Hot

এনসিপির প্রতি ইসির পক্ষপাতিত্ব !

নিবন্ধনের জন্য আবেদনকারী দলগুলোর বৈষম্যের শঙ্কা আবেদন জমা দেয়ার আগে এনসিপি নেতারা দুই দফায় সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিন বৈঠক করলেও আবেদন জমা দেয়া অন্যান্য দলের সভাপতি-সম্পাদকদের দেখা দেননি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে রাজনৈতিক দল। গত রোববার পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপের শেষ দিনে ১৪৭টি দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে। ২২ জুন একদিনে ২৮টি দল নিবন্ধনের আবেদন করে। নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে আবেদনকৃত দলগুলোর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন পত্র জমা দিয়েছেন এমন একাধিক দলের নেতারা জানান, ইসির কর্মকর্তাদের আচরণ ও হাবভাবে মনে হচ্ছে তারা এনসিপিকে ভিআইপি মর্যাদা দিয়ে অন্যান্য দলের সঙ্গে বৈষম্য করছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ইসি এনসিপির নেতাদের সঙ্গে যেভাবে বৈঠক করেন, অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে তেমনটা হয়নি। এনসিপির নেতাদের প্রতি নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব দেখে মনে হচ্ছে এনসিপি কিংস পার্টি হওয়ায় অন্যান্য দলগুলোর চেয়ে তাদের অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ওয়ান ইলেভেনের পর ফেসদৌস আহমেদ কোরেশীর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলকে (পিডিপি) অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দলটি নির্বাচনে কোনো আসন পায়নি এবং এখন পিডিপির সাংগঠনিক তৎপরতা নেই এবং বিলুপ্তির পথে। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন এমন কয়েকজন নেতা জানান, তারা মনে করছেন নির্বাচন কমিশন এনসিপিকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। এনসিপির সঙ্গে সিইসির বৈঠক অথচ আমাদের সঙ্গে সেটা না হওয়ায় মনে হচ্ছে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। নিবন্ধনে এমন বৈষম্য কাম্য নয়।

রাজনীতি ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোন দল নিবন্ধন পাবে না পারে সেটা পরের কথা। কিন্তু ইসির উচিত আবেদনকৃত সব দলকে সমান গুরুত্ব দেয়া। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে জন্ম নেয়া এনসিপিকে ইসি যেন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আর এনসিপি নেতারা ছাত্র অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে দেয়ার ইসির কাছ থেকে অন্যদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব নেয়ার চেষ্টা করছেন।

একজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এই মন্তব্য করেন যে, ইসি বৈষম্য করে এনসিপিবে বাড়তি সুবিধা নেয়ার বিরুদ্ধে নতুন দলটির নেতাদের প্রতিবাদ করা উচিত।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, সব মিলিয়ে ১৪৭টি আবেদন জমা পড়েছে। আইন ও বিধি অনুযায়ী এসব দলের আবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে। দলগুলো নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করে কী না- তা যাচাই করব। তারপর নিবন্ধন ও প্রতীক বরাদ্দের প্রশ্ন আসবে। তাই এ মুহূর্তে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা যাবে না। এখানে কারো বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং কাউকে বাড়তি সুবিধা দেয়ার প্রশ্ন আসে না। আমরা সকলের সাথে সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই।

জানা গেছে, নিবন্ধনের আবেদন জমা দেয়ার আগে গত ১৯ জুন বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী ও দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। এর আগে ২০ এপ্রিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ওই বৈঠকে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রতিনিধি দলে উপস্থিত ছিলেন দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায়, খালেদ সাইফুল্লাহ, মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন ও তাজনুভা জাবীন। ওই বৈঠকে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন, নিবন্ধনের সময়সীমা ও নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিগত ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (ওয়ান-ইলেভেন)-এর পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোরকে শৃংখলায় আনতে নির্বাচন কমিশন আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পদ্ধতি প্রবর্তন করে। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর জেলা-উপজেলা-কমিটি এবং দলীয় অফিসের ঠিকানা যাচাই-বাচাই করে নিবন্ধন দিয়ে থাকেন।

জানা গেছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ১০ মার্চ রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন চেয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত ২০ এপ্রিল আবেদনের শেষ সময় ছিল। পরে তা বাড়িয়ে ২২ জুন করা হয়। শেষ দিনে দিনভর নির্বাচন কমিশনে আবেদনকারী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয় ইসি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দ্বিতীয় ধাপের শেষ দিন রোববার পর্যন্ত এনসিপিসহ আরও অন্তত ৮২টি দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে। এর আগে ৬৫টি রাজনৈতিক দল আবেদন করেছিল। সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধনের জন্য আবেদন করল অন্তত ১৪৭টি দল। এনসিপি ছাড়া আবেদন জমা দেয়া দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ড. মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টি, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বাধীন জনতার পার্টি বাংলাদেশ (জেপিপি), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শামীম কামালের নেতৃত্বাধীন জনতার দল, এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরীর নেতৃত্বে গণদল, বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি (বিসিপি), বাংলাদেশ জনজোট পার্টি (বাজপা), বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ সমতা পার্টি, বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন, বাংলাদেশ সিটিজেন পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, নতুন বাংলাদেশ পার্টি (এনবিপি), বাংলাদেশ জাগ্রত জনতা পার্টি, বাংলাদেশ গণ-বিপ্লবী পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী ন্যাপ), বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ফেডারেশন, জনতার দল, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা জনতা পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি (বিসিপি), জাতীয় ন্যায়বিচার পার্টি, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিডিপি) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)।

সরেজমিন দেখা যায় ট্রাকভর্তি কাগজপত্র এনে নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন আবেদন করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ কয়েকজন নেতা সিইসি এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন।

পরে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এনসিপির পক্ষ থেকে দল নিবন্ধনের জন্য সব শর্ত পূরণ করে আবেদন করেছি। ১০৫টি উপজেলা এবং ২৫টি জেলায় কমিটি করা হয়েছে। সব কাগজপত্র ইসিতে জমা দিয়েছি। আমরা আশাবাদী দ্রুততম সময়ের মধ্যেই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নিবন্ধন পাব। নিবন্ধিত দল হিসাবে জনগণের কাছে যাবে। তিনি বলেন, দলীয় প্রতীক হিসাবে তিনটি পছন্দ দিয়েছি। শাপলা, কলম ও মোবাইল। আমাদের প্রথম পছন্দ শাপলা প্রতীক। আমরা আশা করছি জনগণের মার্কা হিসাবে এবং গণ-অভ্যুত্থানের মার্কা হিসাবে গ্রাম বাংলার প্রতীক হিসাবে শাপলা এনসিপি পাবে। এক ব্রিফিংয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দীন পাটোয়ারি বলেন, আমরা এখনো দাবি করছি বর্তমান ইসির পুনর্গঠন করতে হবে। এ ইসি পুনর্গঠন হতে হবে এবং পুনর্গঠন হবেই। আমরা বি অপশনে যাচ্ছি না। জনতা পার্টি বাংলাদেশ (জেপিবি) মহাসচিব শওকত মাহমুদ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সকল রাজনৈতিক দল কি নির্বাচন কমিশনের কাছে সমান গুরুত্ব পাবে? রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি। নিবন্ধন বিধিমালার যে শর্ত আছে সেগুলো পালন করা খুব কষ্টকর। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের এ বিধিমালার কিছু কিছু বিধিমালা সংস্কারের প্রস্তাব রেখেছে। সেই প্রস্তাবগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে ৮২টি দল আবেদন করেছে। সকল রাজনৈতিক দল কি নির্বাচন কমিশনের কাছে সমান গুরুত্ব পারে। এখন নতুন দল গুলোর নিবন্ধন দিতে ইসির কি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা দেখার অপেক্ষায় রাঝনেতিক দলগুলো।

জনতার দলের আহ্বায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শামীম কামাল ও সদস্য সচিব আজম খান। আবেদন জমা দেওয়ার পর শামীম কামাল সাংবাদিকদের বলেন, নিবন্ধনের সব শর্ত পূরণ করে আমরা আবেদন করেছি। আমাদের জেলা ও উপজেলা কমিটি আইন অনুযায়ী গঠন করা হয়েছে। এখন বাকি সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য সাহসী, শিক্ষিত, দেশপ্রেমিক মানুষদের সংগঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন এমন একাধিক দলের নেতা জানান, তারা ইসির কাছে বৈষম্য চান না। সব দলের প্রতি সমান দৃষ্টিতে ইসি দেখবে সেটা প্রত্যাশা করছি। কিন্ত ২২ জুন নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিতে যাওয়া এনসিপি নেতাদের যে ভাবে সিইসিসহ ইসির লোকজন গুরুত্ব দেন; অন্যান্য দলের নেতাদের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায়নি। ফলে আমাদের আশঙ্কা নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে বৈষম্য করা হতে পারে।

নির্বাচন কমিশনে অবেদন করা সব দল সমান সুযোগ পাওয়া উচিত জানিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমমনা উপদলগুলোকে একত্রিত করে (একই মতাদর্শে বিশ্বাসী) দল গঠনের প্রক্রিয়াকেই কিংস পার্টি বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতির যে ইতিহাস, সেখানে বিভিন্ন সময়ে কিংস পার্টি নামে কিছু দল গঠনের চেষ্টা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে তা সফল হয়নি। আওয়ামী লীগের আমলেও কিংস পার্টি হয়েছে, তাদেরও একই পরিণতি। ইতিহাস বলে, কিংস পার্টির উদ্যোগ সবসময়ই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক দল তৈরি হয় জনসাধারণের প্রয়োজনে। কিংস পার্টি গঠন আসলে একটি ভুল প্রচেষ্টা। জনগণের সমর্থনে কখনো কিংস পার্টি হয় না। কিংস পার্টি হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায়। এ কারণেই জনসমর্থন পায় না। উত্থান রাজকীয় হলেও জনগণ গ্রহণ না করায় পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যায় এসব দল। এটাই বাস্তবতা।

জানতে চাইলে গণদলের চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী বলেন, নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিতে গিয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে নিরপেক্ষতা আশা করেছিলাম। কিন্তু সেটা পাইনি নিবন্ধনেও পাবো বলে মনে হচ্ছে না। সিইসি কিংস পার্টি এনসিপি সভাপতির সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে বৈঠক করলেন; অথচ আমাদের দেখা দেননি। মনে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের মতোই নির্বাচন কমিশন কিংস পার্টি এনসিপির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন থেকে গড়ে উঠা এনসিপির উচিত বৈষম্যমূলক সুযোগ বর্জন করা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto