Trending

কঠিন সময়ের মুখোমুখি শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে দীর্ঘমেয়াদি মন্দা

দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিল্প বাণিজ্য পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে নতুন শিল্প স্থাপন আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠেছে। ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, টাকার প্রবাহ কমানো, ডলারের উচ্চমূল্য, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-এসব কারণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা এখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি। এ অবস্থায় নতুন শিল্প স্থাপন তো দূরের কথা, বর্তমানে চালু শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আবার নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ায় এ খাতে সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করতে যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে আগে থেকেই স্থবিরতা বিরাজ করছিল। এর প্রভাব মোকাবিলা করে এসব খাত ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পুনরুদ্ধারের গতি ছিল খুবই মন্থর। এর মধ্যে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ অনেক ব্যবসায়ী পালিয়ে যান। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। ইতোমধ্যে বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আরও কয়েকটি গ্র“পের কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন শিল্প খাতে রয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। এতে দফায় দফায় গার্মেন্টসহ নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ হচ্ছে। এর প্রভাবে বাড়ছে বেকারত্ব। বিনিয়োগ না হওয়ায় নতুন কর্মসংস্থানের গতিও ধীর।

এদিকে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েক মাসের জন্য ৮ শতাংশের ঘরে ছিল। বাকি সময় ৯ শতাংশের উপরে। বর্তমানে যা আরও বেড়ে ডাবল ডিজিটে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার কমাতে ২০২২ সালের জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এখন মুদ্রানীতি আরও কঠোর করা হয়েছে। ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে।

প্রায় ৩ অর্থবছর ধরে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি গ্রহণ করায় বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এতে বেসরকারি খাত চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান পাচ্ছে না। পাশাপাশি ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে এখন করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ। এতে ঋণের খরচ বেড়েছে। গত আড়াই বছরের ব্যবধানে ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এতে আমদানি খরচ বেড়েছে। ফলে শিল্প খাত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব চ্যালেঞ্জ কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। কারণ এ সরকার মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাজারে টাকার প্রবাহ আরও কমিয়েছে। ঋণের সুদের হারও বাড়িয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বাড়াতে টাকার মান কমানো হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে মূল্যস্ফীতির হার নভেম্বর পর্যন্ত কমেনি। তবে ডিসেম্বরে এসে সামান্য কমে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়েছে। আগামীতে আরও কিছুটা কমতে পারে।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, শীতের সবজিসহ অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ বাড়ায় দাম কিছুটা কমেছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।

বিনিয়োগের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ একটি অন্যতম উপকরণ। এ দুটিতেই সমস্যা প্রকট। বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়লেও নিরবচ্ছিন্ন হচ্ছে না। গ্যাসের দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গ্যাস নির্ভর বর্তমান শিল্পগুলো ধুঁকছে। নতুন শিল্প চালু করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা এবং ক্যাপটিভ পাওয়ারে (শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎ) ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটারের দাম ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই দাম বাড়লে গ্যাস নির্ভর শিল্পে সংকট আরও বাড়বে। পাশাপাশি গ্যাসের খরচ বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গত সরকার যখন গ্যাসের দাম ১২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করেছিল এবং ক্যাপটিভে সাড়ে ৩১ টাকা করেছিল তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হবে। কিন্তু কখনোই গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ মেলেনি। বরং গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পর থেকে এটি খারাপের দিকে গেছে। সরকার গ্যাসের দাম নতুন যে হারে বাড়াতে চাচ্ছে এটি হলে কোনো উদ্যোক্তা গ্যাস নির্ভর নতুন শিল্প করবে না। বর্তমানে চালু শিল্পগুলোও তীব্র সংকটে পড়বে। এই সংকট মোকাবিলা করে সামনে এগোনো কঠিন হবে।

তিনি নতুন করে গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়ে বলেন, আপাতত গ্যাস আমদানি বাড়াতে হবে। মধ্য মেয়াদে দেশে গ্যাস কূপ খনন করে সরবরাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এদিকে সরকার নতুন করে ৬৭ ধরনের পণ্যের ভ্যাট বাড়ানো বা আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। এতে সেবা ও পণ্যের বিক্রি হ্রাস পেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা।

এসব বহুমুখী কারণে আগামীতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে দামও বাড়তে পারে। তখন মূল্যস্ফীতির হারও আবার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতাকে কমিয়ে দেবে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে বিদ্যমান অস্থিরতার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে তা কমে ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ। ঋণের ওই প্রবৃদ্ধির মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে চলমান শিল্পে ও সুদ যোগ করে। নতুন ঋণ বিতরণ হয়নি বলেই চলে। কারণ উদ্যোক্তারা চলমান বহুমুখী সংকটের কারণে নতুন ঋণ নিতে চাচ্ছেন না। ফলে দেশে বিনিয়োগও হচ্ছে না।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল ২১ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর আগে করোনার সংক্রমণ ও বৈশ্বিক মন্দার সময়ও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ফলে নতুন শিল্প যেমন হচ্ছে না। তেমনি চলমান শিল্পের সম্প্রসারণ হচ্ছে না। শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে কমেছে সাড়ে ১১ শতাংশ ও গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল সাড়ে ১৫ শতাংশ। তবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কিছুটা বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে বেড়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছিল ৭ শতাংশ। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি আদেশ বাড়ায় এ খাতে কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমার কারণে শিল্প ও কৃষি খাতেও ঋণের প্রবাহ কমে গেছে।

করোনার সময় থেকেই দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। এখন যেসব বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে তার বড় অংশই দেশে কার্যরত কোম্পানিগুলোর মুনাফা থেকে বা অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ করে পুনঃবিনিয়োগ। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছিল ৪৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে বিনিয়োগ হয়েছে ৩৮ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ডিসেম্বর পর্যন্ত মজুরির হার সামান্য হারে বেড়েছে। ওই মাসে এ হার ছিল ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। যা মূল্যস্ফীতির চেয়ে অনেক কম। বিনিয়োগ না হলে ও শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে থাকলে আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে সরকারি খাতেও বিনিয়োগ কম হচ্ছে। রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজে স্থরিতা দেখা দিয়েছে। সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি এই তিন খাতেই বিনিয়োগ কমায় বিশেষ করে শিল্পপণ্য রড, সিমেন্ট, কাচ, টাইলস, পেইন্ট, স্টিল, টিন এসব পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। ফলে এ ধরনের ভারী শিল্পগুলোও সংকটে পড়েছে। 

দেশে মোট কর্মসংস্থানে প্রায় ৯৪ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি খাতে। বাকি ৬ শতাংশ হচ্ছে সরকারি খাতে। বেসরকারি খাতে দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগ মন্দায় কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। এদিকে শ্রমের বাজারে নতুন কর্মীর প্রবেশের কোনো কমতি নেই। ফলে তারা চাহিদা অনুযায়ী কর্ম না পেয়েই বেকার থাকছে বা প্রত্যাশার চেয়ে নিম্নমানের কর্মে জড়িত রয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d