এক বছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে ২১ শতাংশ, জব্দ ৩৪৩ অ্যাকাউন্ট
আওয়ামী সরকার পতনের শেষ বছরে ১৭ হাজার ৪৯টি সন্দেহজন লেনদেন শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। কিন্তু এক বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল ১৪ হাজারের ঘরে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পতিত সরকারের আমলে সীমাহীন দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচারের শিকার হয়েছে ব্যাংক খাত।
সেই চিত্র ধীরে ধীরে সামনে আসছে। কিন্তু প্রকৃত সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা আরো বেশি বলে মত বিশ্লেষকদের। বিএফআইইউয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এখন পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ করা যায়। তাই এখন অনেকেই পরিচয় গোপন করে অভিযোগ করেন।
এসব অভিযোগ পর্যবেক্ষণ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বিএফআইইউ।
বিএফআইইউ অর্থপাচাররোধে দেশের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। ব্যাংক কর্মকর্তারা যেসব লেনদেনকে সন্দেহজনক বলে মনে করেন, সেসব লেনদেনকে তারা ‘সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন’ হিসেবে বিএফআইইউতে পাঠিয়ে দেন। কোনো ছোট গ্রাহকের হিসাবে বড় লেনদেন, কোনো গ্রাহকের একসঙ্গে বড় অঙ্কের নগদ টাকা উত্তোলন, ছোট ব্যবসায়ীর নামে বড় ঋণ, অপরিচিত হিসাবে টাকা স্থানান্তর, সম্পর্ক নেই এমন হিসাবে লেনদেন ব্যাংকগুলো সাধারণত এসব বিষয়কে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়, দীর্ঘদিন ধরেই এই অভিযোগ করা হচ্ছে। আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ এবং উন্নত দেশের উঁচুমানের জীবনযাত্রার লোভে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ—এসব উদ্দেশ্যে অর্থপাচার করা হয় বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির তথ্য অনুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। এই হিসাবে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় গত ১৫ বছরে প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি, গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে প্রতিদিনই শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। তবে ৫ আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিএফআইইউ, এনবিআর ও দুদক যৌথ প্রচেষ্টায় ৩৪৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। তাদের অ্যাকাউন্টে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে।
বিএফআইইউ সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে ২২৫টি তদন্ত রিপোর্ট সিআইডি ও দুদকে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২০টির অডিট রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে। অভিযুক্তদের সবাই বিগত সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধা নেওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। খুব শিগগিরই বাকিগুলোর অডিট সম্পন্ন করে দুদক ও সিআইডিতে রিপোর্ট পাঠানো হবে বলে নিশ্চিত করেছেন বিএফআইইউয়ের একজন কর্মকর্তা।
সূত্র আরো জানায়, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা জোট এগমন্টের সঙ্গে যুক্ত ১৭৭টি দেশ ছাড়াও একাধিক দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে বিএফআইইউয়ের। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্ভব্য সব দেশে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সব রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতি সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি কারণ। তবে ১৭ হাজার সংখ্যাটিও প্রকৃত সংখ্যা নয়। কারণ বিগত সরকারের আমলে যে পরিমাণ আর্থিক অনিয়ম হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জাড়িত ছিলেন। তদন্তসাপেক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে আর্থিক মুক্তি মিলবে না।
গত ১৪ ডিসেম্বর ১০ কম্পানির পাচার করা অর্থ ফেরাতে দুদক সিআইডি এনবিআরের সমন্বয়ে টিম গঠিত হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এই দলকে আইনি সহায়তা দেবে। কার্যালয় হবে বিএফআইইউ বা বাংলাদেশ ব্যাংক। যৌথ দলটিকে নেতৃত্ব দেবে দুর্নীতি দমন কমিশন।