Bangladesh

এনবিআরকে পাশ কাটিয়ে আদানির সঙ্গে চুক্তি, সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ক্ষতি

ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার গোপনীয় চুক্তির দায় এসে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। নিয়ম অনুযায়ী, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আমদানিসংক্রান্ত চুক্তির আগে এনবিআরের মতামত নিতে হয়। কিন্তু আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে তা একেবারেই অগ্রাহ্য করা হয়। আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে শুল্ক-কর ছাড়ের বিষয়ে এনবিআর অসম্মতি জানিয়েছিল। কিন্তু তা উপেক্ষা করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে’ নিজেরাই শুল্ক-কর অব্যাহতি দিয়ে চুক্তি করে। এতে সরকার সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি শুল্ক হারিয়েছে। সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দার এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

আদানি গ্রুপের সঙ্গে পিডিবির চুক্তি খতিয়ে দেখতে ৫ সেপ্টেম্বর ৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের নির্ধারিত মূল্য ও তার ওপর শুল্ক-কর আদায়যোগ্য কিনা, প্রযোজ্য হলে শুল্ক-কর পরিশোধ করা হয়েছে কিনা এবং শুল্ক-কর ছাড়ের বিষয়ে এনবিআর অনুমতি দিয়েছিল কিনা-এসব বিষয় পর্যালোচনা করে কমিটি। ৩ নভেম্বর ওই কমিটি তাদের প্রতিবেদন এনবিআরে জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনবিআর থেকে অব্যাহতির আদেশ না থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় বিদ্যুৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে পিডিবি কর্তৃক শুল্ক-কর পরিশোধ না করায় ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ডলার (৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা, এক ডলার ১১৮ টাকা হিসাবে) আদায়যোগ্য। অর্থাৎ এই অর্থ পিডিবি থেকে এনবিআরকে পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা করেনি। এতে রাষ্ট্র ৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা শুল্ক ক্ষতির ক্ষতির মুখে পড়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘আদানির সঙ্গে চুক্তির আগে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগ ভারতের রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেড থেকে বিদ্যুৎ কেনে। এ ক্ষেত্রেও এনবিআর শুল্ক অব্যাহতিসংক্রান্ত আদেশ জারি করেনি। ফলে এনটিপিসি থেকে বিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগ শুল্ক-কর ফাঁকির দায় এড়াতে পারে না। তাই বিদ্যুৎ বিভাগকে শুল্ক পরিশোধের নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।’

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তি সই করে। এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার ওই চুক্তি সইয়ে কঠোর গোপনীয়তা অনুসরণ করা হয়। চুক্তির খসড়ার ওপর মতামত দিতে সরকারের অন্য কোনো দপ্তরে পাঠানো হয়নি। এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগে এলেও তা পিডিবিতে পাঠানো হয়নি। ২০২২ সালের শেষের দিকে আলোচনায় আসে আদানির চুক্তির বিষয়টি। নিয়ম অনুযায়ী, সরকার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রটোকল স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মতামত নিয়ে থাকে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি সই করা হয়। চুক্তি স্বাক্ষরকারী ব্যক্তি হিসাবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যানও চুক্তির কপি দেখার সুযোগ পাননি। শুধু চোখ বন্ধ করে স্বাক্ষর করতে হয়েছে তাকে। পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেন তৎকালীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস। এতে করে চুক্তিতে কী কী ধারা রাখা হয়েছিল, তা বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তাই জানতেন না।

জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানির সঙ্গে চুক্তিটাই ছিল অসম। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। চুক্তির খসড়াও করেছে সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ এক আমলা ও আদানি গ্রুপ। সুবিধাও তারাই পেয়েছে। চুক্তির খসড়া আনুষ্ঠানিকভাবে যাচাই-বাছাই হয়েছে কিনা তাও জানেন না।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা শামীম হাসান বলেন, চুক্তিতে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর পরিশোধ বা বিল অব এন্ট্রি জমা দেয়া সংক্রান্ত কোনো ধারা রাখা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অন্য কোনো আইন লঙ্ঘিত হলে সে বিষয়ে ওই সংক্রান্ত অভিযোগ বা দাবি খতিয়ে দেখা হবে।

এনবিআর সূত্র জানায়, ২০২২ সালে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ এনবিআরকে চিঠি দেয়। এর প্রেক্ষিতে চুক্তি খসড়া পাঠাতে এনবিআর ২০২৩ সালের ২ মার্চ, ২২ মার্চ ও ১৩ এপ্রিল বিদ্যুৎ বিভাগে ৩ দফায় চিঠি দেয়। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে খসড়া পাঠানো হয়নি। এ কারণে এ বিষয়ে এনবিআর মতামত দিতে পারেনি।

চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর বিদ্যুৎ বিভাগ এনবিআরকে জানায়, আয়কর অব্যাহতি প্রদানে অসম্মতি জানিয়ে শর্ত সংযোজনের নির্দেশনা দিয়েছিল এনবিআর। পরবর্তীতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে’ শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর থেকে অব্যাহতি দিয়ে চুক্তি করা হয়। এখানে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ’ কে তা স্পষ্ট করা হয়নি।

তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিসংক্রান্ত বাস্তবায়ন চুক্তির ১২ ধারায় বলা আছে, আমদানি পর্যায়ে আদানি যাবতীয় শুল্ক-কর অব্যাহতি পাবে। শুল্ক-কর মওকুফ সংক্রান্ত আদেশ বা প্রজ্ঞাপন যথাযথ কর্তৃপক্ষের (এনবিআর) মাধ্যমে অনুমোদনের দায়িত্ব পিডিবির, এক্ষেত্রে পিডিবি দায়বদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশে শুল্ক-করাদির উদ্ভব ঘটলে চুক্তি অনুযায়ী পিডিবি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পরিশোধ করবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যেহেতু চুক্তিতে পিডিবি দায়বদ্ধ এবং এনবিআর বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি বা ছাড় দেয়নি, সেহেতু পিডিবিকে শুল্ক-করের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

কাস্টমস আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পণ্য আমদানির পূর্বে পণ্যের বিস্তারিত উল্লেখ করে কাস্টমস হাউজ বা শুল্ক স্টেশনে বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে হয়। আলোচ্য ক্ষেত্রে কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যারে বিদ্যুৎ আমদানির তথ্য পাওয়া যায়নি। শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক সৈয়দ মুশফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি ও কাস্টমস আইনের লঙ্ঘন হয়েছে কিনা সেটি পর্যালোচনা করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যেই কমিটি ভ্যাট-কাস্টমস আইন ও শুল্ক-কর অব্যাহতি সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দিয়েছে। এটি শিগগিরই এনবিআরে পাঠানো হবে। পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এনবিআর।

আদানির সঙ্গে চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট : ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এম আব্দুল কাইয়ুম বুধবার রিটটি করেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এই রিটের শুনানি হতে পারে।

রিটে আদানি গ্রুপের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিকে অসম, অন্যায্য ও দেশের স্বার্থপরিপন্থি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তির শর্তগুলো সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সংশোধন করার কথা রিটে বলা হয়েছে। এতে আদানি গ্রুপ রাজি না হলে চুক্তিটি বাতিল করার জন্য রিটে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

এর আগে গত বুধবার সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এম আব্দুল কাইয়ুম পিডিবির চেয়ারম্যান ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এ বিষয়ে একটি আইনি (লিগ্যাল) নোটিশ পাঠান। নোটিশে তিন দিনের মধ্যে চুক্তি সংশোধন প্রক্রিয়া শুরু করতে বলা হয়েছিল। তা না হলে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই আইনি নোটিশের কোনো জবাব না পেয়ে রিটটি করা হয়েছে বলে জানান রিটকারী আইনজীবী। আদানি গোষ্ঠী ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডায় একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই বাংলাদেশে সরবরাহ করে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে এই চুক্তি হয়। শুরু থেকেই এই বিদ্যুতের দাম নিয়ে বিতর্ক ওঠে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button