‘কামাই করে এক বেলার খরচও হয় না’ সরজমিন মানিকগঞ্জের দোলা গ্রাম
‘প্রতিদিন ৩০০ টাকা কামাই করি। যা দিয়ে একবেলার খাবারও হয় না। তেল, ডিম, পিয়াজ, আলুসহ সব নিত্যপণ্যের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে; ১ কেজির দামে হাফ কেজি কিনতে হয়। যার কারণে পরিবারে পুষ্টির অভাব হচ্ছে। একই সঙ্গে ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। ভবিষ্যতে কী হবে তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন। আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের জীবন না চললে দেশের উন্নয়ন দিয়ে কী করবো’? কথাগুলো বলছিলেন আমজাদ হোসেন নামে চল্লিশোর্ধ্ব এক টেক্সটাইল শ্রমিক। তিনি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের দোলা গ্রামের বাসিন্দা।
শহরের অদূরে গ্রামটিতে প্রায় ৪০০ পরিবারের বাস। যার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ নিম্ন আয়ের। জীবিকার প্রধান উৎস কৃষিকাজ।
শিক্ষার হার কম। গ্রামটির প্রধান সড়ক দিয়ে হাঁটলে মনে হবে উন্নয়নের ছোঁয়া এ গ্রামে লাগেনি। একে তো কাঁচা রাস্তা, তার ওপর খানাখন্দে ভরা। বাড়িঘর থেকে ৭ থেকে ১০ ফুট নিচু প্রায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রাস্তাটি। বর্ষায় কোমর পরিমাণ পানি উঠে যায়। তখন নৌকাই ভরসা। শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। কেউ অসুস্থ হলে ভোগান্তি আরও চরমে পৌঁছায়।
মানিকগঞ্জের দুই সংসদীয় আসনের সীমানায় অবস্থিত হওয়ায় গ্রামটি নিয়ে জনপ্রতিনিধিদেরও আগ্রহ কম। নির্বাচন আসলে ভোটের জন্য তারা ওই গ্রামে যান। এরপর আর খোঁজ থাকে না। এলাকাটির সংসদ সদস্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বর্তমান বাস্তবতায় এ গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস তাদের। নুন আনতে পানতা ফুরায় অধিকাংশের। সরকারের সহায়তাও তেমন একটা পান না এ এলাকার মানুষ। সোমবার সরজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে এলাকাটিতে। তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে আয়ের হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এলাকার রাস্তা ঠিক না হওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের অনাগ্রহকে দায়ী করেন তারা। আমজাদ হোসেন বলেন, আমরা রাজনীতি বুঝি না। আমরা চাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকুক। সরকার সেটি নিয়ে কাজ করুক। তিনি বলেন, নবগ্রাম ইউনিয়নের অবহেলিত কোনো গ্রাম থাকলে সেটি এই দোলা। গত রোববার আমার স্ত্রী অসুস্থ হওয়ায় তাকে কোলে করে নিতে হয়েছে। কারণ গাড়ি চলার পরিস্থিতি নেই।
শিল্পী আক্তার নামে এক গৃহবধূ বলেন, আমার স্বামীর বর্তমান আয় দিয়ে পরিবার চলতে কষ্ট হচ্ছে। জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। অন্যদিকে আমাদের উৎপাদিত সরিষা ও ধানের দাম পাওয়া যায় না। সড়কের পাশে কাপড় শুকাতে দিচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা হাজেরা খাতুন। তিনি বলেন, আমার স্বামী আগে কৃষিকাজ করতেন। অসুস্থতার কারণে ৪ থেকে ৫ বছর ধরে ঘরে বসা। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে; তাই চলতে কষ্ট হয়। মেয়েরা মাঝেমধ্যে কিছু চাল-ডাল এনে দেয়, তারপর চলা কষ্ট হয়। আজও কেবল ডাল-ভাত রান্না করেছি। এটা দিয়েই চলবে। তিনি বলেন, আমার ঘর নেই। সরকার না কি ঘর দিয়েছে অনেককে। কতো করে বলেছি- চেয়ারম্যান-মেম্বারকে কিন্তু আমাকে একটা ঘর দেয়নি। আমার ঘরটা ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। ছাপড়ার মধ্যে থাকি।
দোলা গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক জিনিসই খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। বিশেষ করে তেল ও পিয়াজ। ছোট্ট দোকান আর কৃষিকাজের আয় দিয়ে চলতে কষ্ট হয়ে যায়। সরকারি কিছু কিছু সহায়তা পেলেও কষ্ট হয়ে যায়। অন্যের জমিতে কাজ করে বাড়ি ফেরার পথে পঞ্চাষোর্ধ্ব মুন্নুু মিয়া বলেন, কাজ করে পাইছি ৩০০ টাকা। কিন্তু পরিবারের খরচ ৫০০ টাকা। বাকি ২০০ টাকা কই পাবো? জমিতে কাজে যাচ্ছিলেন আসমা আক্তার। মাঝবয়সী এই গৃহিণী বলেন, আদার দাম ২০০, তেল ১৯০, পিয়াজ ১২০ টাকা কেজি। এসব কিনতে গেলে অনেক কষ্ট হয়। স্বামী ইটের ভাটায় কাজ করে। আমিও টুকটাক কাজ করি। কিন্তু সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যায়। এলাকার রাস্তা নিয়ে তিনি বলেন, এ রাস্তাটার কারণে আমাদের কষ্টের অন্ত নেই। দুই চেয়ারম্যান এক হয়ে কাজ করে না। একে অপরের দিকে ঠেলে। বৃষ্টি নামলে কষ্ট বেড়ে যায়। বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না।
এ গ্রামেরই বাসিন্দা একজন কৃষক বলেন, জন্মের পর থেকেই এই রাস্তার অবস্থা এমন। কোনো সরকারই রাস্তাটা ঠিক করেনি। তিনি বলেন, কৃষিকাজ করে খাই। সব জিনিসের দাম বেশি হওয়ায় পেরেশানির মধ্যে রয়েছি। সারের দাম বেড়ে গেছে অনেক। আগে ইউরিয়া কিনতাম ৭০০ টাকায় এখন ১৩ থেকে ১৪শ’ টাকায় কিনতে হয়। অটো রিকশা চালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, অটোর ইনকাম দিয়ে পরিবার চালাতে কষ্ট হয়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় কী নিয়ে কী করবো বুঝে উঠতে পারি না। আমাদের সবই কিনে খাওয়া লাগে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পাই না।
জনপ্রতিনিধিদের বলেও লাভ হয়নি। চাই সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখুক। এলাকার রাস্তা নিয়ে তিনি বলেন, এ রাস্তা ঠিক হয় না কখনো। কেউ ঠিক করে না। বর্ষাকালে এখানে হেঁটে যেতেই কষ্ট হয়। এ গ্রামের প্রবেশ পথেই অবস্থিত বরঙ্গাখোলা। সেখানকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান পলাশ জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি খুবই কষ্টে আছেন। বলেন, সরকারের কাছে চাওয়া- যেনো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যারা খেটে খাওয়া মানুষ তাদের জন্য অন্তত একটা ভালো ব্যবস্থা করে। খুবই কঠিন অবস্থার মধ্যে আছি। আমার বাচ্চার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলের বেতন দিতে পারি না। চাল আনতে গেলে ডাল শেষ হয়ে যায়। ডাল আনতে গেলে লবণ ফুরিয়ে যায়। সরকার ৫০০ বছর থাক তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। তিনি বলেন, শীতের মধ্যে যে কষ্ট পেয়েছি তাতে একটা কম্বলও পাইনি। চা দোকান করে ৬ সদস্যের পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। একটি পুকুর থেকে কলসিতে করে পানি নিয়ে ফিরছিলেন একজন গৃহবধূ। কথা বলার সময় নিজের নাম বলতে চাইছিলেন না।
তিনি জানান, তার স্বামী মাসে আয় করে ১০ হাজার টাকা। তা দিয়ে তিন বাচ্চার ব্যয়ই হয় না। অন্যগুলো কেমনে চালাই। বরাঙ্গাখোলায় একটি ছোট্ট চায়ের দোকান চালান মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, দু’টা ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে। দুইবার স্ট্রক করেছি। যে পরিস্থিতি চলছে ২০০ টাকা আয় করলে ৫০০ টাকা খরচ। ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু গাড়ি ভাড়াও দিতে পারি না। দোলা গ্রামের দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে গ্রামটির বাসিন্দা ও সাবেক সেনাসদস্য জামাল হোসেন বলেন, আমাদের গ্রামে প্রায় ৪০০ পরিবারের বাস। যাদের বেশির ভাগই গরিব। কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। মানিকগঞ্জ জেলার মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত। এখানে ৫ শতাংশ মানুষেরও উন্নয়ন হয়নি।
এখানকার কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। অথচ যখন সারসহ অন্যান্য জিনিস কিনতে যায় তখন অনেক দামে কিনতে হয়। গ্রামের রাস্তা নিয়ে তিনি বলেন, রাস্তাটা দিয়ে ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ দৈনিক যাতায়াত করে। কিন্তু রাস্তাটা অনেক নিচু। বর্ষাকালে কোমর পর্যন্ত পানি হয়ে যায়। নৌকা ছাড়া চলা যায় না। মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। কেন যে এটা হয় না তা আমরা জানি না। আমি নিজেও কয়েক জায়গায় যোগাযোগ করেছি কিন্তু কাজ হয়নি। নবগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গাজী হাসান আল মেহেদী মানবজমিনকে বলেন, গ্রামটি খুবই পিছিয়ে পড়া।
এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়নি। তারা সাধারণত কৃষিকাজ ও শ্রমিকের কাজ করে থাকে। শিক্ষার হারও কম হওয়ায় দীর্ঘ বছর যাবৎ তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি বলে কেউ বাইরে গিয়ে কাজ করবে- এমন মানসিকতাও নেই। তারা কোনোরকম খেয়ে বেঁচে থাকে। তিনি বলেন, শুধু দোলা গ্রাম নয়, গত ৩০ বছরে নবগ্রাম ইউনিয়নে কোনো উন্নয়ন হয়নি। কোনো জনপ্রতিনিধি কাজ করেনি। আমরা এখন চেষ্টা করছি আস্তে আস্তে কাজ করতে। সরকার থেকে কাজ আনার জন্য যোগাযোগ করেছি। একটা একটা করে আমরা উন্নয়নমূলক কাজ করবো।