ওষুধ রফতানিতে অভাবনীয় সাফল্য

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের পর কানাডার বাজারে রেনাটার ওষুধ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হলে চ্যালেঞ্জ শুরু হবে বাংলাদেশের তাই সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে : সৈয়দ এস কায়সার কবীর বিশেষ নজর দিলে রফতানিতে দেশের পোশাকখাতকেও ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব : ডা. মো. জাকির হোসেন
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ওষুধ খাত ছিল প্রায় পুরোটাই বহুজাতিক কোম্পানি ও আমদানিনির্ভর। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা দামি ওষুধ আমদানি করা হতো তখন মূলতঃ ভারত, পাকিস্তান ও ইউরোপ থেকে। সেই সময় দেশীয় উদ্যোগে ওষুধ উৎপাদন ছিল সীমিত, গুণগত মানও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আশির দশকের শুরুর দিকে ওষুধ খাতে আমূল পরিবর্তন আনে ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি। এতে বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া দাপট কমে আসে, গুণগত মান ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশীয় কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে আস্থা অর্জন করতে থাকে। গত চার দশকে দেশে ওষুধের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ স্থানীয়ভাবে পূরণ হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর বাকি অংশ রফতানি করে। একই সঙ্গে এ খাত রফতানিমুখী শিল্প হিসেবেও বিকশিত হয়েছে। বর্তমানে ১৬৬টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১০ সালেও ওষুধশিল্পের বাজার ছিল ৯ হাজার কোটি টাকার, যা ২০২৪ সালে পৌঁছেছে সাড়ে ৪২ হাজার কোটিতে, ইউএস ডলারে প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন। গত এক দশকে এই খাতের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১০-১৪ শতাংশ।
সাফল্যের এই ধারাবাহিকতায় অন্যতম এক নাম দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রেনাটা পিএলসি। স্কয়ার, বে´িমকো, ইনসেপ্টার মতোই এই প্রতিষ্ঠানটির ওষুধ অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজারজাতকরণ হচ্ছে। এবার কানাডার বাজারে প্রথমবারের মতো ওষুধ বাণিজ্যিকীকরণ করতে যাচ্ছে কোম্পানিটি। এরই মধ্যে একটি ওষুধের দুটি ভ্যারিয়েন্ট দেশটির বাজারে উদ্বোধন করা হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) এ তথ্য জানিয়েছে রেনাটা।
রেনাটা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এস কায়সার কবীর ইনকিলাবকে বলেন, রেনাটার ব্র্যান্ড নামে কানাডায় ওষুধ পাওয়া যাবে এটা বাংলাদেশের ওষুধখাতে আরও একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের ওষুধ খাত বিশ্বব্যাপি সমাদৃত। তিনি বলেন, কানাডায় এর আগে বে´িমকো ফার্মা ওষুধ বাজারজাত করেছে। রেনাটা দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান। এর আগে রেনাটা অস্ট্রেলিয়ায়ও ব্র্যান্ড নামে ওষুধ বাজারজাত করছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ওষুধের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে রেনাটা গর্বিত বলে উল্লেখ করেন সৈয়দ এস কায়সার কবীর। তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি শংকার কথা উল্লেখ করে সৈয়দ এস কায়সার কবীর বলেন, দেশের ওষুধ শিল্পের চ্যালেঞ্জ শুরু হবে ২০২৬ সাল থেকে। কারণ ওই সময় উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হবে বাংলাদেশ। তখন থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রাপ্তিতে ঘাটতিসহ দাম বেড়ে যাবে। এজন্য এখনই সরকারকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটি কানাডার বাজারে ডেসোজেস্ট্রেল দশমিক ১৫ মিলিগ্রাম এবং ইথিনাইল এস্ট্রাডিওল দশমিক শূণ্য ৩ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট বাণিজ্যিকীকরণ শুরু করেছে। কানাডিয়ান জেনেরিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাম্বিকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ইনকর্পোরেটেডের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ‘মাইলি ২১’ এবং ‘মাইলি ২৮’ ব্র্যান্ড নামে ওষুধ দুটি বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে। জানা গেছে, এই ওষুধ দুটি গর্ভনিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা মহিলাদের গর্ভাবস্থা প্রতিরোধের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত।
এ বিষয়ে রেনাটা লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মো. জুবাইয়ের আলম বলেন, আমরা এই ওষুধের মাধ্যমে কানাডার বাজারে প্রথম প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এটি নারীদের গর্ভনিরোধক ওষুধ, যা বাংলাদেশের বাজারেও আমরা বিক্রি করছি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এটি কাউকে ২১ দিনের জন্য এবং কাউকে ২৮ দিনের জন্য দেওয়া হয়। কানাডার বাজারে আমাদের দুটি ভ্যারিয়েন্টেই বাজারজাতকরণ করা হবে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বাজারে ফ্লুড্রোকোর্টিসোন দশমিক ১ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট বাণিজ্যিকীকরণ শুরু করেছে রেনাটা। ফ্লুড্রোকোর্টিসোন দশমিক ১ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট প্রাথমিক অ্যাডিসন রোগ এবং লবণ-হ্রাসকারী অ্যাড্রেনোজেনিটাল সিন্ড্রোমের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাজ্যের ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা পণ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা (ইউকে এমএইআরএ) কর্তৃক রেনাটার ওষুধটি শক্তিশালী পণ্য হিসেবে অনুমোদিত হয়েছে। যা রেনাটা (ইউকে) লিমিটেডের অধীনে দেশটিতে বাণিজ্যিকীকরণ করা হচ্ছে।
এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্যের বাজারে ক্যাবারগোলিন দশমিক ৫ মিলিগ্রামের একটি ওষুধের জেনেরিক সংস্করণের প্রথম চালান পাঠায় রেনাটা পিএলসি। ওই ওষুধটি হাইপারপ্রোল্যাক্টিনেমিয়া ও পারকিনসন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রেনাটার রিসপেরিডোন (মানসিক বৈকল্যের চিকিৎসায় ব্যবহৃত) এবং ক্যাবারগোলিন (হাইপারপ্রোল্যাকটিনেমিয়া এবং পারকিনসন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত) সহ বেশকিছু ওষুধ রপ্তানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া, অস্টেলিয়ার বাজারে রেনাটার গর্ভনিরোধক পিল লেভোনরজেস্ট্রেল ১ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম বিক্রি হচ্ছে, যা নোভেলা-১ নামে বাজারজাত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও ডেল্টা ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. জাকির হোসেন এ বিষয়ে ইনিকলাবকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মার্কেটে ৩০০ কোটি ডলারের ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে। আগামী ২০২৯ সালের মধ্যে তা ৬০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে সম্ভাবনাময় এই খাতটি উন্নত বিশ্বের ওষুধের বাজারেও সুনামের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের ওষুধ মানসম্মত। বাংলাদেশের কমপক্ষে ১৫টি ওষুধ কোম্পানি আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ব্রাজিলসহ উন্নত দেশগুলোতে ব্র্যান্ড নামে ওষুধ বাজারজাত করছে। সরকার কাঁচামাল উৎপাদনসহ এইখাতে বিশেষ নজর দিলে রফতানিতে দেশের পোশাকখাতকেও ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, ওষুধশিল্পে বাংলাদেশের এই অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে বড় অবদান ছিল সময়োপযোগী নীতিমালার। নতুন বাস্তবতায়ও তেমনি এক সুসংহত নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। এখন দরকার, দ্রুত ওষুধ নিবন্ধন প্রক্রিয়া সচল করা, এপিআই পার্ক সম্পূর্ণভাবে চালু করা, গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো, আন্তর্জাতিক গুণগত মান রক্ষা, বায়োফার্মার মতো ভবিষ্যৎ খাতকে উৎসাহিত করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দরিদ্রবান্ধব প্রণোদনা নিশ্চিত করা।