Bangladesh

কারা হেফাজতে বাড়ছে মৃত্যু

  • চলতি বছর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কারা হেফাজতে ৯০ জনের বেশি বন্দির মৃত্যু 
  • ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি কারা হেফাজতে মৃত্যু
  • কারাগারে অসুস্থ হয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের তিন নেতার মৃত্যু

চলতি বছর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯০ জনের বেশি বন্দির মৃত্যু হয়েছে কারা হেফাজতে। এর মধ্যে গত আগস্ট থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত বিএনপি নেতা রয়েছেন। শুধু তাই নয়, গত ২৫ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে এক সপ্তাহের মধ্যে কারাগারে অসুস্থ হয়ে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের তিন নেতা মারা যান। মানবাধিকার সংগঠনের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এসব মৃত্যুর বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অভিন্ন হলেও, পরিবার ও বিএনপির নেতারা নির্যাতনের অভিযোগ তুলছেন।

বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) কারা হেফাজতে মৃত্যুর তথ্য দেয়। সংস্থাটি গত ১১ মাসের যে তথ্য দিয়েছে তাতে দেখা যায়, এ সময়ে ৯৩ জন আসামি কারা হেফাজতে মারা গেছেন। এর মধ্যে বিচার শেষের আগে ৫৩ ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ৪০ জন। সবচেয়ে বেশি কারা হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন কারাগারে। এ সংখ্যা ৬২ জন (বিচারের শেষের আগে ৩৫ ও সাজাপ্রাপ্ত ২৭ জন)। আসকের হিসাবে ২০২২-এর ১২ মাসে কারা হেফাজতে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল অসুস্থতায়। এর আগে ২০২১ সালে এমন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮১ জন। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের চেয়ে চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসেই কারা হেফাজতে ২৮ জনের বেশি মৃত্যু হয়েছে। বিগত কয়েক মাসে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হচ্ছেন নিয়মিত। অনেকের সাজা হচ্ছে। এমনিতেই কয়েক বছর ধরে কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দি অবস্থান করছে। ‘রাজনৈতিক’ মামলায় গ্রেপ্তারের পর সেখানে বন্দির সংখ্যা আরও বাড়ছে।

গত ১৮ নভেম্বর নাশকতার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হন নাটোর সিংড়া উপজেলার হাতিয়ান্দহ ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক এ কে আজাদ সোহেল (৩৮)। নাটোর কারাগারে অসুস্থ হলে ২৯ নভেম্বর তাকে পাঠানো হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই পরদিন জামিন পান। তবে জামিন পেলেও মুক্তির স্বাদ পাননি। ৭ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। আজাদের পরিবার ও স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নির্যাতনে স্ট্রোক করলেও তাকে যথাযথ চিকিৎসা দিতে বিলম্ব করা হয়েছে। অবশ্য পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, আজাদকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসেন চট্টগ্রামের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি গোলাপুর রহমান (৬৩)। সমাবেশের আগের দিন নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে থেকে তাকেসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গোলাপুরকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। ২৫ নভেম্বর কারাগারে অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। কারাগার থেকেই তার পরিবারকে মৃত্যুর খবরটি দেওয়া হয়।

গণমাধ্যম ও বিএনপির ওয়াকিবহাল সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর মাতুয়াইলে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি কেন্দ্র করে সংঘর্ষের মামলায় গত ২৯ জুলাই গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলী (৬০)। আদালতের মাধ্যমে তাকে পাঠানো হয় কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। গত ১০ আগস্ট অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওইদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র গত ২৬ জুলাই ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ১৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও বিএনপির পশ্চিম মালিবাগ ইউনিট শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশারকে (৩৬) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে রাখা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ২১ আগস্ট অসুস্থ ও অচেতন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ঢাকা মহানগর ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য ইমতিয়াজ হাসান বুলবুলকে গ্রেপ্তারের পর ২৬ নভেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখান থেকে তাকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আনা হলে ৩০ নভেম্বর কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

বিএনপির ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ কেন্দ্র করে বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন গাজীপুরের শ্রীপুরের কাওরাইদ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান খান হীরা। ২৯ অক্টোবর গাজীপুর জেলা কারাগার থেকে তাকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কারা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের ভাষ্য, বুকে ব্যথা শুরু হলে গত ১ ডিসেম্বর তাকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে তিনি মারা যান।

নাশকতার এক মামলায় রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও একই ওয়ার্ডের যুবদলের সাবেক সভাপতি মনিরুল ইসলামকে (৫২) গ্রেপ্তারের পর ৭ নভেম্বর থেকে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, গত ১০ ডিসেম্বর কারাগারে অচেতন হয়ে পড়লে মনিরুলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

৫৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা ইদ্রিসের মৃত্যুর ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে দলের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে অগ্রগতি নিয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি কমিটির সদস্য ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতাদের যে মৃত্যুগুলো হয়েছে, তাতে প্রশ্নের উদ্রেক করে। পরিবারগুলোও নির্যাতনের অভিযোগ তুলছে। আমরাও বলে আসছি, বিচারিক তদন্তের মাধ্যমে এ মৃত্যুগুলোর সঠিক কারণ অনুসন্ধান হোক। তাহলেই বোঝা যাবে এগুলো স্বাভাবিক, নাকি অস্বাভাবিক মৃত্যু।’

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের জেলখানাগুলোতে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়। সেখানে মানুষের জীবনের ঝুঁকি এমনিতেই বাড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, কারাগারে যারা দায়িত্বে আছেন সরকারের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তো তাদের নেই। সরকার যদি বলে কাউকে রাজার হালে রাখো, তারা রাখবে। আর যদি বলে কাউকে অবহেলা করো, তারা তাই করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হেফাজতে থাকার অর্থ হলো যিনি হেফাজতকারী তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। এখন সেটি যদি সঠিকভাবে না হয় তাহলে আরও মানুষ মরবে। তবে সময় সুযোগে এসব ঘটনায় যদি তদন্ত কমিশন হয়, সে ক্ষেত্রে অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে।’

আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘সম্প্রতি বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার মৃত্যু হয়েছে। যাদের আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রিমান্ড বা জেলখানার ভেতরে কী হয় তা আমরা সরাসরি না দেখলেও অনুধাবন করতে পারি। কারাগারে যথেষ্ট জায়গা নেই। সুব্যবস্থাও নেই। এ ছাড়া আঘাত বা নির্যাতন করা এগুলো তো আছেই। সব মিলিয়ে কারাগারে অমানবিক পরিবেশে বাস করছে বন্দিরা। কিন্তু এমন পরিবেশে বন্দিরা নিয়মিত মারা গেলেও, কাউকে কখনো জবাবদিহি করতে হয় না।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button