এক ডজন মামলার প্রস্তুতি দুদকের
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পুনর্গঠনের পরপরই নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হওয়া অনুসন্ধানগুলোর প্রতিবেদন দ্রুততার সঙ্গে জমা দিচ্ছেন। পাশাপাশি কমিশনের পক্ষ থেকে আইনবিধি মেনে দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার সিদ্ধান্ত দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, চলতি মাসেই আরও এক ডজনের বেশি সংখ্যক মামলা দায়েরের প্রস্তুতি রয়েছে দুদকের। এরই মধ্যে শেষ হওয়া অনুসন্ধান প্রতিবেদনগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার দায়ের হতে পারে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের বিরুদ্ধে মামলা। অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাটি দায়েরের প্রস্তুতি রয়েছে কমিশনের। এদিন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দাখিল করবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
আগামী রোববার দায়ের হতে পারে বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের বিরুদ্ধে মামলা। টিআর-কাবিখা প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান করেছে। এর আগে ২০২৩ সালে একই অভিযোগ উচ্চ আদালতের নির্দেশে নিষ্পত্তি করে দুদক। দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এমপি রিমনের বিরুদ্ধে আগের অনুসন্ধানটি গত বছর নিষ্পত্তি হয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে। আদালতেও প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে বলেও নিশ্চিত করেছেন একাধিক দুদক কর্মকর্তা। রোববার এমপি রিমনের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও সম্পদ বিবরণী জারি হতে পারে বলে জানা গেছে।
একই দিন আরও দু’টি মামলা হবে সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরীর বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় পটুয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দু’টি, ঢাকা-২ আসনের সাবেক এমপি কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একটি ও রাজশাহী-৫ আসনের সাবেক এমপি ডা. মনসুরের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
এ ছাড়া সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ওরফে বিপুর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করা হবে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, নসরুল হামিদ ও তার স্ত্রী সীমা হামিদ এবং ছেলে জারেফ হামিদের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করা হবে। অভিযোগ ও অনুসন্ধান সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে হরিলুটের অন্যতম উৎস ছিল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। তখন বিনা টেন্ডারে প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়। এসব উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে চুক্তি অনুযায়ী বছরের পর বছর সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এর সিংহভাগই গেছে নসরুল হামিদের পকেটে। দুদক সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে একটি কোম্পানি খুলে সেই কোম্পানির মাধ্যমে নসরুল হামিদের হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগও পাওয়া গেছে। এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকালে নসরুল হামিদ তার নিজের যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেন। পাঁচ বেডরুমের এই বাসার বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ১৭ হাজার ৪১৫ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য ৪২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যুক্তরাষ্ট্রে শরীফ হায়দার নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে নসরুল হামিদ তার স্ত্রী সীমা হামিদকে নিয়ে ‘পথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ট্রেড করপোরেশনের লাইসেন্স নেন। এই করপোরেশনের আওতায় মবিল গ্যাস স্টেশনসহ দেড় ডজনের মতো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ফ্লোরিডায় অবস্থিত ওই গ্যাস স্টেশনটি কেনা হয় কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়ে। শরীফ হায়দারের মাধ্যমেই হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেন নসরুল হামিদ।
দুদকের মামলা প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছেন যশোর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দু’টি মামলা হতে পারে। এ ছাড়া স্ত্রী-সন্তানদের বিরুদ্ধেও পৃথক একটি মামলা হতে পারে চলতি সপ্তাহে। জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক এই এমপি প্রার্থী হওয়ার সময়ই হলফনামায় সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। স্বপন ও তার নির্ভরশীল ব্যক্তিদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য হলফনামায় উল্লেখ করেননি। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি অর্থ পাচারের অভিযোগটিও খতিয়ে দেখছে দুদকের অনুসন্ধান দল।
শিগগিরই মামলা হওয়ার তালিকায় রয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামালের নাম। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ও শেয়ারবাজার কারসাজির অভিযোগে মামলার আসামি হতে পারেন তার স্ত্রী কাশমেরী কামাল এবং নাফিসা কামালও। দুদক সূত্রে জানা যায়, লোটাস কামাল নিজ নামে ঢাকার জোয়ার সাহারা, বাড্ডা এবং কুমিল্লায় জমি ক্রয়, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা, শেয়ারে বিনিয়োগ এবং সঞ্চয়পত্রে ২০ কোটি ৪৮ লাখ ২৫ হাজার ২০৬ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। লোটাস কামাল প্রপার্টিজ, অরবিটাল এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ, তার স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে কুমিল্লা, গুলশান ও বাড্ডাসহ বিভিন্ন জায়গায় জমি, প্লট ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া তার স্ত্রীর নামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা, শেয়ারে বিনিয়োগ এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ রয়েছে ৩৮ কোটি ৮৭ লাখ ৭৮ হাজার ৫০৬ টাকা। মোস্তফা কামাল ও তার স্ত্রী কাশমেরী কামালের নামে ১১১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা মূল্যের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। তাছাড়া এসব সম্পদের বাইরেও তার দেশে-বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলেও জানিয়েছে অনুসন্ধান দল।
এদিকে কমিশন গঠন হওয়ার পর প্রথম দিনেই ছয়টি মামলা করে দুদক। এ ছাড়া গত রোববার সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও ছাগলকাণ্ডে নাম আসা আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে সংস্থাটি। পাশাপাশি গত মঙ্গল ও বুধবার দুই দিনে ছয়টি মামলা করা হয়। এসব মামলার আসামির মধ্যে রয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুর রহমান চৌধুরী নওফেল, ডিবি’র সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম। এ ছাড়াও রয়েছেন ফেনী-২ আসনের সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী ও সাবেক ক্রিকেটার নাঈমুর রহমান দুর্জয়।
এ বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, মামলা একটি নিয়মিত কাজের প্রক্রিয়া। অনুসন্ধান শেষে তা যাচাই-বাছাই করে কমিশন অনুমোদন দিলেই মামলা দায়ের করা হয়। এ সপ্তাহে মোট কতোটি মামলা হবে- সে বিষয়টি এখনো জানি না।