরি হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে উত্কণ্ঠার মধ্যে দিন কাটছে তাঁদের। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা, পরিবেশ, জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও গতি হারিয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে লাখ লাখ সুবিধাবঞ্চিত মানুষ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউএসএআইডির ফান্ড বন্ধের ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে। তবে আমাদের দেশে উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রভাব বেশি। একই সঙ্গে বিশ্বে কিন্তু বিকল্প অর্থায়নের উৎসও কমে যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো অন্তর্মুখী হচ্ছে। বৈশ্বিক অবস্থাও ইতিবাচক নয়। এভাবে চলতে থাকলে সুবিধাবঞ্চিতরা আরো বঞ্চিত হবে।’

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মূলত একটি গবেষণা সংস্থা। এই সংস্থায় ইউএসএআইডির অর্থায়নে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তারা এক হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুতির চিঠি দিয়েছে। স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের তিন মাসের সময় দিয়ে চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর অস্থায়ীদের তাত্ক্ষণিক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আইসিডিডিআরবির কমিউনিকেশনস বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প ও গবেষণাগুলো পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত স্থগিত রেখেছি।‌ আমরা আশাবাদী, পুনরায় আমাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারব।’

নাম প্রকাশ না করে ইএসএআইডি হোস্ট অ্যান্ড ইমপ্যাক্টেড কমিউনিটি রেজিল্যান্স অ্যাকটিভিটি, বাংলাদেশ নামের একটি এনজিওর কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি অন্য একটি স্থায়ী চাকরি ছেড়ে মাত্র তিন মাস আগে কিছুটা সিনিয়র পজিশনে এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। নতুন প্রতিষ্ঠানে আমার চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি। এ অবস্থায় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমার চাকরি আর থাকছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে অথই সাগরে পড়ে গেলাম।’

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশীলনের সহকারী পরিচালক শাহিনা পারভীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউএসএআইডির ফান্ডে আমাদের একটি প্রজেক্ট চলত। সেখানে ১৯ জন কর্মী ছিলেন। তাঁদের সবাইকে বাদ দিতে হয়েছে। তাঁদের যে অন্য কোনো প্রজেক্টে অন্তর্ভুক্ত করব, সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ গ্লোবালি ফান্ড ক্রাইসিস চলছে।’

ইউথ রাইজের কর্মকর্তা গৌতম ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এই প্রতিষ্ঠানে গত ২৩ জানুয়ারি যোগ দিয়েছি। এর দুই দিনের মাথায়ই ফান্ড বন্ধের খবর পেলাম। এই প্রজেক্টে ২০ জনের মতো কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে ১২ জনের তাত্ক্ষণিকভাবে চাকরি গেছে। আর আমরা আটজন ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বেতন পাব।’

কর্মসূচির পরিধি ও কর্মীদের বিপুল সংখ্যার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি ও অলাভজনক উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে পরিচিত ব্র্যাক। বাংলাদেশভিত্তিক সংস্থাটির কাজ রয়েছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে। ইউএসএআইডির ফান্ড বন্ধ ঘোষণার পর বাংলাদেশসহ চারটি দেশে ৯টি কর্মসূচি স্থগিত করেছে ব্র্যাক।

নাম প্রকাশ না করে একটি এনজিওর প্রধান নির্বাহী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউএসএআইডির ফান্ড বন্ধের ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কর্মী ও সুবিধাভোগীরা। এর বাইরে যেসব গবেষণা কার্যক্রম চলত, সেগুলোর ক্ষতি হবে দীর্ঘমেয়াদি। তবে তিন মাস পর যদি ফান্ড চালুও হয়, তাহলে তা এক-তৃতীয়াংশে চলে আসবে। এতে আগে যদি সাতটি খাতে ফান্ডিং হতো, এখন সেটা দুটি খাতে চলে আসবে। এটা হলে অন্য ডোনাররাও একই পথ অনুসরণ করবে। এতে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রম বড় ধরনের বাধার মুখে পড়বে।’

গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক সেমিনারে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র নতুন যে অবস্থান নিয়েছে, তা পরিস্থিতি কঠিন করে তুলতে পারে। আশা করি রোহিঙ্গাদের জন্য তারা অর্থ সহায়তা বন্ধ করবে না। মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের ওপর আরো বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’

উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ করতে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড : বাংলাদেশসহ তিন দেশে উন্নয়ন কর্মসূচিতে সহায়তা বন্ধ করতে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড সরকার। অন্য দুটি দেশ হলো আলবেনিয়া ও জাম্বিয়া। গত ২৯ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম সুইস ইনফোর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক সহায়তার জন্য সুইস সরকার যে পরিমাণ অর্থ চেয়েছিল, তার চেয়ে কম অর্থ বরাদ্দ করেছে দেশটির পার্লামেন্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিন দেশে উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুইজারল্যান্ডের সরকার। সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি) ২০২৮ সালের পর বাংলাদেশ, আলবেনিয়া ও জাম্বিয়ায় দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন কর্মসূচি বন্ধ করে দেবে।

বাংলাদেশে ইউএসএআইডির অবদান : ইউএসএআইডি গত ৫০ বছরের বেশি সময় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ খাতে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। তাদের অনুদান পাওয়া অনেক এনজিও এবং সরকারি সংস্থা রয়েছে। ইউএসএআইডি গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশকে প্রায় ২০ কোটি ২২ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা দেওয়ার চুক্তি করে। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১-২৬ সালের জন্য বাংলাদেশ ও ইউএসএআইডির মধ্যে একটি নতুন ডিওএজি (ডেভেলপমেন্ট অবজেকটিভ গ্র্যান্ট অ্যাগ্রিমেন্ট) সই হয়। এর মাধ্যমে ৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ইউএসএআইডি।

ফান্ড বন্ধের প্রভাব : ইউএসএআইডির ফান্ড বন্ধের ফলে স্বাস্থ্য খাতে বড় প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বড় ঝুঁকিতে পড়বে। এতে এইচআইভি-এইডস, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ম্যালেরিয়া অপুষ্টিজনিত নানা সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

পরিবেশ ও জ্বালানি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা উন্নয়নে কাজ করার কথা বলছে ইউএসএআইডি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়তা করে। সব প্রকল্পই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়নেও সহায়তা করে তারা।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে ইউএসএআইডির কর্মসূচি পরিচালিত হতো। শিক্ষার্থীদের উন্নত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করে তারা। এসব প্রকল্প এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor