ওয়েবিনারে বক্তারা: একতরফা নির্বাচনে দেশ অন্য দেশের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে
জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যে পরিস্থিতি চলছে, তা চলতে থাকলে দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অন্য কোনো দেশের কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। একতরফা নির্বাচন হয়ে গেলে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়বে। এ সংকট থেকে বেরোনোর জন্য বিদেশিরা সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু সমাধান দেশের ভেতর থেকেই করতে হবে।
মঙ্গলবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের এক ওয়েবিনারে বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেছেন। ‘আরেকটি একতরফা নির্বাচন ও সম্ভাব্য পরিণতি’ শিরোনামে এ ওয়েবিনারে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পাশাপাশি ভবিষ্যতে কী পরিণতি হতে পারে, তার ওপর আলোকপাত করা হয়।
কোনো দেশের রাজনীতিতে এ ধরনের পরিস্থিতি চলতে থাকলে অন্যদের ওপর একধরনের নির্ভরতা বাড়ে বলে উল্লেখ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি চীনের ওপর কম্বোডিয়ার এবং রাশিয়ার ওপর বেলারুশের নির্ভরতার কথা উল্লেখ করেন। বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘আপনাকে তখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কোনো না কোনো দেশের কাছে জিম্মি হয়ে পড়তে হবে। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের পরিণতি সেটাই হয়েছে। মাতারবাড়ীতে পোর্ট হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারেনি।’
তা ছাড়া একতরফা নির্বাচন হলে বৈধতার সংকট তৈরি হয় উল্লেখ করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সেখানে নৈতিক শক্তির অভাব ও সুবিধাভোগী তৈরি হয়। তিনি বলেন, অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়লে তার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ হবে। সুবিধাভোগীরা ভুক্তভোগী হবে না। তাদের বিদেশে সম্পদ আছে।
আলোচনায় ব্যবসায়ীদের সমালোচনা করে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, চলমান হরতাল-অবরোধের মধ্যে ব্যবসায়ী শ্রেণি স্থিতিশীলতা চাচ্ছেন। তারা আসলে নিজেদের লুটপাটের স্থিতিশীলতা চাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সংকটের সমাধান প্রশ্নে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, সমাধান নয়াদিল্লি, বেইজিং, ব্রাসেলস বা ওয়াশিংটনে নয়। বাইরের চাপ সহযোগিতা করতে পারে, কিন্তু সমাধান ঢাকার রাজপথে। ঢাকার ক্ষমতায় যারা আছেন, তাদের শুভবুদ্ধির উদয়ের ওপর; যা হবে না। বিরোধী দলে যারা আছেন বলে মনে করছেন, তাদের সবাই কোনো একটি দলের নন। বিরোধীদের এক জায়গায় এসে দাঁড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
দেশের নির্বাচন কমিশন বেশির ভাগ সময় প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলে মন্তব্য করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, এই কমিশন নিজেদের থেকে তফসিল দিয়েছে কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে। যেভাবে আচরণবিধি ভাঙা হচ্ছে, সে বিষয়ে কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন ইসির অধীনে গেছে কি না, সেটা জানা যায়নি
মুখোশ পরে লোকজনকে তুলে নিয়ে হত্যার কথা উল্লেখ করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এটা ভয়াবহ পরিস্থিতি। একটা স্বাধীন দেশে এইভাবে মানুষকে নিয়ে যাবে। এই অবস্থাতেও একতরফা নির্বাচন হলে এর নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। বর্তমান সংকটের সমাধানের কোনো উপায় দেখছেন না বলেও জানান ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন।
একতরফা নির্বাচন হলে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরও বাড়বে বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। ওয়েবিনারে তিনি বলেন, এই বৈষম্য ২০১৪ সাল থেকেই দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে চলমান সংকট নিয়ে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিরোধী দলের নেতারা কারাগারে। তাদের ছেড়ে দিয়ে আলোচনা করে একটা অবস্থানে যেতে হবে। সংলাপের প্রসঙ্গ এলেও সরকারের উদ্যোগ নেই। এ ছাড়া সময়ও হাতে নেই। নির্বাচনের জন্য সংবিধানের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সংবিধানে তো এ ধরনের নির্বাচনের কথা বলা হয়নি।
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে সাবেক এই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়া বিরোধী দলের রাজনীতি করার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড়ের মানসিকতা দেখা গিয়েছিল। এতে একটা অবস্থা গড়ে উঠছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবর সেটা ভেঙে গেছে।
দেশ অনিবার্য একটা খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবরের পরে সরকারের দমনপীড়নের মধ্যেও অনেক মিছিল-মিটিং হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো অনুপস্থিত। যারা জেলের বাইরে আছেন, তাদের সক্রিয়তাও দেখা যাচ্ছে না। বিদেশিদের চাপে হয়তো কিছু সহযোগিতা হবে, কিন্তু কাজটা দেশের মানুষকেই করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতিতে দুটি বড় ব্র্যান্ড আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এর মধ্যে যদি কেউ না থাকে, তাহলে ছোট দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে বড় দলই জিতবে। কারণ, এগুলো যথার্থ বিকল্প নয়। এখানে কী ঘটবে, তা নির্ধারিত। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সীমাহীন দলীয়করণ হয়েছে।
২৮ অক্টোবরের পর নির্বাচনী মাঠ আরও অসমতল হয়েছে উল্লেখ করে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজটা কী? ক্ষমতাসীনদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা? তিনি আরও বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধানকে অস্ত্রে পরিণত করে নির্বাচনী মাঠকে আরও অসমতল করা হয়েছে। ইসির রেফারি হিসেবে যে ভূমিকা পালন করার কথা, সেটা দেখা যাচ্ছে না।
উন্নয়ন ও অর্থনীতি গবেষক এবং জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প গবেষক জিয়া হাসান বলেন, দেশের ব্যাংক খাত, মুদ্রা খাতে অস্থিরতা চলছে। যাদের খুশি করার জন্য গত ১০ বছরে এই সংকট তৈরি করা হয়েছে, তারা আওয়ামী লীগের ভেতরেই আছে। তারা আবার ক্ষমতায় এলে সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ৭ নভেম্বর তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানেরা আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন। বিষয়টি নিয়ে ওয়েবিনারে আলোচকেরা সমালোচনা করেন।
নির্বাচন বিশ্লেষক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আগে কখনো শুনিনি তিন গোয়েন্দা প্রধান উপযাচিত হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। নির্বাচন কমিশন ওপেন ফোরাম। সেখানে গোপন বৈঠক বলে কিছু হয় না। বৈঠক করলে পুরো কমিশনের সঙ্গে করতে হয়। ব্যক্তিগত ছাড়া একা এ ধরনের বৈঠক হয় না।’
এ বিষয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের তিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান সিইসির সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা তাদের মতো করে বলেছেন কী করতে হবে। নিশ্চয় তারা এটাই বলতে গেছেন। এর বাইরে আর কী আলোচনা হতে পারে?