Hot

ওদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে শঙ্কা: সরজমিন পঙ্গু হাসপাতাল

বাইশ বছর বয়সী মুস্তাকিম। রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ইএক্স-২ এ চিকিৎসাধীন। গুলিবিদ্ধ মুস্তাকিমের ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। মুস্তাকিম মানবজমিনকে বলেন, ১৯শে জুলাই বিকাল চারটার দিকে মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হই। পরে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে গেলে       সেখান থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে দুইদিন রাখার পর পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার অপারেশন করা হয়। ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কাঁটতে হয়েছে। 

তিনি বলেন, ভাড়ায় প্রাইভেটকার চালাতাম। ডিউিটি শেষে বাসায় ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে আহত হই।

বিজ্ঞাপন আমার পা-টা এভাবে হারিয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। জীবনের তো এখনো অনেক সময় বাকি। এখন তো তেমন কিছু করতে পারবো না। পুরোপুরি সুস্থ হলে কিছু একটা করতে হবে। চিকিৎসার জন্য ধার-দেনা করে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। ভবিষতে কীভাবে জীবন চলবে বুঝতে পারছি না। 

শুধু মুস্তাকিম নয়, ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে অনেকে চিকিৎসা নিয়েছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতালে)। আহতদের মধ্যে কেউ ছাত্র, কেউ সাধারণ মানুষ। স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে শঙ্কায় আছেন অনেকে। ১৫ই জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৬৩৭ জন চিকিৎসা নিয়েছেন এখানে। এদের মধ্যে ৩৮৬ জনই গুলিবিদ্ধ। মারা গেছেন দু’জন। পা কাটা পড়েছে ৮ জনের। জুলাই-আগস্টে আন্দোলন করতে গিয়ে আহত ১৩০ জন এখনো এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

গুলিবিদ্ধ আতিকুলের মা আমেনা বলেন, আমার সন্তানের ডান হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। উত্তরা রাজলক্ষ্মী মার্কেটে চাকরি করতো। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছি। আন্দোলনের শুরু থেকে সে যুক্ত ছিল। ৫ই জুলাই উত্তরাতে গুলিবিদ্ধ হয়। একটা গুলি আমার ছেলের হাতে লেগে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঘটনার দিন হৃদরোগ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে ৭ তারিখে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ভর্তির একদিন পর হাত কাটে চিকিৎসকরা। আমার ৩ ছেলে ৩ মেয়ে। এই ছেলে সবার ছোট। ওর বাবা আলাল উদ্দিন পুরনো ফার্নিচার বিক্রি করেন। আমার ছেলে ঘর ভাড়ার টাকা দিয়ে ওর বাবাকে সাহায্য করতো। ছেলেটার জীবন তো মাত্র শুরু। ডান হাতটাই কাটা পড়েছে। কী করবে ও, কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। শুধু আমার সন্তানের হাত না এইরকম শত শত সন্তানের হাত-পা গেছে। কারও মায়ের বুক খালি হয়েছে। তাদের যেন সরকার ব্যবস্থা করে দেয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার। আমার সন্তানের হাত চলে গেছে তবুও আমি খুশি এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তামিম। বরিশালে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তামিম বড়। ঢাকাতে নানির বাসায় বেড়াতে এসেছিল। এর আগে মাদ্রাসায় ঢাকাতে পড়াশোনা করেছে। ঘটনার দিন মিরপুর-২ নম্বর এলাকায় তার পায়ে গুলি লাগে। তামিমের মামা তানভীর বলেন, ৫ই জুলাই আন্দোলনের সময় মিছিল দেখে তামিমও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। মিছিল মিরপুর দশ নম্বর থেকে দুই নম্বর পর্যন্ত পৌঁছালে ১৫-২০ জন পুলিশ গুলি ছোড়া শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে একটি গলির মধ্যে দৌড়ে যায় তামিম। এরপর তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে দেখি। প্রথমে দুইটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয়। তামিমের পা প্রথমে ভালো ছিল কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে ওর পায়ে পচন ধরে যায়। পরে মঙ্গলবার হাঁটুর উপর পর্যন্ত পা কাটতে হয়। তামিম ওর মায়ের একমাত্র ছেলে। ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তার মায়ের। সারাজীবনের জন্য আমার ভাগ্নেটা পঙ্গু হয়ে গেল।

মো. মাসুদ কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি পেশায় একজন ভ্যানচালক। মাসুদ বলেন, ১৮ই জুলাই গুলি লাগে আমার পায়ে। আমি ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে প্রতিদিনের মতো ওইদিনও যাই। রাত সাড়ে আটটার দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। পাশে থাকা লোকজন আমাকে উদ্ধার করে বেটার লাইফ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ভালো না বুঝে পঙ্গুতে পাঠিয়ে দেয়। পরের দিন আমার অপারেশন হয়। আমি দ্রুত সুস্থ হতে চাই। আমার পরিবারের আর কেউ নেই স্ত্রী ও তিন সন্তান ছাড়া। আমার ছোট ছোট তিন সন্তানের ভবিষ্যত কী হবে? ওদেরকে কীভাবে বড় করে তুলবো। মেরুল বাড্ডায় পরিবার নিয়ে থাকি। চিকিৎসক বলেছেন জীবনে আর কোনোদিন ভারী কাজ করতে পারবো না। সামনের দিনগুলোতে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পারছি না। পায়ে গুলি লেগে হাড় গুঁড়া হয়ে বাইরে বেরিয়েছে। আমার ১৩ বছরের মেয়েটি চিকিৎসা খরচ চালানোর জন্য গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করেছে।

ক্যাজুয়ালিটি জি-৩৯ ভর্তি আসলাম। তিনি ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। গাজীপুরের কালিয়াকৈর তাদের বাড়ি। আসলাম বলেন, ৫ই জুলাই আন্দোলনের জন্য রাস্তায় বের হই। বিকাল চারটার দিকে আমরা কয়েকজন মিলে আনসারদের সঙ্গে কথা বলে আমরা রাজপথে বের হই। এরপর সামনের দিকে যেতে থাকি। যখনই আমরা সামনের দিকে যাই একের পর এক গুলি করা শুরু করে। তখন আমরা বাঁচার জন্য যে যার মতো পালানোর চেষ্টা করি। তবে আটকে পড়ার কারণে কয়েকজনের গুলি লাগে। আনসার সদস্যরা তখন হাতে যখন যেটা পায় সেটি দিয়ে  পেটাতে থাকে। আমাকে  পেটানোর পরে মাটিতে পড়ে যাই এ সময় আমার বাম হাত পা দিয়ে চেপে ধরে হাতে গুলি করে। ওই অবস্থায় আমি উঠে রাস্তায় দৌড়াতে থাকি। তখন কিছু অপরিচিত লোকের মাধ্যমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে যাই। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি মার্কেটিংয়ে চাকরি করতাম। ৭ তারিখে পঙ্গু হাসপাতালে আসার পর আমার তিনটা অপারেশন হয়। আমার বাবা একটি গার্মেন্টেসে কাজ করেন। আমি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাই। 

সাতক্ষীরায় গুলিবিদ্ধ হয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলী হাসান। ৫ই আগস্ট আন্দোলনে যায় সে। আলী হাসানের মামা সাব্বির হোসেন বলেন, আমার ভাগ্নের ডান পায়ে ছয়টা গুলি লাগে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সাব্বির বড়। ওর বাবা শ্রমিকের কাজ করে। অপারেশন তিনটা করা হয়েছে। আজ আরেকটি করবে। ওর পা কাটা লাগবে। ঘটনার দিন ওর সামনে তিনজন মারা যায়। ভাগ্নেটার সামনে কী হবে বুঝতে পারছি না। তার পা ভালো হোক এটাই চাই।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজজামান বলেন, ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধদের হাড়ও ভেঙেছে, সঙ্গে ওপরের চামড়া-মাংসও থেতলে গেছে। যাদের অঙ্গহানি হয়েছে বা যারা প্রতিবন্ধিতার দিকে যাবেন তাদের চিকিৎসার প্রক্রিয়ায় আগামী দুই থেকে তিন মাসের জন্য রেকর্ড রাখা হচ্ছে। তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতার জন্য আমাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto