Bangladesh

এক দিনে ধার করেছে ৪০ ব্যাংক, সর্বোচ্চের রেকর্ড

► বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক দিনে সর্বোচ্চ ২৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা ধার ► কল মানি মার্কেট থেকে নিয়েছে ছয় হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা

দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টি ব্যাংকই নগদ টাকা ধার করে চলছে। গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিলাম থেকে এই ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে টাকা ধার নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে একসঙ্গে এত বেশি ব্যাংকের টাকা ধার করার নজির নেই। 

দেশের মুদ্রাবাজারে তারল্য সংকট চলছে।

সংকট মেটাতে নিয়মিত টাকা ধার করে ব্যাংকগুলো। বুধবার এসব ব্যাংকসহ দুটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) রেপো ও তারল্য সহায়তা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা নিয়েছে। টাকার পরিমাণের দিক থেকেও এই অর্থ সাম্প্রতিক সময়ে এক দিনে সর্বোচ্চ।

এর বাইরে গতকাল বৃহস্পতিবার কল মানি মার্কেট থেকেও ছয় হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা ধার নিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক।

ফলে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমানতের ধীর প্রবৃদ্ধি এবং ঋণ আদায়ের ধীরগতির কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। এখন স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ নিতে হচ্ছে। 

পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। তাতেও তারল্য ঘাটতি কাটছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণেই এখন চলতে হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্ত ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার করা হয়েছে ৫৫ হাজার ৮৭২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরে ব্যাংকে তারল্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কয়েক মাস ধরে নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। 

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংক খাতের চরম তারল্য সংকটে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা দিচ্ছে। ডলার বিক্রি করে তাদের যে টাকা এসেছে এখন অন্য ব্যাংকগুলোকে সেই টাকা থেকে ধার দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আমানত প্রবৃদ্ধি খুবই কম। এর কারণে তারল্য সংকট আরো বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে টাকা ধার নিয়ে চলেছে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক। চলতি মাসেও প্রায় একই অবস্থায় ছিল। কিন্তু একসঙ্গে ৪০টি ব্যাংক টাকা ধার নেওয়ার নজির এই প্রথম।

বিভিন্ন ব্যাংকের সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করছে। কারণ ট্রেজারি বিলের সুদের হার ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। এ কারণে তারল্য সংকট আরো বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

নীতি সুদহার বাড়ানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাবাজারে অর্থের চাহিদা নিয়ন্ত্রণেরও উদ্যোগ নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগের কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি। বরং দেশের মুদ্রাবাজারে তারল্যের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। অনেক বেসরকারি ব্যাংক এখন ১২-১৩ শতাংশ সুদেও মেয়াদি আমানত সংগ্রহের ঘোষণা দিচ্ছে। তার পরও কাঙ্ক্ষিত আমানত না পাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারের পরিমাণ বাড়িয়ে যাচ্ছে। 

অন্যদিকে ঋণের হারের সীমা (৬-৯) প্রত্যাহারের পর আমানতের সুদহারও বেড়েছে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বুধবার নিলামে তিনটি ব্যাংক এক দিনের রেপো সুবিধায় ৪৩৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা ধার নেয়। আর ১৮টি ব্যাংক ও দুটি এনবিএফআই সাত দিনের রেপো সুবিধার মাধ্যমে ১১ হাজার ৪৭৯.৭৭ কোটি টাকা নিয়েছে। ১২টি ব্যাংক এক দিনের তারল্য সহায়তা সুবিধার মাধ্যমে নিয়েছে সাত হাজার ৪৫ কোটি টাকা। আর সাতটি ইসলামী ব্যাংক ১৪ দিনের তারল্য সুবিধার মাধ্যমে নিয়েছে চার হাজার ২৭৭ কোটি টাকা।

এত দিন ১০টি ইসলামিক ব্যাংকের মধ্যে গড়ে পাঁচটি ইসলামিক ব্যাংক তারল্য সহায়তা নিলেও বুধবার সর্বোচ্চ সাতটি ব্যাংক নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুদের হার ছিল যথাক্রমে ৭.৭৫ শতাংশ, ৭.৮৫ শতাংশ, ৭.৭৫ শতাংশ ও ৬.৭৫ শতাংশ থেকে ৮.৫০ শতাংশ। গত ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭.৭৫ শতাংশ করেছে।

কল মানি মার্কেটেও সংকট

কল মানি মার্কেটেও সংকট থাকায় সব ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে। কল মানি মার্কেট হলো একটি স্বল্পমেয়াদি অর্থ বাজার। এর মাধ্যমে সংকটে থাকা ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংকই এখন সংকটে থাকায় তারা নিজেদের অর্থ ধার দিতে পারছে না।

কল মানি বাজার থেকে ১০ শতাংশ সুদ দিয়েও অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ধার বেড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার কল মানি মার্কেট থেকে ছয় হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা আন্ত ব্যাংক ধার হয়েছে, যা কয়েক দিন আগেও ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, কঠোর মুদ্রানীতি করা হয়েছে। এতে কল মানি মার্কেট ও রেপো রেট দুটি বেড়েছে। তার একটা প্রভাব মুদ্রাবাজারে পড়েছে।

তারল্য সংকটে শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক

দেশের শরিয়াভিত্তিক পাঁচ ইসলামী ব্যাংক এখনো নগদ অর্থের তীব্র সংকটে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য সহায়তা সত্ত্বেও তারা তারল্য সংকট কাটাতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত সেপ্টেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের তারল্য ঘাটতি ছিল ৬৫৮ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক হাজার ৫৯ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৮২৬ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৪৮৩ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৬৫ কোটি টাকা।

তবে বাকি পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের তারল্য উদ্বৃত্ত ছিল। গত সেপ্টেম্বর শেষে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের উদ্বৃত্ত ছিল দুই হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ১২৭ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংকের এক হাজার ১৭৮ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ২৭ কোটি টাকা এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৭০৫ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাংকের ইসলামিক ব্যাংকিং শাখায় অতিরিক্ত তারল্য ছিল।

সূত্রে জানা যায়, পাঁচ ইসলামী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ন্যূনতম নগদ অর্থ রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের জরিমানা করেছে। গত বছর থেকে তারা ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) ও সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) ঘাটতিতে ভুগছে। অনেক গ্রাহক টাকা তুলে নেওয়ায় ব্যাংকগুলো এই সংকটে পড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো প্রতিদিন সিআরআর আকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আমানত রাখতে হয়।

বর্তমানে শরিয়াভিত্তিক দুর্বল ব্যাংকগুলো ন্যূনতম নগদ অর্থ রাখতে পরছে না। সাধারণভাবে কোনো ব্যাংক এ অবস্থায় যাওয়ার পর ওই ব্যাংকের চেক ক্লিয়ারিং বন্ধ থাকার কথা। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধায় চেক ক্লিয়ারিং অব্যাহত আছে। নতুন ঋণও দিচ্ছে এসব ব্যাংক।

জাহিদ হোসেন বলেন, যেসব ব্যাংকের মৌলিক সমস্যা রয়েছে তার সমাধান আগে করা উচিত। শুধু তারল্য সহায়তা দিয়ে কত দিন চলবে? একই সঙ্গে যেসব ব্যাংক টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিতে পারবে না; তাদের ব্যাপারে নজর দেওয়া উচিত। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে সতর্কভাবে তদারকির প্রয়োজন রয়েছে।

যেসব কারণে বাড়ছে ধার

অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা বাজার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকারি ট্রেজারি বিলের ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে তারল্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমেছে। আস্থার সংকটে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখছে অনেকে। তা ছাড়া বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মোটা অঙ্কের জমা টাকা তুলে নেওয়ায় অনেক ব্যাংকে তারল্যে টান পড়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ফ‌লে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে, সেই হারে আমানত পাচ্ছে না। তারল্য সংকটে পড়ে দৈনন্দিন টাকার চাহিদা মেটাতে অ‌নেক ব্যাংক চড়া সুদে ধার নিয়ে চলছে। তা ছাড়া আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধে ব্যাংকগুলো মার্কিন ডলার কেনার চাপে আছে। নগদ টাকায় রপ্তানি ও প্রবাস আয় কেনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে একে অন্যের কাছ থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। আবার সরকারও এখন উচ্চ সুদে টাকা ধার করছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে টাকা, তথা তারল্য নিয়ে টানাটানি চলছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ব অর্থনীতির নানা সংকট দেখিয়ে ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব সুযোগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর অনেক বড় বড় গ্রাহক বছরের পর বছর ঋণ বাড়াচ্ছে, কিন্তু টাকা ফেরত দিচ্ছে না। আবার অনেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং নানা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে দিয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে যেভাবে টাকা বেরিয়েছে সেই হারে ফেরত আসেনি। আবার আমানতের সুদ এখন মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম বলে অনেকেই ব্যাংকেও টাকা রাখছে না। নগদ প্রবাহে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে অর্থাৎ তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন তারল্য ঘাটতি অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যারা হঠাৎ ধার নিচ্ছে সেসব ব্যাংককে আলাদাভাবে দেখতে হবে। নিয়মিত যারা নিয়েই যাচ্ছে তাদের নিরুৎসাহ করা উচিত। তিনি বলেন, এ জন্য সুদহার বাড়িয়ে দিতে হবে, যাতে আর্থিকভাবে সেসব ব্যাংকের শাস্তি হয়, যাতে নিজেদের দুর্বলতা না ঢেকে দক্ষতা বাড়িয়ে সক্ষমতা বাড়ায়। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d