International

কয়েক দশকের তৈরি বাইডেনের ইউক্রেন বিপর্যয়

১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার প্রতি মার্কিন নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা বাইডেন প্রশাসনকে আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেন।

১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার প্রতি মার্কিন নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা বাইডেন প্রশাসনকে আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসন শেষ হতে চলেছে। অনেকেই তার শাসনামলকে বিতর্কিত বলে অভিহিত করেছেন। তার বিদায় রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এবং গত তিন দশকের পশ্চিমা নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে উঠতে পারে। এসব নীতি রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং তাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। তবে, এই পরিবর্তন কতটা তাৎপর্যপূর্ণ হবে, তা নির্ভর করবে নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্বসূরীদের ভুল এড়াতে কতটা সক্ষম হন, তার ওপর।

যদিও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তবে এর বীজ বপন করেছিলেন ১৯৯০-এর দশকে মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া ছিল দুর্বল এবং দিশাহীন। সে সময় রাশিয়ার নেতৃত্ব ভবিষ্যৎ বিবেচনায় পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু সেই সময় নেওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের ভিত্তি তৈরি করে, যা বাইডেনের শাসনামলে চূড়ান্ত রূপ নেয়।

ন্যাটোর পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ এই সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল না। এটি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি মোকাবিলার জন্য গঠিত হয়েছিল। তবে সমস্যা দেখা দেয় রাশিয়াকে এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার ফলে।

এই নীতির আওতায় রাশিয়াকে বাইরে রেখে ইউক্রেনকে ইউরো-আটলান্টিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এর ফলে, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া তাদের নিরাপত্তা জোরদারে মনোযোগ দেয় এবং তাদের গণতান্ত্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

এ ধরনের পরিণতি একেবারে অনিবার্য ছিল না। এটি ঘটাতে ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং চাপ জড়িত ছিল।

১৯৯৪ সালে ক্লিনটন প্রশাসন ‘শান্তির জন্য অংশীদারিত্ব’ কর্মসূচি চালু করেছিল, যা ছিল একটি বিকল্প পথ। এই কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি রাশিয়াকেও এতে যুক্ত করা। রাশিয়া এতে অংশ নিয়েছিল।

তবে, ইতিহাসবিদ মেরি সারোট তার বই ‘নট ওয়ান ইঞ্চি’তে উল্লেখ করেছেন, এ উদ্যোগ শুরুতেই ব্যাহত হয়। এর কারণ ছিল ওয়াশিংটনের কিছু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের চাপ, যারা রাশিয়ার আপত্তি উপেক্ষা করে ন্যাটো সম্প্রসারণে জোর দিয়েছিলেন। সারোট আরও উল্লেখ করেছেন, জন হার্বস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ন্যাটো সম্প্রসারণ না করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভকে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রতিশ্রুতি-ভঙ্গ রাশিয়ার দীর্ঘদিনের অভিযোগের ভিত্তি তৈরি করে।

ওই সময়কার বিজয়বাদী ও অহংকারী মনোভাব প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যেও দেখা গেছে। ১৯৯৭ সালের একটি ভিডিওতে তিনি ন্যাটো সম্প্রসারণ নিয়ে রাশিয়ার আপত্তিকে বিদ্রুপ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাশিয়ার একগুঁয়েমি চলতে থাকলে তাদের চীন ও ইরানের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। এটি তখন অবাস্তব মনে হলেও, সময়ের সঙ্গে তা বাস্তবে রূপ নেয়।

রাশিয়ার বিষয়ে কঠোর অবস্থানের এই নীতিতে বাইডেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে একজন আগ্রহী সহযোগী খুঁজে পান। বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনেন। বলা বাহুল্য, তার এই নীতিগত পরিবর্তন কোনোভাবেই কাকতালীয় ছিল না।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে শুরু হওয়া সংঘাতের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি ডনবাস অঞ্চলে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন। এই যুদ্ধবিরতি প্রায় পুরোপুরি মেনে চলায় মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

তবে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামল শুরু হওয়ার পরপরই জেলেনস্কি রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র ভিক্টর মেদভেদচুকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন। তিনি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার জন্য জোরালো প্রচারণা চালান, ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেন এবং রুশ-জার্মান নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের বিরোধিতা করেন।

জেলেনস্কির এই পদক্ষেপের পেছনে দুটি বড় কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ২০২০ সালে আজারবাইজানের সেনাবাহিনীর তুর্কি বায়রাক্টার ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়া-সমর্থিত আর্মেনিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করা। এটি দেখিয়ে দেয়, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাশিয়ার বিরুদ্ধেও সফল হওয়া সম্ভব। দ্বিতীয়ত, মেদভেদচুকের রাজনৈতিক দল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জনমত জরিপে জেলেনস্কির দলকে ছাড়িয়ে যায়।

বাইডেন শপথ নেওয়ার পরপরই জেলেনস্কি আমেরিকান সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস-এ এক সাক্ষাৎকারে সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘কেন ইউক্রেন এখনও ন্যাটোতে যোগ দিতে পারেনি?’ এর কিছুদিন পর ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা আটলান্টিক কাউন্সিল-এ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যার শিরোনামও ছিল একই প্রশ্ন।

১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার প্রতি মার্কিন নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরা বাইডেন প্রশাসনকে আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেন।

২০২১ সালের ৫ মার্চ ড্যানিয়েল ফ্রাইড, আলেকজান্ডার ভার্শবো এবং জন হার্বস্টসহ আরও কয়েকজন আটলান্টিক কাউন্সিল-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেখানে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করা, নর্ড স্ট্রিম ২ প্রকল্প ব্যাহত করা এবং কৃষ্ণ সাগরে নিরাপত্তা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।

এই ঘটনার মাত্র তিন সপ্তাহ পর পুতিন ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন শুরু করেন। ওই সময়ে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস ডিফেন্ডার অধিকৃত ক্রিমিয়ার উপকূলে প্রবেশ করে, যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করে এবং নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন কৌশলগত অংশীদারিত্ব ঘোষণা করে। রাশিয়ার দৃষ্টিতে এসব পদক্ষেপ সরাসরি আক্রমণের ইঙ্গিত বহন করেছিল।

এরপর, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করেন। এই যুদ্ধ এখন তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাপক সমর্থন সত্ত্বেও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রচণ্ড ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সংঘাতের ফলে বিশাল শরণার্থী সংকট, অর্থনৈতিক ক্ষতি, সামাজিক অস্থিরতা এবং ক্রমবর্ধমান প্রাণহানি ঘটেছে।

চলতি বছরে যদি কোনোভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তা সম্ভবত ২০২২ সালের ব্যর্থ ইস্তাম্বুল সমঝোতার ধাঁচে হবে। ওই চুক্তিতে নিরপেক্ষ ইউক্রেনের ধারণা তুলে ধরা হয়েছিল, তবে রাশিয়া তখনও অধিকৃত ভূখণ্ড ধরে রাখার জন্য চাপ দিয়েছিল।

এ ধরনের সমঝোতা ইউক্রেনের জন্য কৌশলগত পরাজয় হতে পারে, তবে জনগণের জন্য শান্তি একটি বড় জয় হবে। একইসঙ্গে, এটি পশ্চিমাদের আক্রমণাত্মক সম্প্রসারণ নীতির ব্যর্থতাও তুলে ধরবে এবং তাদের আত্মসমালোচনার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

অন্যদিকে, এই পরিস্থিতি রাশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। এটি পুতিনের শাসনামলে গড়ে ওঠা সামরিকীকরণ এবং একনায়কতন্ত্রের অবসানেও ভূমিকা রাখতে পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d