এ নির্বাচন কর্তৃত্ববাদী একদলীয় শাসনের আরেকটি পদক্ষেপ
ভারত থেকে রাশিয়া। রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র। সব জায়গায় ২০২৪ সালটি একটি নির্বাচনের বছর। এ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ১০টি দেশের মধ্যে সাতটিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আটটি দেশের মধ্যে ৫টিতে এই নির্বাচন। এর মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন হচ্ছে সবার আগে। তবে এখানে পূর্বাভাস ভালো নয়।
৭ই জানুয়ারির এই নির্বাচনে গণতন্ত্রের জন্য কিছু ফাঁদ থাকবে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে তাত্ত্বিকভাবে স্বাধীন একটি নির্বাচন কমিশন, শিক্ষিত ভোটার এবং একটি শক্তিশালী নাগরিক সমাজ রয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম দশকগুলোতে তারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ইতিহাসকে সমুন্নত করতে পারতো। দেশটি অর্থনৈতিক অগ্রগতি, নারীদের ক্ষমতায়নে অগ্রগতি এবং সামাজিক পরিমাপে সার্বিক ইতিবাচক অগ্রগতি উপভোগ করেছে।
বিজ্ঞাপন কিন্তু এই নির্বাচনটি গণতান্ত্রিক, অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। বিষাক্ত রাজনীতি, ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন এবং সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, বিশেষ করে গত ১৫ বছরে ক্রমবর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিক শাসন একটি সহিংসতাপূর্ণ এবং ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনের প্রকৃত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান। খালেদা জিয়া বর্তমানে গৃহবন্দি। তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে। ত্রুটিযুক্ত নির্বাচনের ইতিহাস থাকায় বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির দাবি দেশে নির্বাচন তদারকির জন্য প্রচলিত ধারায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরানো। যখন এই দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, তখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বিএনপি। তাই নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারে- বাংলাদেশি গণতন্ত্রের জন্য সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলের প্রেক্ষিতে এটি একটি ‘পিররিক’ বিজয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ধারণা জনপ্রিয়তা পায়। এই ধারণা ধার করে আনা হয় পাকিস্তান থেকে। এই দাবি জোরালোভাবে তুলেছিল তখন আওয়ামী লীগ। তখন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে তারা এই দাবি তোলে। ভালো কার্যকারিতার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৯ সালে। সম্ভবত এর কার্যকারিতার প্রমাণস্বরূপ আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত পার্লামেন্ট এই ধারাকে ২০১১ সালে বাতিল করে দেয়।
গভীরভাবে বিভক্ত ও প্রতিশোধপরায়ণ রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ভবিষ্যতের জন্য উত্তম সমাধান হতে পারে এই ধারাটির পুনরায় নবায়ন। কিন্তু বর্তমান সরকার ভবিষ্যতে এই ক্ষমতাকে ফ্রি পাস দিয়ে দেবে- এটা কল্পনা করা কঠিন।
দুই প্রধান রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার পর থেকেই আধিপত্য বিস্তারের লড়াই করছে। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগ। তারপর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে তারা তাদের পাল্লা ভারি করেছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিরোধীদেরকে কঠোর হাতে গ্রেপ্তার, ভীতিপ্রদর্শন এবং দমনপীড়নের অর্থ এটাই যে, এই নির্বাচনের ফল শুধু আগেই বলে দেয়া যায় এমন না, একই সঙ্গে আরও রক্তপাত ঘটতে পারে। বিএনপির বেশির ভাগ নেতৃত্ব জেলে অথবা তারা পুলিশের হাতে হয়রান হচ্ছেন। রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতা সহিংসতাকে উস্কে দিচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা এটা বলতে সক্ষম হবেন না যে, দুটি প্রধান দলের মধ্যে একটি অংশগ্রহণ না করায় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে।
নির্বাচনকে সুরক্ষিত রাখা
যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিষ্ঠান প্রচলিতভাবে বিদেশি নির্বাচন মনিটরিং করে। তারা হলো ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ বছর মনিটরিং টিম পাঠাবে না। তার পরিবর্তে একটি যৌথ টেকনিক্যাল মূল্যায়ন টিমের স্পন্সর করছে। তারা সহিংসতা কি পর্যায়ে তা পর্যবেক্ষণ করবেন এবং ভবিষ্যতে সেই রকম সহিংসতা কমিয়ে আনার আশা নিয়ে নির্বাচন-পরবর্তী সুপারিশ করবেন। যদিও তাদের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কিছু বলেননি, তাই দুটি সংগঠনই পরিষ্কারভাবে ত্রুটিপূর্ণ একটি নির্বাচনকে বৈধতা দেয়া এড়িয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। তারা উভয় পক্ষের প্রতি রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরতাকে নমনীয় করার জন্য জোর আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু কেউই সে কথা শুনছেন না।
কিছু বাংলাদেশি এই ভেঙে যাওয়া ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে একটি আকস্মিক পরিবর্তন চান। এ জন্য তারা একটি ‘ডিউস এক্স মেশিনা’ খুঁজছেন। (একটি অনাকাক্সিক্ষত শক্তি বা ইভেন্টকে বোঝানো হয় ‘ডিউস এক্স মেশিনা’ দিয়ে। যা দৃশ্যত অসহায় অবস্থা থেকে সুরক্ষা দেয়)। এই নির্বাচনী ব্যবস্থার সমালোচনা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যারা বাধাগ্রস্ত করবেন বলে দায়ী হবেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, তার জন্য এসব বাংলাদেশি তাদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগ ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অস্বাভাবিক প্রভাব থাকা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার লিভারেজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি যাদেরকে হিসাবে দেখা হচ্ছে- প্রতিবেশী ভারত ও চীন তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ করছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, (বাংলাদেশে) বর্তমান সরকারকে নিয়ে তারা সন্তুষ্ট এবং তারা ক্ষমতায় অব্যাহতভাবে থাকলে তা স্বস্তিদায়ক। তাতে তারা কোন উপায়ে ক্ষমতায় এলো এতে কিছু এসে যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যক্তিগত, প্রতিশোধপরায়ণ ও সহিংস। ২০২৪ সালকে যতটা খারাপ মনে করা হচ্ছে, সহসাই সেখান থেকে উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই। বিচার বিভাগ এবং বিভিন্ন বাহিনী বছরের পর বছর ধরে ফাঁপা হয়ে গেছে এবং নির্দলীয় থাকার ভান ধরেছে। নতুন আইনে ভিন্নমতাবলম্বীদের অপরাধী করা হয়েছে। সম্প্রতি ক্ষুদ্রঋণের জনক ও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়টি এটাই তুলে ধরেছে যে, যদি কাউকে হুমকি মনে করে তাহলে এমন যেকাউকে সরকার ইচ্ছা করলেই বিচার করার সক্ষমতা রাখে। এবারের নির্বাচন হতে পারে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী একদলীয় শাসন উদ্ভবের আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা।