এখনই সংবিধান সংশোধনের সুযোগ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

শর্ত জাতীয় ঐক্য ও গণসম্মতি : পরে সংসদে সেটি অনুমোদন হতে হবে
গণ-আন্দোলন, রাজনৈতিক বিপ্লব বা সামাজিক চুক্তি থেকে একটি নতুন গণম্যান্ডেট সৃষ্টি হলে সেটিকে “ডি ফ্যাক্টো” বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পরবর্তী সরকার বা গণপরিষদ আগের সংবিধান পরিবর্তনের আইনি ভিত্তি দিতে পারে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো অনুযায়ী সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনের প্রথাগত পথ নেই, তবে যদি গণ-আন্দোলন, রাজনৈতিক বিপ্লব বা সামাজিক চুক্তি থেকে একটি নতুন গণম্যান্ডেট সৃষ্টি হলে সেটিকে “ডি ফ্যাক্টো” বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পরবর্তী সরকার বা গণপরিষদ আগের সংবিধান পরিবর্তনের আইনি ভিত্তি দিতে পারে।
সংবিধানের দৃষ্টিভঙ্গি : বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “এই সংবিধান সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি বিল পাস করতে হবে।” অর্থাৎ, সংসদ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রীয় বা আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করার বৈধতা নেই। এটি একটি স্পষ্ট বিধান, যা আদালত কর্তৃক বহুবার পুনর্ব্যাখ্যাও করা হয়েছে (যেমন : আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ, শেখর কুমার সাহা বনাম বাংলাদেশ প্রভৃতি মামলায়)।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন : প্রথাগত মত (মূলধারার সংবিধানবিদ ও বিচারপতিরা) : সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধন সংবিধান লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে। এমন কোনো রূপান্তর যদি জনগণের গণ-আন্দোলন বা বিপ্লবের মাধ্যমে হয়, সেটিকে আইনত স্বীকৃতি দিতে পরবর্তী সংসদকে তা অনুমোদন করতে হবে, নচেৎ তা আইনগত শূন্যতায় পড়ে যাবে।
অবস্থানান্তর বা বিপ্লবকালীন সাংবিধানিক তত্ত্ব : প্রফেসর রণদাপ্রসাদ সাহা, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মতো কিছু সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, যদি বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে “জনগণের ম্যান্ডেট” অনুযায়ী একটি ট্রানজিশনাল সংবিধান বা চার্টার প্রণয়ন হতে পারে। একে অনেক সময় বলা হয় : “জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার সরাসরি প্রয়োগ”, যা বিপ্লবোত্তর বাস্তবতায় দেখা যায় (যেমন : ফ্রান্স ১৭৮৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৪, নেপাল ২০০৭)।
আদালতের ভাষ্যে ‘সংবিধানের মৌলিক কাঠামো’ তত্ত্ব : বিচার বিভাগ বারবার বলেছে, সংবিধানের “মৌলিক কাঠামো” পরিবর্তনযোগ্য নয়, এমনকি সংসদেও নয়। তাই জনগণ বা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি নতুন কাঠামো প্রস্তাব করে, তাহলে সেটি বিচারিক পর্যালোচনার সম্মুখীন হতে পারে যদি না জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা সে প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়।
বাস্তব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে : বর্তমানে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী “জুলাই সনদ ২০২৫”-কে ঘিরে এই প্রশ্নটি খুবই প্রাসঙ্গিক। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং নাগরিক মঞ্চ থেকে দাবি উঠেছে যে সংসদের বাইরে একটি জনমতভিত্তিক ও বিপ্লব-সমর্থিত নতুন রাজনৈতিক কাঠামো (সংবিধান সংশোধনী) হতে পারে; কিন্তু সেটিকে পরবর্তীতে একটি গণভোট বা গণপরিষদের মাধ্যমে বৈধতা দিতে হবে, নচেৎ তা আন্তর্জাতিক বা আইনগত স্বীকৃতিতে বাধা পেতে পারে।
সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ সংবিধান অনুযায়ী নেই। তবে যদি জনগণ সরাসরি পরিবর্তন চায়? সংবিধানের বাইরের রাজনৈতিক পথ (বিপ্লব/জনমত) ধরে এটি হতে পারে। সেটি কিভাবে বৈধতা পাবে এমন প্রশ্নের জবাবে বলা হচ্ছে, পরবর্তী সংসদ, গণভোট বা সংবিধান সভার মাধ্যমে সেটি হতে পারে। আদালত কি সেটা মেনে নেবে কিনা সে প্রশ্নর জবাবে বালা হচ্ছে সেটি প্রেক্ষিত ও প্রক্রিয়াভেদে নির্ভরশীল হবে, তবে আদালত “মৌলিক কাঠামো” তত্ত্ব বজায় রাখতে চাইবে।
বর্তমান তিন বিশেষজ্ঞের মত : সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে বিশিষ্ট আইনজীবী আবু হেনা রাজ্জাকী পাল্টা প্রশ্ন তোলেন দেশেতো এখন কোনো সংবিধান নেই। দেশ চলছে অলিখিত সংবিধানে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান বা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যা করেন তাই সংবিধান। এর আগে তার ভাষায় তথাকথিত সংবিধান অনুযায়ী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ না ভেঙ্গে এবং কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়ে, ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছাড়িয়ে পালিয়েছেন। সংসদ তখনই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতিও অবৈধ হয়ে গেছেন।
তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন প্রশ্ন উঠতে পারে ইউনূস সরকারের স্ট্যাটাস কি? যদি সংবিধানের কথা তোলেন তো সেই সংবিধান অনুসারে তো আগামী ৮ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার কথা। বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিকদলগুলো সরকার প্রধান হিসেবে ইউনূসকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের আবেদন জানিয়ে আসছে, তাহলে সংবিধান থাকলে এটি কিভাবে সম্ভব হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক জেলা জজ ও আইনজ্ঞ ইকতেদার আহমেদ বলেন, সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি সংসদ দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। সংবিধান সংশোধনের জন্যে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যদের সমর্থন লাগবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী নয়া দিগন্তকে বলেন, সংসদ না থাকলে সংবিধান সংশোধন সম্ভব নয়। সামরিক আইন চলাকালে সংসদ স্থগিত থাকায় প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন হলেও তাতে পরবর্তীতে সংসদের অনুমোদন লেগেছে। সামরিক আইনের সময় সংবিধান যতখানি জীবিত ছিল তাতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে।
তিন শীর্ষ বিশেষজ্ঞ কি বলেন?
বাংলাদেশের তিনজন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনবিদের দৃষ্টিভঙ্গিতে “সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনের বৈধতা” প্রসঙ্গে প্রায় কাছাকাছি মত দিয়েছেন।
ড. কামাল হোসেনের অভিমত : বাংলাদেশের মূল সংবিধানের প্রণয়নকারী ও প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের এ প্রসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি সংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও প্রতিনিধিত্বশীল সংসদের মধ্য দিয়ে সংস্কার-এর পক্ষে। তবে ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকালে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন : “সংসদের বাইরে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ হলে তা সংবিধান লঙ্ঘন হবে। তবে যদি জনগণ গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থা দাবি করে, তবে গণভোট বা নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে তা বৈধতা পেতে পারে।”
তিনি “জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা”-কে অস্বীকার না করলেও, সেটিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে বলে মনে করেন। এটাই তার মূল অবস্থান।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের অভিমত : প্রাক্তন আইন উপদেষ্টা, বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের এ প্রসঙ্গে অভিমত ছিল, সংসদ যদি সম্পূর্ণরূপে অবৈধ বা প্রতিনিধিহীন হয়ে পড়ে, তবে জনগণের হাতে “ঐচ্ছিক ক্ষমতা” ফিরে আসে, যা সংবিধান সংশোধনের পথ খুলে দেয়।
গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে তাঁর মত হলো- “নবজাগরণ নয়, এটা হচ্ছে এক নব-সংবিধানিক আত্মপ্রতিষ্ঠা”। তিনি মনে করেন, “এটি সংবিধান লঙ্ঘন নয়, বরং সংবিধান নতুন করে পুনর্ব্যাখ্যার অধিকার জনগণ ফিরে পেয়েছে। এখন প্রয়োজন একটি ট্রানজিশনাল চার্টার যার ভিত্তি হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ম্যান্ডেট।” ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন স্পষ্টতই বলেছিলেন যে, সংসদের বাইরে সাংবিধানিক রূপান্তর সম্ভব, যদি সেটি বিপ্লবী বা সার্বজনীন সমর্থনপ্রাপ্ত হয়।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সংবিধান বিশ্লেষক সালাহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সংবিধান শুধু একটি দলিল নয়, এটি “চুক্তিগত সার্বভৌম ইচ্ছা”। যদি সেই ইচ্ছা যুগোচিত না থাকে, জনগণ সেটি পরিবর্তন করতে পারে। তবে আদালত, আন্তর্জাতিক মহল ও পরবর্তী সরকারকে সেটা গ্রহণযোগ্যভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।
তিনি বলছেন বাইরের পরিবর্তন প্রাথমিকভাবে ‘অবৈধ’ হলেও, রাজনৈতিক বাস্তবতা সেটাকে বৈধ করে তুলতে পারে। অর্থাৎ, বিচারালয় ও রাজনীতি- উভয়ের প্রক্রিয়াকে যুক্ত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাই গণ-আন্দোলন ও পরবর্তীকালে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ‘জুলাই সনদ ২০২৫’-এর মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো প্রস্তাব করেছে। এতে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও বিচারিক স্বাধীনতার নতুন রূপরেখা তুলে ধরা হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে সংসদের বাইরে এমন একটি সংবিধান সংশোধনী বা নতুন সাংবিধানিক রূপরেখা কিভাবে বৈধতা পেতে পারে?
এই প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ সংবিধান বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করলে একটি গভীর ও বহুস্তরবিশিষ্ট চিত্র উঠে আসে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংবিধান সংশোধনের একমাত্র পথ হচ্ছে সংসদ। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংশোধনী বিল পাস করতেই হবে। এই বিধানকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন দেখা দেয় যদি সংসদ অবৈধ বা অকার্যকর হয়ে পড়ে, কিংবা জনগণের প্রতিনিধিত্ব না করে, তখন কী হবে?
সংবিধান প্রণেতা ও প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন মনে করেন, যেকোনো রূপান্তরই সংবিধানের ভেতর দিয়ে চলতে হবে। ২০০৭ সালে পিপলস ইউনিভার্সিটিতে সংবিধান বিষয়ক এক সেমিনারে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, “গণমানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হলে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক উপায়ে, জনগণের প্রত্যক্ষ অনুমোদন নিয়ে, একটি নতুন সংসদ বা গণপরিষদের মাধ্যমেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে।”
প্রখ্যাত আইনজীবী ও প্রাক্তন উপদেষ্টা মইনুল হোসেন বলেন : “যখন জনগণ বিদ্যমান শাসন কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করে, তখন তাদের ইচ্ছাই হয় সংবিধান। তখন সেই জনগণ সংসদের চেয়ে বেশি বৈধ।”
তিনি মনে করেন, “বিপ্লব” কেবল রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি সংবিধানিক কর্তৃত্বের রূপান্তর, যার ভিত্তি আইন নয় বরং জনগণের প্রত্যক্ষ সম্মতি।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সংবিধান বিশ্লেষক সালাহউদ্দিন আহমেদ বিষয়টি বিচারিক ও বাস্তবতার দ্বৈত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন : “যদি রাজনৈতিক রূপান্তর বাস্তবতাজনিতভাবে গৃহীত হয়, তবে তা কার্যকর হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে বিচারিক ও গণতান্ত্রিক স্বীকৃতি দিতে হবে, নচেৎ তা ‘ডি ফ্যাক্টো’ বৈধ থাকলেও ‘ডি জিউর’ বৈধতা পাবে না।” তিনি “জনগণের ম্যান্ডেট”কে গুরুত্বপূর্ণ মানলেও বলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিচারিক টেকসইতা অর্জন না করলে স্থায়িত্ব আসবে না।
জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন রাজনৈতিক মোড় এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও “জুলাই সনদ”-কে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংবিধান পুনর্বিন্যাসের প্রশ্ন সামনে এসেছে। তিনজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞের মতে, এ ধরনের পরিবর্তনের রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করা গেলেও, সেটিকে স্থায়িত্ব দিতে হলে পরবর্তী পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় বৈধতা নিশ্চিত করতে হবে।
তাদের মতে, জনগণের ইচ্ছাই যদি চূড়ান্ত সার্বভৌম হয়, তাহলে তার বাস্তবায়নও হতে হবে এমন এক কাঠামোয়, যা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়।