Trending

কাজই শুরু হয়নি, খরচ ১১শ কোটি

দেশের জ্বালানি তেল পরিশোধন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০১০ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরুই করতে পারেনি পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর মধ্যে পরামর্শক, প্রস্তাবনা তৈরিসহ বিভিন্ন খাতে ১১শ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সরকার বলছে, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না পাওয়ায় কাজ শুরু করা যায়নি।

পরবর্তী সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হলেও তা এগোচ্ছে না। কারণ ইআরএলের সঙ্গে একটি বেসরকারি কোম্পানি যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে সায় দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে প্রকল্পের ৮০ শতাংশ মালিকানা চায় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। তাদের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করতে জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনায় একটি কমিটি গঠন করেছে বিপিসি। যদিও বিপিসি ও ইআরএল এখনও প্রকল্পটি নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নে আগ্রহী।

এদিকে ইআরএল দ্বিতীয় ইউনিট প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় সাগর থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল আনার সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প পূর্ণ সক্ষমতায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

দেশের জ্বালানি তেলের একমাত্র সরকারি শোধনাগার ইআরএল ১৯৬৮ সালে নির্মিত হয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধন ক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল। দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা বছরে ৯০-৯৫ লাখ টন। শোধন সক্ষমতা না থাকায় জ্বালানি তেলের চাহিদার বেশির ভাগই আমদানি করা হয় পরিশোধিত অবস্থায়। ক্রুড অয়েল থেকে পরিশোধিত তেলের দাম বেশি। এতে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পেত। এ জন্য সরকার ২০১০ সালে বছরে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ২০০ একর জায়গার এক পাশের ৭০ একর জায়গায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের কথা। প্রকল্পের জন্য বাড়তি জমিও অধিগ্রহণ করা হয়। পরে সংশোধিত হয়ে প্রকল্পের ব্যয় ১৬ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের ফিড কন্ট্রাক্টর হিসেবে ফ্রান্সের টেকনিপকে নিয়োগ দেওয়া হয়। টেকনিপ প্রকল্পটির (ইআরএল-২) ডিজাইন সম্পন্ন করে। অন্যদিকে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট (পিএমসি) হিসেবে নিয়োগ পায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করে বিপিসি। এসব কাজে প্রায় ১১শ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

সরকার বিভিন্ন সময় জানায়, প্রকল্পটির জন্য বৈদেশিক ঋণ না পাওয়ার কারণে এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশের তেল পরিশোধনাগার নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটটি আকারে ছোট হওয়ায় তারা নির্মাণকাজে আগ্রহ দেখায়নি।

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। সর্বশেষ সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ২৩ হাজার ৫৮ কোটি ৯৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকারের দেওয়ার কথা ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। আর বিপিসি খরচ করবে ৬ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা। কিন্তু সেই প্রস্তাবও ঝুলে গেছে।

যৌথ বিনিয়োগ
গত ১২ অক্টোবর ইআরএলের জমিতে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল শোধনাগার নির্মাণের প্রস্তাব দেয় এস আলম গ্রুপ। প্রস্তাবনায় ৩-৫ মিলিয়ন টন সক্ষমতার নতুন রিফাইনারি নির্মাণের আগ্রহের কথা উল্লেখ করা হয়। নতুন প্রস্তাবনায় ওই প্রকল্পে এস আলম গ্রুপ এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির মধ্যে ৮০: ২০ ইক্যুইটি শেয়ার থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। এর পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে বিপিসিকে জ্বালানি বিভাগ জানায়, এস আলম গ্রুপের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি যৌথ চুক্তির (পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। জ্বালানি বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে বিপিসি গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।

এস আলম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিক বলেন, তাদের প্রাক্কলন অনুযায়ী ৫০ লাখ টনের এই তেল রিফাইনারি নির্মাণে ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। আগের পরিকল্পনার তুলনায় প্রস্তাবিত উদ্যোগে রিফাইনারির সক্ষমতা ৬৬ শতাংশের বেশি হওয়ায় বাজেট বেড়েছে। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের উচ্চমূল্য ও পরিবেশবান্ধব ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে আমাদের বিনিয়োগ বেশি লাগছে।

এ প্রসঙ্গে ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান বলেন, প্রকল্পটির ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এ ছাড়া এই প্রকল্পে বিনিয়োগের একটি বিষয় রয়েছে। সেটিও মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করা হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, প্রকল্পটি বিনিয়োগের অভাবে অনেকদিন ঝুলে আছে। তাই বেসরকারি কোম্পানি বিনিয়োগ করতে চাইলে তা ভালো খবর। কিন্তু ইআরএলের শেয়ার ও ভূমিকা কী থাকবে– সেগুলোর বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।

তবে বিপিসি ও ইআরএলের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তারা চান সরকারি অর্থায়নে বিপিসি নিজেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করুক। কারণ ইতোমধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তাদের মতে, পরিশোধন ক্ষমতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button