Hot

কম দামের পণ্য শেষ হয়ে যায়, লাইন শেষ হয় না

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাজারে হাঁসফাঁস অবস্থা। কাঁচা সবজি থেকে মাছ, মাংস, চাল, ডাল, তেল- এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নেই যা কিনতে ঘাম ঝরছে না সাধারণ মানুষের। তাই একটু স্বস্তিতে পণ্য কিনতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর ট্রাক সেল ও ওএমএস ট্রাক সেল সেন্টারে ছুটছে সাধারণ মানুষ। তবে চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরছেন অনেকে। টিসিবি-ওএমএস-এর ট্রাকে পণ্য কিনতে আসা ক্রেতারা বলছেন- লাইন শেষ হওয়ার আগেই পণ্য শেষ হয়ে যায়। 

সরজমিন দেখা যায়, মোহাম্মদপুর বসিলা এলাকার র‌্যাব ক্যাম্পের ঠিক উল্টো পাশে টিসিবি ট্রাক সেল কার্যক্রম চলছে। ট্রাক সেলের ব্যানারে ৩০ টাকা কেজি দরে চাল, ৬০টাকা কেজি মশুর ডাল ও ১০০ টাকা লিটার তেল বিক্রি করার কথা উল্লেখ থাকলেও চাল পাননি অনেকে। চালের বদলে টিসিবি’র ট্রাকে দেয়া হচ্ছে আলু। আর টিসিবি’র এসব পণ্য নিতেই প্রখর রোদের মধ্যেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অন্তত এক থেকে দেড়শ’ মানুষ। যাদের বেশির ভাগই নারী। কেউ এসেছেন কোলে বাচ্চা নিয়ে, কেউ আবার ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা। নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি আছেন মধ্যবিত্ত পরিবারেরও অনেক সদস্য। অনেকে মুখে মাস্ক লাগিয়ে দাঁড়ান লাইনে। 

তাদের একজন রাবেয়া বেগম। কোলে তিন মাসের শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন টিসিবি’র লাইনে। রোদ থেকে শিশুকে রক্ষার জন্য বার বার তার মাথায় কাপড় জড়িয়ে দিচ্ছিলেন। রাবেয়া বলেন, আমার স্বামী আগে ছোটখাটো একটা ব্যবসা করতেন। এখন তার ব্যবসাটা ভালো চলে না। এরপর বাজারে পণ্যের যে দাম কিছু কেনা যায় না। এক কেজি ভালো চাল বর্তমানে ৭৫ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। মাছ, মাংস, সবজি এমন কিছু নেই যে, যার দাম বাড়েনি। তাই এখানে এসেছি একটু কম দামে পণ্য কিনবো বলে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও আমাদের খালি হাতে ফিরতে হয়। সবাই পণ্য পাই না। আমার এই ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে লাইনে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় দাঁড়িয়ে আছি, তারপরও পণ্য পাবো কিনা জানি না। তিনি বলেন, আমাদের এই এলাকায় হাজার হাজার লোক। কিন্তু এখানে টিসিবি’র গাড়ি আসে সপ্তাহে এক থেকে সর্বোচ্চ দুইবার। আর যা নিয়ে আসে কয়েকজনকে দেয়ার পরই পণ্য শেষ। রাবেয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পেছন দিক থেকে ছুটে আসেন তৈয়বা খানম নামে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমি গত সপ্তাহে ৩-৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু পাইনি। সপ্তাহ জুড়ে অনেক কষ্ট করেছি। আজকে আবার এসেছি। ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে আছি কোনো খবর নেই। তিনি বলেন, আমার স্বামী প্যারালাইজড। কোনো কাজ করতে পারে না। আমি এদিক ওদিক কাজ করে যা পাই তাই দিয়ে সংসার চালাই। অসুস্থ স্বামীকে বাসায় রেখে এসেছি। কতোবার এদের বললাম-আমি বৃদ্ধ মানুষ। আমাকে বাসায় যেতে হবে, আমাকে একটু আগে দিয়ে দেন। কিন্তু কেউ কথা শোনে না। আজকেও যদি লাইনে দাঁড়িয়ে কিছু না জোটে তাহলে না খেয়েই থাকতে হবে আমাদের দুই বুড়ো-বুড়িকে। রাবেয়া ও তৈয়বার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে এই প্রতিবেদকের তখন মুখে মাস্ক পরে লাইনে দাঁড়িয়ে বাজারের ব্যাগ দিয়ে বার বার মুখ ঢাকছিলেন মধ্য বয়সী এক পুরুষ। তিনি বলেন, আসলে আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের এই স্বল্প আয়ের টাকা দিয়ে পুরো সংসারের খরচ চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই একটু খরচ পোষাতে এই টিসিবি’র লাইনে এসে দাঁড়িয়েছি। 

নাসরিন আক্তার নামে আরেক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, টিসিবি’র গাড়ি আসার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনো ১২টায় আসে, কখনো আবার ২টায়। আগের দিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকেও মাল পাইনি। তাই আজকে আবার এসেছি। এখানে একজন ২  কেজি ডাল, ২ লিটার তেল আর ৫ কেজি চাল কিনতে পারে। কিন্তু এখন আর টিসিবি’র গাড়িতে চাল পাওয়া যায় না। চালের বদলে আলু দেয়া হচ্ছে। তারও মান ভালো না। এরপর এরা পণ্য অনেক কম আনে। মানুষের দাঁড়িয়ে থাকা লাইন দেখিয়ে তিনি বলেন, এই যে এত মানুষ দাঁড়িয়ে। সামনে যারা আছে তারাই শুধু পাবে। বাকিদের খালি হাতে ফিরে যেতে হবে। 

এসব বিষয়ে টিসিবি’র ট্রাক সেলের দায়িত্বে থাকা মো. মামুন ও পরিচালনার কাজে থাকা মো. স্বপন বলেন, শুক্রবার বাদে আমরা সপ্তাহে প্রতিদিনই এই টিসিবি’র পণ্য বিক্রি করি। একেক দিন একেক স্পটে। আজকে এখানে এসেছি। তিনি বলেন, আজকের এই স্পটের ৪শ’ লোকের জন্য ৮শ’ লিটার সয়াবিন তেল, ৮শ’ কেজি মশুর ডাল ও চাল নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারপরও অর্ধেকের বেশি মানুষ পণ্য পাবে না। কারণ এর চাহিদার কোনো শেষ নেই। রাত বারোটা পর্যন্তও যদি আমরা বিক্রি করি তখনো পণ্য নিতে আসবে মানুষ। কারণ এখানে যেই দামে পণ্য পাবে তা বাজারে পাবে না। কিন্তু জোগান সীমিত হওয়ায় আমাদের কিছু করার থাকে না। যতটুকু পাই ততটুকুই মানুষের মাঝে সুলভ মূল্যে বিতরণ করি। যতক্ষণ আমাদের মাল থাকবে ততক্ষণ আমরা বিতরণ করবো।

এদিকে একই দিনে মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী এলাকায় ওএমএস-এর ট্রাক সেলের আওতায় নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কম দামে চাল ও আটা বিক্রি করা হয়। সেখানে গিয়েও দেখা যায় চাহিদার তুলনায় ক্রেতা বেশি। ১৫০ টাকায় ৫ কেজি চাল ও ১৩০ টাকায় ৫ কেজি আটা নিতে ভিড় করেছেন অসংখ্য মানুষ। আটা-চাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ট্রাক সেলের দায়িত্বে থাকারা। ওএমএস-এর লাইনে দাঁড়ানো আঁখি আক্তার নামে বুদ্ধিজীবী এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ৩৮০ টাকা প্যাকেজে এখানে আমরা একেক জন সর্বোচ্চ ৫ কেজি আটা এবং ৫ কেজি চাল কিনতে পারি। বাজার থেকে অনেক কমে পাওয়া যায়- তাই এখানে আসা। কিন্তু যত মানুষ এখানে আসে তারচেয়ে পণ্য খুব কম থাকে। আজকে কিছু না পেলে আবার তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। তাই চেষ্টা করছি- যেভাবেই হোক না কেন ৫ কেজি চাল নিতেই হবে। তা না হলে না খেয়ে থাকতে হবে। 

এলাকাটির ওএমএস-এর ট্রাক সেলের দায়িত্বে থাকা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শক মো. নান্নু মিয়া বলেন, এই এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। তাই আমরা এখানে সপ্তাহে তিন দিন আসি। আজকে রায়েরবাজার বধ্যভূমির সামনে ১ টন চাল ও ২ টন আটা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পণ্যের জোগানের তুলনায় মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই সকলকে পণ্য দেয়া সম্ভব হয় না। যতক্ষণ আমাদের মাল থাকে ততক্ষণ আমাদের লোক দিতে থাকবে। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর, আদাবর, তেজগাঁও এলাকা মিলে মোট ২৩টি স্থানে ওএমএস-এর পণ্য সুলভ মূল্যে বিক্রয় করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। 

অপরদিকে তেজগাঁও রেলগেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক থেকে টিসিবি’র পণ্য নিতে আসা শিল্পী বেগম বলেন, সকাল ১০টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। গত দুই/তিন দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য নিতে পারিনি। যারা নিয়েছেন অনেকে তিন চারবার করে এসে নিয়ে গেছেন। সাফিয়া বেগম নামে ৭০ বছর বয়সী এক নারী এসেছেন টিসিবি’র পণ্য নিতে। তিনি বলেন, গত দুই দিন আমি এসে কিছুই পাইনি। সকাল থেকে বসে থেকে সন্ধ্যায় খালি হাতে ফিরে গিয়েছি। আগে অন্যজন দিতেন তিনি বেশির ভাগ সময়েই তার পরিচিত মানুষদের দেখে দেখে দিতেন বলেও অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, আমার ছেলে নাই। একা মানুষ আমি। কম দাম হওয়ায় এগুলো নিতে আসি কষ্ট করে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, তাই হাতে সিরিয়াল নাম্বার লিখে দিচ্ছেন। পাশে বসে রয়েছি, সিরিয়াল কখন আসবে জানি না। হাতে সিরিয়াল লিখে দেয়ার বিষয়ে টিসিবি পণ্য বিতরণকারী ওয়ালিদ বলেন, লাইনে দাঁড় করিয়ে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয় এজন্য সিরিয়াল নাম্বার হাতের উপরে লিখে দিয়েছি। 

এসব বিষয়ে টিসিবি’র মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ট্রাক সেলে পণ্য বিক্রিতে নানা রকম ভোগান্তি ও বিশৃঙ্খলার কথা আমরাও শুনেছি। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে আমরা চেষ্টা করছি। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে চাল সরবরাহ না করায়, আমরা চাল দিতে পারছি না বলেও জানান তিনি। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto