এলএনজির সরবরাহ কমে তীব্র গ্যাস সংকট, নেমেছে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে
আনোয়ারা-ফৌজদারহাট ৪২ ইঞ্চি পাইপলাইন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মহেশখালী ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ কমে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমেছে। এতদিন গড়ে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছিল। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশব্যাপী গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ধস নেমেছে শিল্পকারখানার উৎপাদনে। সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোয় গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় বিভিন্ন যানবাহনের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে।
গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমে গেছে, ফলে ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বেড়েছে লোডশেডিং। পাশাপাশি গ্যাস সংকটে আবাসিক গ্রাহকরাও চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ হচ্ছে মাটির চুলায়, কোথাও সিলিন্ডার গ্যাসে।
কারখানার মালিকরা বলছেন, কারখানার ব্রয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকা দরকার। কিন্তু অনেক কারখানায় চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে দেড় থেকে ৩ পিএসআইতে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও শূন্যে নেমেছে।
জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘একটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গড়ে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো, মঙ্গলবার রাতে পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে এলএনজির সরবরাহ কমে ২৫০ থেকে ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমেছে। এখন এই এলএনজি শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা ও শিল্পসহ আবাসিকে সরবরাহ হচ্ছে। ঢাকা ও কুমিল্লা অঞ্চলগুলোয় এলএনজির সরবরাহ বন্ধ থাকায় গ্যাস সংকট কিছুটা বেড়েছে।’
মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইন মেরামতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরোদমে কাজ করছে। আমরা তাদের দুইদিনের মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছি। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পাইপলাইন মেরামত শেষ করে পুনরায় এলএনজি সরবরাহ করা যাবে।’
মঙ্গলবার রাতে পেট্রোবাংলার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় গ্যাস গ্রিডের আনোয়ারা- ফৌজদারহাট ৪২ ইঞ্চি পাইপলাইন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের কারণে মহেশখালী ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ কমে গেছে। ফলে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এবং তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির বিতরণ এলাকায় গ্যাসের স্বল্পচাপ বিরাজ করবে।
এদিকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ২৭ মে থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে একটি টার্মিনালের। এ কারণে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় জাতীয় গ্রিডে এলএনজির সরবরাহ প্রায় সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট কমে শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন খাতে গ্যাসের সরবরাহ সংকট চলছিল। চলমান এই গ্যাস সংকট তীব্র করেছে নতুন দুর্ঘটনা।
জানতে চাইলে সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর বলেন, ‘সিএনজি স্টেশনগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংকট চলছে, এখন এলএনজির সরবরাহ কমে যাওয়ায় গ্যাস সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় গাড়িতে গ্যাস নিতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। এতে প্রতিটি স্টেশনে গাড়ির লম্বা লাইন জমেছে।’
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সভাপতি ও সংসদ-সদস্য মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘গ্যাস সংকটের কারণে গাজীপুর, সাভার, কোনাবাড়ী, সফিপুর, নরসিংদীর বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ রয়েছে। এতে প্রতিদিন আমাদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। সিরামিক পণ্য উৎপাদনে প্রধান জ্বালানিই হচ্ছে গ্যাস। গ্যাসের স্বল্পচাপ থাকলে সিরামিক পণ্য উৎপাদন করা যায় না, উৎপাদন করা হলেও পণ্যের মান ঠিক থাকে না। এতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিগুলো অর্ডার বাতিল করে দেয়।’
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, বুধবার একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় আরেকটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ করা হয় গড়ে ২৫০ থেকে ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার দুটি টার্মিনাল থেকে স্বাভাবিক সময়ে এলএনজি রূপান্তরের মাধ্যমে ১০৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হতো।
জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ঘণ্টাপ্রতি উৎপাদন চিত্রে দেখা গেছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন একদিনের ব্যবধানে ১২৫০ মেগাওয়াট কমেছে। বুধবার বেলা ৩টায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৮৭৯ মেগাওয়াট। একদিন আগে মঙ্গলবার বেলা ৩টায় তা ছিল ৫ হাজার ১৩১ মেগাওয়াট। বুধবার বেলা ৩টায় ১৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১২ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট। ওই সময় লোডশেডিং ছিল ২ হাজার ৬৯ মেগাওয়াট।