Hot

‘এবার তো আর আমাদের ঈদ নেই’

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে লাগা আগুন কেড়ে নিয়েছে ৪৬ জনের প্রাণ।

‘মেয়ে, জামাই, নাতনি—সবাই চলে গেছে। মেয়ের মা আর আমরা বেঁচে আছি। আমার পরিবারে ঈদ বলতে কিছু নেই। ঈদের কেনাকাটা করার মানসিকতাও নেই,’ কথাগুলো বলছিলেন মুক্তার আলম হেলালি।

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে লাগা আগুন কেড়ে নিয়েছে মুক্তার আলমের মেয়ে মেহেরুন নেসা জাহান (২৪), জামাতা শাহজালাল উদ্দিন (৩৪) ও নাতনি ফাইরুজ কাশেম জামিরার (৩) জীবন।

আগুনের ঘটনার পর তিনজনের মরদেহ হাসপাতালের মর্গে শনাক্ত করতে গিয়েছিলেন মুক্তার আলম। সেই দৃশ্য এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। মুঠোফোনে গতকাল সোমবার তিনি বললেন, ‘আগে ঈদের পরদিন মেয়ে, জামাই, নাতনি বাসায় আসত। আমরা কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যেতাম। সেসব কথা মনে হলে বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে।’

মুক্তার আলমের বড় ছেলে অটিস্টিক। মেয়ে মেহেরুন নেসা পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিলেন। এই মেয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে বড় চাকরি করবেন, ভাইবোনদের দায়িত্ব নেবেন—এমন আশাই ছিল মুক্তার আলমের। তিনি বলেন, ‘আমাদের তো সব শেষ হয়ে গেছে। এ ধরনের আগুনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সরকার যেন সে ব্যবস্থা করে।’

শুধু মুক্তার আলম নয়, বেইলি রোডের আগুনে প্রিয়জনদের হারানো মানুষগুলোর কাছে এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর বয়ে আনেনি আনন্দ। সেদিনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪৬ জন। তাঁদেরই একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তানজিনা নওরিন। ফেসবুকে ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ লেখার পাঁচ দিনের মাথায় থেমে গিয়েছিল তাঁর জীবন।

আগুন লাগার দিন গ্রিন কোজি কটেজের দ্বিতীয় তলায় বিরিয়ানির দোকান ‘কাচ্চি ভাই’-এ ছিলেন তানজিনা ও তাঁর পাঁচ স্বজন। আগুন লাগার পর ওই রেস্তোরাঁর জানালা ভেঙে বেরিয়ে মই বেয়ে নিচে নামেন তানজিনার খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী লামিয়া তাবাসসুম, লামিয়ার দুই মেয়ে, ভাই ও তানজিনার ছয় বছর বয়সী ছেলে আরহাম আহমেদ। তানজিনা নামতে নামতেই বিস্ফোরণ ঘটে।

আগে ঈদের পরদিন মেয়ে, জামাই, নাতনি বাসায় আসত। আমরা কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যেতাম। সেসব কথা মনে হলে বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে।

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে

তানজিনার ছেলে আরহাম আহমেদ এখন বুঝতে পারে—মা আর নেই। তানজিনার স্বামী নাদিম আহমেদ বললেন, ‘এবার তো আর আমাদের ঈদ নেই। ছেলে মায়ের কাছে আসতে চেয়েছে। পিরোজপুরে বাড়ি এসে মায়ের কবর জিয়ারত করেছে। ঈদের দিনও বাবা-ছেলে কবরের কাছে যাব। এভাবেই আমাদের ঈদ কাটবে।’

আগুন লাগার ১২ দিন পর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলামের (২৫) মরদেহ পেয়েছিলেন তাঁর বাবা নজরুল ইসলাম। আগুনে পুড়ে বোঝার উপায় ছিল না লাশটি কার। পরে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। বন্ধুদের সঙ্গে গ্রিন কোজি কটেজে রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন তিনি। দুই বন্ধু মারা যান, বেঁচে ফেরেন দুজন।

নজরুল ইসলাম বললেন, ‘আমরা শোকের মধ্যে আছি। ঈদ বলতে কিছু নেই! চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল নাজমুল। ভালো ছাত্র ছিল। অনেক স্বপ্ন দেখছিলাম। সেই স্বপ্নের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ছেলেকে বিদেশে পাঠাব, ইঞ্জিনিয়ার বানাব, ব্যবসার হাল ধরবে, দেশের জন্য কিছু করবে—কিছুই তো হলো না।’

ঈদ করার কোনো পরিস্থিতি নেই। ভাই নেই। বাবা দেশে ফিরতে পারেননি। কোনোমতে আমাদের সংসার চলছে। আত্মীয়রা মা-বোনকে জামাকাপড় কিনে দিয়েছেন। এ–ই হলো আমাদের ঈদ

আয় নেই, চলে না পরিবার

রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় ছেলে শান্ত হোসেনকে হারিয়ে কান্না থামছে না মা লিপি আক্তারের

রাজধানীর বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় ছেলে শান্ত হোসেনকে হারিয়ে কান্না থামছে না মা লিপি আক্তার

গ্রিন কোজি কটেজের নিচতলার ‘ওয়াফেল অ্যান্ড জুস বার’-এ সহকারী শেফের কাজ করতেন শান্ত হোসেন (২৩)। আর্থিক অনটনে তাঁর উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। ঢাকায় এসে চাকরি নিয়ে পরিবারের হাল ধরেছিলেন।

শান্তর বাড়ি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের ভুঁইগড় পশ্চিমপাড়া এলাকায়। ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবা আমজাদ হোসেন সৌদি আরবে থাকেন। তবে সেখানে প্রতিশ্রুতিমতো কাজ পাননি। ছেলে মারা যাওয়ার পর দেশেও ফিরতে পারেননি। পরিবারের জন্য মাঝেমধ্যে কিছু টাকা পাঠান। পরিবারটির দেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাত লাখ টাকা।

জুস বারে চাকরি করে শান্ত মাসে ১৭ হাজার টাকা বেতন পেতেন। তাঁর ছোট ভাই প্রান্ত হোসেন বলেন, ‘ঈদ করার কোনো পরিস্থিতি নেই। ভাই নেই। বাবা দেশে ফিরতে পারেননি। কোনোমতে আমাদের সংসার চলছে। আত্মীয়রা মা-বোনকে জামাকাপড় কিনে দিয়েছেন। এ–ই হলো আমাদের ঈদ।’

সেদিনের আগুনে যাঁরা বেঁচে ফিরেছিলেন, তাঁদের বিভীষিকাও এখনো কাটেনি। এমনই একজন ফিরোজ আল মামুন। এবারের ঈদে ১১ মাস বয়সী মেয়ে ফাহমিদা আক্তারের জন্য কয়েক রঙের জামা কিনেছেন। পরিবারের অন্যদের জন্যও কেনাকাটা করেছেন।

আগুন লাগা ভবনটির একটি রেস্তোরাঁর শেফ ছিলেন মো. জুয়েল গাজী। জুয়েলের বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম মধুখালী গ্রামে। স্ত্রী রেবা আক্তার (৩০), সাড়ে সাত বছরের মেয়ে ও আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে তিনি ঢাকায় থাকতেন। জুয়েলের আয়েই চলত পুরো পরিবার।

স্ত্রী রেবা আক্তার (৩০) এখন পটুয়াখালীতে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, পবিত্র রমজান মাসের শুরুতে সেখান থেকে একজন এসে ১৫ হাজার টাকা, ছেলে–মেয়েদের জন্য জামা ও জুতা দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া প্রতিবেদন প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা একজন ৫০ হাজার টাকা সাহায্য পাঠিয়েছেন।

‘মেয়ের ছবি চোখের সামনে ভাসছিল’

সেদিনের আগুনে যাঁরা বেঁচে ফিরেছিলেন, তাঁদের বিভীষিকাও এখনো কাটেনি। এমনই একজন ফিরোজ আল মামুন। এবারের ঈদে ১১ মাস বয়সী মেয়ে ফাহমিদা আক্তারের জন্য কয়েক রঙের জামা কিনেছেন। পরিবারের অন্যদের জন্যও কেনাকাটা করেছেন। এরই মধ্যে ২৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনা তাড়িয়ে ফিরছে তাঁকে। বললেন, ‘বেঁচে ফিরব ভাবিনি। হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। দুই ঘণ্টা পর উদ্ধার হই। এখন তো আমি নতুন জীবন পেয়েছি।’

আগুন লাগার দিন বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে গিয়েছিলেন ব্যবসায়ী ফিরোজ আল মামুন। দুটি পাঞ্জাবি পছন্দ করে টাকা পরিশোধ করার পরপরই আগুন লাগে। আটকা পড়েন তিনি। জানালেন, এবার ঈদেও বাবার জন্য পাঞ্জাবি কিনেছেন। তিনি কেরানীগঞ্জে থাকলেও এবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে ঈদ করবেন।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করার পর ফিরোজ আল মামুনকে ভর্তি করা হয়েছিল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। তিনি বললেন, ‘যখন বুঝতে পারছিলাম হয়তো বের হতে পারব না, তখন মনকে শক্ত করে ফেলেছিলাম। মনে মনে বলেছি, মৃত্যু হলে হবে। এতে ভয়টা কম লেগেছিল। শুধু বাবা ডাকতে শেখা মেয়েটার ছবি চোখের সামনে ভাসছিল আর কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d