Bangladesh

কারচুপি ও অস্বাভাবিক ভোটের অভিযোগ পরাজিত প্রার্থীদের

সংসদ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন ভোটে হেরে যাওয়া অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী। এ দলে আছেন নৌকা, লাঙ্গলের প্রার্থীসহ স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ নেতাও। পরাজিত অনেক প্রার্থীর অভিযোগ– ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরানো হয়েছে। ভোটের হারও অস্বাভাবিক। প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছেন তাদের কয়েকজন। 

আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচনকে সুষ্ঠু বললেও দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ, বরগুনা-১ আসনের আওয়ামী লীগের পাঁচবারের এমপি ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু, মানিকগঞ্জ-২ আসনের এমপি মমতাজ বেগম, জাসদ সভাপতি ও কুষ্টিয়া-২ আসনের নৌকার প্রার্থী হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-২ আসনের নৌকার প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা, কিশোরগঞ্জ-২ আসনের নৌকার প্রার্থী আবদুল কাহার আকন্দ, ঢাকা-৪ আসনের নৌকার প্রার্থী সানজিদা খানম ভোটে এবং গণনায় কারচুপির অভিযোগ করেছেন। 

গেল রোববার ভোটের দিন বিকেল ৩টায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানিয়েছিল, ভোটের হার ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। তবে রাতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানান, ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে। ইসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ভোটের হার ৪১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বিকেল ৪টায় ভোট গ্রহণ শেষ হয়। শেষ ঘণ্টায় ভোটের হার প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। অন্যান্য দলের অভিযোগ, সারাদিন যেসব কেন্দ্র ফাঁকা ছিল সেখানে ভোটের হার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের অভিযোগ তুলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সরকার যেখানে যেমন চেয়েছে, সেখানে তেমন নির্বাচন হয়েছে।

বিএনপিহীন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে দলের মনোনয়নবঞ্চিতদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আসনভিত্তিক ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জাতীয় পার্টি যে ১১ আসনে জয়ী হয়েছে, এর দুটি বাদে সবক’টিতে ৩০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। ৮০টি আসনে ভোটের হার ছিল ৫০ শতাংশের বেশি। এর ৭৯টিতে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। এসব আসনের অধিকাংশে নৌকার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। যেসব আসনে দলের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে, সেখানে ভোটের হার কম। আর যেসব আসনে একপেশে ভোট হয়েছে, সেখানে উপস্থিতি বেশি। সাধারণত, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, সেখানে ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকে। 

একাধিক প্রার্থী জানিয়েছেন, যেখানে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না, সেখানে এক দলের প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ এজেন্ট দিতে পারে না। ফলে একটি দলের কর্মীরা অনিয়মের সুযোগ পায়। একাধিক শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীরা একজন অন্যজনকে অনিয়ম থেকে ঠেকায়। ভোট কারচুপিতে বাধা দেয়।

গাইবান্ধা-১ আসনের দুইবারের এমপি জাপার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে এবারও আসন ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তিনি ২৬ হাজার ভোটের ব্যবধানের হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। শামীম হায়দার বলেন, ‘ভোট কারচুপি হয়েছে। ৯০ শতাংশ কেন্দ্রে  দুই-তিনজনের বেশি ভোটার দেখিনি। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নগণ্য ভোটার উপস্থিতি ছিল। কিন্তু দিন শেষে যে কাস্টিং দেখলাম, মনে হয়েছে ভোট কারচুপি হয়েছে।’

নৌকার কয়েকজন পরাজিত প্রার্থীও একই অভিযোগ তুলেছেন। কুমিল্লা-২ আসনের এমপি এবং নৌকার পরাজিত প্রার্থী সেলিমা আহমাদ সমকালকে বলেন, প্রশাসন নিরপেক্ষ ছিল না। সাতটি কেন্দ্র দখল করে নেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল মজিদের সমর্থকরা। তারা ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরেন। নৌকার এজেন্ট ও কর্মীদের মারধর করেন। 

১ হাজার ৯৬৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়া সেলিমা আহমাদ সাতটি কেন্দ্রের ফল বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন। ১৮টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে অভিযোগ করে হাইকোর্টে রিট করেছেন সানজিদা খানম। ২ হাজার ১৯৮ ভোটে পরাজিত সাবেক এই এমপির অভিযোগ, ওইসব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের আগেই ফলাফল শিটে সই নেওয়া হয়। ভোটেও কারচুপি হয়েছে। 

ভোট চলাকালে অন্তত ৪৬ প্রার্থী নির্বাচনে জালজালিয়াতির অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না শঙ্কায় ভোটের আগেই জাপার ২১ জনসহ অন্তত ৬০ প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে যান। মানিকগঞ্জ-২ আসনে টানা দুইবারের এমপি ছিলেন আওয়ামী লীগের মমতাজ বেগম। বিখ্যাত এই লোকসংগীত শিল্পী এবার ৬ হাজার ১০২ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদের কাছে। মমতাজের অভিযোগ, মানিকগঞ্জ-২ আসনে ভোটের হার অস্বাভাবিক ছিল। তিনি বলেন, ‘সিংগাইর উপজেলার বলধরা, বায়রা ইউনিয়ন ও সিংগাইর পৌরসভার কেন্দ্রগুলোতে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। বিদেশে আছে, মারা গেছে– তাদের ভোটও দেওয়া হয়েছে। অন্য জায়গায় পাস করলেও এসব এলাকায় অস্বাভাবিক ভোট হওয়ায় পরাজিত হয়েছি।’

প্রভাবশালী নেতা আবদুস সোবাহান গোলাপ কেন্দ্র দখলের অভিযোগ তুলেছেন নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘কালকিনি পৌরসভার ১৬ কেন্দ্রের ১২টি  দখলে নিয়ে ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। এই ১২ কেন্দ্রে নৌকার কেউ ছিল না। এ কারণে ঈগল একচেটিয়া সেখানে ভোট কেটে নিয়ে গেল। অন্য কয়েকটি ইউনিয়নেরও তারা একচেটিয়া ভোট নিয়ে গেল।’

কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান এমপি  জাফর আলম ভোট চলাকালে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেন। তিনি বলেন, বরগুনা-১ আসনে কারচুপির লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু। এতে বলা হয়েছে, ‘ফলাফলে ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম ও বেআইনি কার্যকলাপ হয়েছে।’ অভিযোগপত্রের সঙ্গে ১৮টি কেন্দ্রের ফলাফল বিবরণী দেওয়া হয়েছে। 

রাজশাহী-২ আসনের নৌকা প্রতীকের পরাজিত প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা সিইসিকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির নির্দেশে, সব ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুবিধাভোগীর কার্ড আটকে রেখে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাঁচি প্রতীকে ভোট দিতে চাপ দেন। নির্বাচনের আগের রাতে ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিজাম-উল আজিমকে এসব তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যৌথবাহিনী আটকও করে। তবে অন্যান্য ওয়ার্ডে সেই একই প্রক্রিয়া চলমান থাকে।

কুষ্টিয়া-২ আসনে প্রায় ২৩ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিপক্ষে পরাজিত হয়েছেন হাসানুল হক ইনু। তাঁর অভিযোগ, সিলেক্টিভ কারচুপি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে পরাজিত হয়েছি।’

ময়মনসিংহের ১১ আসনের ১০টির ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ৬টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। সেখানে ভোটার উপস্থিতি ছিল ২৫ থেকে ৩৯ শতাংশ। ময়মনসিংহ-২ এবং ময়মনসিংহ-১০ আসনে নৌকার প্রার্থীরা ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলেও ময়মনসিংহ-১১ আসনে জেলার সর্বোচ্চ ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। নির্বাচন বর্জন করা দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী কায়সার আহমেদ ও ড. আবুল হোসেন দীপু ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করেছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে। তারা দু’জনই বলেছেন, সারাদিনে কোনো কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন না। তারা নিজের ভোটও দিতে পারেননি। নৌকার প্রার্থী ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের কর্মীরা কেন্দ্রে দরজা বন্ধ করে সিল মেরেছে। সাধারণ মানুষকে ভোট দিতে দেয়নি। এমন চারটি কেন্দ্রে ভিডিও দেখিয়েছেন দুই প্রার্থী।

সিলেট-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলছেন, ব্যাপক অনিয়ম, সন্ত্রাস ও জালিয়াতি হয়েছে। ভোটের দিন দুপুরের পর থেকেই জাল ভোটের মহোৎসব হয়।

রাজশাহী-৬ আসনে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রাহেনুল হক। পাবনা-১, নোয়াখালী-২, ফরিদপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন ইসিতে। ফরিদপুর-১ আসনে ৫০ কেন্দ্রে ভোটের শেষ ঘণ্টায় ব্যাপক অনিয়ম ও ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ দিয়েছেন।
নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব এবং  নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের পরাজিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। তিনি বলেন, ইসি সচিবের বক্তব্য সবাই শুনেছেন, নির্বাচন কতটা বিতর্কিত হয়েছে।

বগুড়া-৪ আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম অভিযোগ করেন, সরকার পাতানো নির্বাচনের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করতে বাংলাদেশ কংগ্রেসসহ ভোটে আসা সব রাজনৈতিক দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের টাকা দিয়েছে। এই অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারবেন বলে দাবি করেছেন হিরো আলম।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d