এক-তৃতীয়াংশ কম গাড়ি চলছে হরতাল-অবরোধে
দেশের অর্থনীতিতে গতি জোগানো দূরপাল্লার পণ্য ও যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচল হরতাল-অবরোধে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। সরকারের সেতু কর্তৃপক্ষের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এ তথ্য মিলেছে। এতে স্পষ্ট, রাজনীতির কারণে গতি হারাচ্ছে অর্থনীতি। রাজধানীতে হরতাল-অবরোধ ঢিলেঢালা হলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকাতেও কমেছে যান চলাচল।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও সমমনা দলগুলো গত ২৯ অক্টোবর থেকে সপ্তাহে চার দিন হরতাল-অবরোধ দিচ্ছে। সেই দিন থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চার দিন হরতাল এবং ১৬ দিন অবরোধ ছিল। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে বিরোধী দলগুলোর হরতাল-অবরোধ শিগগির থামবে, এমন সম্ভাবনা নেই।
হরতাল-অবরোধের ২০ দিনে পদ্মা সেতুতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ কম যান চলাচল করেছে। যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতুতে হরতাল-অবরোধে যান চলাচল কম ছিল ৩০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচল কমেছে ৩৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সেতু কর্তৃপক্ষের অনিরীক্ষিত টোলের হিসাব বিশ্লেষণে এই তথ্য পেয়েছে সমকাল। টোল আদায়ও কমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
ঢাকা-চট্টগ্রাম পথের গাড়ি মেঘনা সেতু হয়ে চলাচল করে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) পরিচালিত এই সেতুতে যান চলাচলের পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে সওজ সূত্র জানিয়েছে, হরতাল ও অবরোধে গাড়ি চলাচল প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। অর্থাৎ দেশের অন্য অঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী আমদানি-রপ্তানির পণ্যবাহী যান স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম চলছে।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে পদ্মা সেতুতে দৈনিক গড়ে প্রায় ১৯ হাজার যানবাহন চলাচল করেছে। হরতাল-অবরোধে ২০ দিনে পদ্মা সেতু ব্যবহার করে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬২৪টি যানবাহন পারাপার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে দিনে ১২ হাজার ৫৮০টি গাড়ি চলেছে। হরতাল–অবরোধ ছিল না, এমন ২০ দিনে সেতু ব্যবহার করেছে তিন লাখ ৮০ হাজার ৫৭৫টি গাড়ি। গড়ে দৈনিক পারাপার হয়েছে ১৯ হাজার ২৮টি গাড়ি, যা এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের দৈনিক গড়ের প্রায় কাছাকাছি।
হরতাল-অবরোধের ২০ দিনে পদ্মা সেতু ব্যবহার করা যানবাহন থেকে টোল এসেছে ৩০ কোটি ৯৫ লাখ এক হাজার ১৫০ টাকা। দৈনিক গড় আদায় এক কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭ টাকা। গত ২২ থেকে ২৭ অক্টোবর এবং ৩০ অক্টোবর থেকে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচি ছিল না; এমন ২০ দিনে টোল আদায় হয়েছে ৪৭ কোটি ১৮ লাখ ৯৪ হাজার ৫০ টাকা। দিনে গড়ে দুই কোটি ৩৫ লাখ ৯৪ হাজার ৭০২ টাকা। অর্থাৎ হরতাল অবরোধে ৩৪ দশমিক ৪১ শতাংশ কমে টোল আদায় হয়েছে।
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার গাড়ি চলাচল করে পদ্মা সেতু হয়ে। হরতাল-অবরোধে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপর্ণ এই সেতুতে গাড়ির চেয়ে টোল আদায় কমে যাওয়ার হার বেশি হওয়ার ব্যাখ্যায় সেতু বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, এর মানে মোটরসাইকেলের মতো ছোট গাড়ি বেশি চলছে। সেগুলোতে টোলের হার কম। বাস ও ট্রাকের মতো বড় গাড়ি কম চলছে।
সেতু বিভাগের নিরীক্ষিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসে ২০৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা টোল আদায় হয়েছে পদ্মা সেতু থেকে। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে দুই কোটি ২৪ লাখ টাকা ৪৭ হাজার টাকা টোল আদায় হয় এ সেতু থেকে। এই হিসাবে টোল আদায় কমেছে ৩১ শতাংশ।
কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, পণ্যবাহী মালিক সমিতির তথ্যানুযায়ী, আগে তেজগাঁও থেকে দিনে পাঁচ হাজার ট্রিপ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেত। করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছরের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে পরিস্থিতি হয়েছে আরও খারাপ। এবার পণ্য পরিবহনের কোমর ভেঙে দিয়েছে হরতাল-অবরোধ।
সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার বলেন, মহাসড়কে ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ কারণে মালিকরা ভয়ে গাড়ি বের করে ননা। আবার গার্মেন্ট পণ্যের রপ্তানি কমেছে। সে কারণেও ট্রিপ কম। আমদানিতে কড়াকড়ির কারণেও ট্রিপ কমেছে।
তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের এজেন্সিগুলোর হিসাবে হরতাল-অবরোধের দিনে ৩০০ ট্রিপও হচ্ছে না। অথচ কয়েক মাস আগে হাজার ট্রিপ হতো। অর্থনৈতিক সংকটের আগে যখন আমদানি-রপ্তানি রমরমা ছিল, তখন সোম ও বৃহস্পতিবার পাঁচ হাজার পর্যন্ত ট্রিপ হতো। সমিতির দপ্তর সম্পাদক মো. স্বপন সমকালকে জানিয়েছেন, ট্রিপ না থাকায় টার্মিনালে ৭৬৯টি ট্রাক স্থায়ীভাবে পড়ে আছে।
সবচেয়ে বেশি যান চলাচল করে যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতুতে। হরতাল-অবরোধের ২০ দিনে সেতু দিয়ে পারাপার হয়েছে দুই লাখ ৭৯ হাজার ৩৭৫টি যানবাহন। দৈনিক গড়ে বঙ্গবন্ধু সেতুতে চলছে ১৩ হাজার ৯৬৮টি গাড়ি। তবে এ বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ২০ হাজার গাড়ি চলাচল করেছে। ২২ অক্টোবর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ ছিল না, এমন ২০ দিনে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়েছে চার লাখ চার হাজার ২৮টি যানবাহন। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে গাড়ি চলেছে ২০ হাজার ২০১টি।
হরতাল-অবরোধের ২০ দিনে টোল আদায় হয়েছে ২৪ কোটি ২৪ লাখ ৭১ হাজার ৫৮২ টাকা। গড়ে দৈনিক এক কোটি ২১ লাখ ২৩ হাজার ৫৮২ টাকা টোল আদায় হয়েছে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল আদায় হয়েছে ২১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। দৈনিক গড়ে আদায় এক কোটি ৭৮ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯৩ টাকা। অর্থাৎ উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলাকে দেশের মধ্যঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করা বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল কমেছে ৩২ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
গত ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর-ফার্মগেট অংশ উদ্বোধন করেন। পরদিন থেকে যান চলাচল করছে উড়াল সড়কটিতে। ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলগুলোর মহাসমাবেশের আগের দিন পর্যন্ত প্রথম ২৫ দিনে গড়ে প্রায় ৩৩ হাজার গাড়ি চলাচল করেছে।
রাজধানীতে হরতাল-অবরোধের প্রভাব নেই বলে দাবি করা হলেও পরিসংখ্যান বলছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও যান চলাচল কমেছে। হরতাল-অবরোধের ২০ দিনে এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচল করেছে চার লাখ ২৫ হাজার ২৫৫টি। দৈনিক গড়ে চলেছে ২১ হাজার ২৬২টি গাড়ি। বিরোধীদের কর্মসূচি ছিল না, এমন ২০ দিনে গড়ে চলেছে ৩২ হাজার ৫৪৪টি গাড়ি। গাড়ির মতো টোল আদায়ও কমেছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি। হরতাল-অবরোধের দিনগুলোতে গড়ে দিনে ১৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা টোল আদায় হয়েছে। স্বাভাবিক দিনে গড়ে আদায় হচ্ছে ২৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। যদিও দিন যত গড়াচ্ছে, হরতাল-অবরোধ থাকলেও গাড়ি চলাচল বাড়ছে। গত ১ নভেম্বর অবরোধে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলাচল করেছিল ১৫ হাজার ১৩৪টি। ৩০ নভেম্বরের হরতালে চলেছে ৩০ হাজার ১০৬টি। গাড়ি চলাচল হ্রাসের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় মন্তব্য করতে রাজি হননি সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।
অবরোধে যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের সময় এস্কর্ট দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনকি হরতাল-অবরোধ প্রত্যাখ্যান করে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখার ঘোষণা দিয়ে থাকে সরকার সমর্থক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন। তাহলে গাড়ি চলাচল কমেছে কেন– এ প্রশ্নে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সমকালকে বলেন, ‘যাত্রী সংকটে দূরপাল্লায় ৪০ শতাংশ বাস চলছে। শহরের অভ্যন্তরে বাস চলাচল ঠিক আছে।’ যদিও ঢাকার টার্মিনালগুলোতে দেখা গেছে, অবরোধে বাস চলে না।