কমলা না ট্রাম্প দ্বিধায় ভোটাররা
যুক্তরাষ্ট্র হাঁটছে ভুলপথে মনে করেন ১০ ভোটারের মধ্যে সাতজন
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিস উভয়েই বিচক্ষণতার ছাপ দেখাতে পারবেন বলে মনে করছেন না আমেরিকান ভোটাররা। এ নিয়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় নিপতিত হয়েছেন তারা। স্বল্প ও মাঝারি আয়ের মানুষকে ট্যাক্সের জাঁতাকল থেকে কিছুটা রেহাই দেওয়ার অঙ্গীকার করায় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের প্রতি কিছুটা আস্থা থাকলেও ট্রাম্প নিয়ে হতাশার শেষ নেই। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ‘দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স রিসার্চ’ পরিচালিত সর্বশেষ জরিপে প্রতি ১০ ভোটারের সাতজনই মনে করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ভুল পথে ধাবিত হচ্ছে। সোমবার সকালে প্রকাশিত এই জরিপ ফলাফলে আরও উদঘাটিত হয় যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে কৃতিত্ব ছিল তা হতাশার আবহে নিপতিত হয়েছে আসন্ন নির্বাচনে মার্কিনিদের প্রত্যাশার বিপরীতে হরদম মন্তব্য প্রদানের জন্য। এগুলো হচ্ছে গর্ভপাত, অভিবাসন, অপরাধ এবং পররাষ্ট্রনীতি। অভিবাসীদের রক্ত-ঘাম-মেধায় গড়ে ওঠা আমেরিকা থেকে কাগজপত্রহীন (আনডক্যুমেন্টেড) অভিবাসীদের ঢালাওভাবে গ্রেপ্তারের পরই বহিষ্কারের অঙ্গীকার করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিবন্ধিত ভোটারের ওপর পুরো সেপ্টেম্বর মাসে পরিচালিত এই জরিপে কর্মসংস্থানে, গৃহায়ণ সমস্যা, মাঝারি শ্রেণির ট্যাক্স হ্রাসে, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম কমাতে, গ্যাস এবং পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হ্রাসে কোন প্রার্থী বেশি পারদর্শী হবেন- এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ এসব মৌলিক ইস্যুতে কে আমেরিকানদের প্রত্যাশার পরিপূরক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন বলে ভোটাররা মনে করছেন। ট্রাম্পের চেয়ে কমলার প্রতি কিছুটা বেশি আস্থা রাখতে পারছেন বলে জবাবে উল্লেখ করেছেন। রবিবার ছিল কমলা হ্যারিসের জন্মদিন। এ নিয়েও তীর্যক মন্তব্য করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেছেন, কমলাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে পারতাম কিন্তু তিনি একের পর এক মিথ্যাচার করছেন ভোটারদের সঙ্গে। বিশেষ করে কলেজে অধ্যয়নকালে ফাস্টফুডের দোকান ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করেছেন বলে যে দাবি করেছেন তা সর্বৈব মিথ্যা। রবিবার স্যুইং স্টেট পেনসিলভেনিয়ার বাকস কাউন্টিতে নির্বাচনি সমাবেশের একপর্যায়ে নিকটস্থ ম্যাকডোনাল্ড স্টোরে যান ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে গিয়ে তিনি ফ্র্যাঞ্চ ফ্রাই (আলু ভাজি) করতে চান। এবং যথারীতি ৫ মিনিট সেই কাজটি করেন। আরও ১০ মিনিট তিনি খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে গাড়িতে থাকা গ্রাহকের অর্ডার সার্ভ করেছেন। উল্লেখ্য, ম্যাকডোনাল্ড স্টোরটি আগে থেকেই সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ রাখা হয় ট্রাম্পের আগমন উপলক্ষে। তবে তিনি আলু ভাজি করার সময় তা খুলে দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীর অনেকেই গ্রীষ্মের ছুটির সময় ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করেন। এ ছাড়া নবাগত অভিবাসীরাও এমন স্টোরে কাজ করেন। কিন্তু ন্যায্য পারিশ্রমিক কখনো পাননি। বাইডেন-হ্যারিস আমলে প্রতি ঘণ্টায় ন্যূনতম মজুরি ১৫ ডলারের অধিক করা হয়েছে। নির্বাচিত হলে ম্যাকডোনাল্ডসহ ফাস্ট ফুডের কর্মচারীদের মজুরি বাড়াবেন বলে কোনো অঙ্গীকার করেননি রিপাবলিকান ট্রাম্প। অধিকন্তু তিনি কমলাকে মিথ্যুক হিসেবে অভিহিত করেছেন যে, কখনোই নাকি ম্যাকডোনাল্ডের মতো বার্গার ফ্যাঞ্চাইজে কমলা কাজ করেননি। কমলা হ্যারিসের চলমান বিজ্ঞাপনে ম্যাকডোনাল্ডে কাজের অভিজ্ঞতাও বিবৃত হওয়ার পরই ট্রাম্প এমন আক্রমণ করলেন। জানা গেছে, আশির দশকে কলেজ শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় কমলা ও তার স্বামী আমহোফ ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিখ্যাত সানফ্রান্সিসকোর একটি ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করেন। মজুরি পেয়েছিলেন ঘণ্টায় মাত্র ৩.৩৫ ডলার করে। এ বিজ্ঞাপনে নতুন প্রজন্মের ভোটাররা কমলার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। এটা সহ্য হচ্ছে না ট্রাম্পের। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা সাধারণ ভোটার তথা খেটে খাওয়া মানুষের সাপোর্ট পেতে এর আগেও চুলকাটার দোকান, কলেজ-ক্যান্টিন, চার্চ ইত্যাদি স্থানে গেছেন। এবার ট্রাম্প বেছে নেন ম্যাকডোনাল্ডকে। সে সময় ট্রাম্প গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি নাকি সবসময়ই ম্যাকডোনাল্ডে কাজে আগ্রহী ছিলেন। গাড়ি চালিয়ে দরজার কাছে আসা গ্রাহকের একজন ট্রাম্পকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল তিনি মেনে নেবেন কিনা। জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘অবশ্যই, যদি সেটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়।’ কমলা হ্যারিসের বেড়ে ওঠার পর সানফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল এবং পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ইউএস সিনেটর হওয়া কমলা হ্যারিস বাইডেনের রানিংমেট হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এখনো সে দায়িত্বে রয়েছেন ভারতীয় বংশো™ভূত কমলা হ্যারিস। সানফ্রান্সিসকো পরিণত হয়েছে বিশ্বের প্রযুক্তি রাজধানীতে। তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভাবকরা বিশ্বের সেরা ধনীতে পরিণত হলেও কমলা তাদের নিরঙ্কুশ সমর্থন ধরে রাখতে পারেননি। যে ধারার সৃষ্টি করেছিলেন বারাক ওবামা ২০০৮ সালে, এবার তাতে ফাটল ধরিয়েছেন টেসলা সিইও ইলন মাস্ক। প্রকাশে মাঠে নেমেছেন ট্রাম্পের পক্ষে। ভোটারকে কমলার বিপক্ষে গিয়ে ট্রাম্পকে ভোট দিতে বিলিয়ন ডলারের অধিক ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। এ অবস্থায়ও সিলিকন ভ্যালিসহ আমেরিকার অপর প্রান্ত নিউইয়র্কের বিত্তশালী ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী-শিল্পপতিরা এর আগের সোমবার মাথাপিছু ৫০ হাজার ডলারের এক তহবিল সংগ্রহে মিলিত হয়েছিলেন কমলার পক্ষে। কমলা হ্যারিসের ভগ্নিপতি বিশ্বখ্যাত পরিবহন-ব্যবস্থার জনক ‘উবার’-এর চিফ লিগ্যাল অফিসার টনি ওয়েস্ট তহবিল সংগ্রহের এ আয়োজন করেছিলেন। এভাবেই স্বল্প সময়ে কমলা তার নির্বাচনি তহবিলকে বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। আগেই জানানো হয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান এবং কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ভোট ব্যাংক কমলার পক্ষে নিশ্চিতের জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং বারাক ওবামা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। অপরদিকে, কমলা নিজে এখন ব্যস্ত রয়েছেন বিজয় নির্ধারণী স্টেট তথা স্যুইং স্টেটগুলোর তরুণ-তরুণী ভোটার এবং মুসলিম আমেরিকানদের মনোযোগ বাড়াতে। বাইডেনের গাজা পরিস্থিতি হ্যান্ডেল নিয়ে বিরূপ হওয়া মিশিগানের মুসলমান ভোটারের বড় একটি অংশ এখন ‘মন্দের ভালো’ ভাবছেন কমলাকে। এটি ডেমোক্র্যাট শিবিরে স্বস্তি ফেরাচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলার অবদানকে কেউই ইতিবাচক হিসেবে মেনে নিতে চাচ্ছেন না। কারণ, ২০২৪ অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি ব্যাপক আকার ধারণ করে তা ১.৮৩৩ ট্রিলিয়ন ডলারে উঠেছে। করোনা মহামারির পর যে কোনো বছরের চেয়ে তা বেশি বলে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট উল্লেখ করেছে। ৩০ সেপ্টেম্বর সমাপ্ত ২০২৪ অর্থবছর ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৩৮ বিলিয়ন ডলার এবং সেটি হচ্ছে ২০২৩ অর্থবছরের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। আমেরিকার অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি তথা ফেডারেল বাজেট পরিস্থিতি নিয়ে কর্মরত থিঙ্কট্যাংক ‘দ্য কমিটি ফর অ্য রেসপন্সিবল ফেডারেল বাজেট’ ধারণা করেছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ফেডারেল সরকারের দেনার পরিমাণ বেড়ে ৭.৫ ট্রিলিয়ন ডলার হবে। অপরদিকে, কমলা হ্যারিসের পরিকল্পনায় তা ৩.৫ ট্রিলিয়নের থামবে। অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের দেনার দায় কমলার চেয়ে দ্বিগুণ হবে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠিত হলে। এসব বিষয় নির্বাচনি ময়দানে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।