কালো বিড়ালের থাবা বনে
♦ বনের রাজা ওসমান গনির উত্তরসূরিরাই এখন শীর্ষ পদে ♦ বিভিন্ন পদ ওঠে নিলামে, বদলির পাশাপাশি নিয়োগেও হয় বাণিজ্য ♦ শেষ নেই লুটপাটের
কালো বিড়ালের থাবা থেকে রাহুমুক্ত হতে পারেনি বন বিভাগ। শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অনিয়মে উজাড় হচ্ছে বন। অন্যদিকে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে সিন্ডিকেট গড়ে চলছে লুটপাট। দুর্নীতি দমন কমিশনের হুঁশিয়ারি, নোটিসেও বন্ধ হচ্ছে না বন বিভাগের দুর্নীতি। ওয়ান-ইলেভেনের আলোচিত ‘বনের রাজা’ ওসমান গনির উত্তরসূরিরাই এখন বনের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। তাদের ভয়াবহ অনিয়মে দেশের বনভূমি উজাড় হচ্ছে। জানা গেছে, বনের বিভিন্ন পদ নিলামে ওঠে। সুন্দরবন, পার্বত্য এলাকার বড় পদগুলো নিয়ে চলে দরকষাকষিও। কোটি কোটি টাকার নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে শীর্ষ কর্মকর্তারা জড়িত থাকার কারণে বন বিভাগে লুটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে।
জানা গেছে, খোদ প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী থেকে শুরু করে ঢাকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সাজ্জাদ হোসেনসহ অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের তীর। বর্তমান বন ও পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী দায়িত্ব নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়ম দূর ও বদলি বাণিজ্য বন্ধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালীন বন অধিদফতরে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এবং পদায়নে অর্থনৈতিক লেনদেন ও অনিয়মের ১৬টি গুরুতর অভিযোগ পান। সে অভিযোগগুলো আমলেও নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনেও বন বিভাগে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, জবরদখল করা বনভূমি পুনরুদ্ধারে ব্যর্থতা, বন আইন লঙ্ঘন করে নানা কর্মকাণ্ড, বনভূমির জমির দাগ ও খতিয়ানে ইচ্ছাকৃত ভুল তথ্য সংযোজন করে বনভূমি জবরদখলের সুযোগ প্রদান, ভূমিসংক্রান্ত দফতরগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে ভুয়া দলিল ও নথি তৈরি করে বনের জমি অন্যের নামে রেকর্ড করা, বনায়ন প্রকল্পের ৬১ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ আত্মসাৎ, বন অধিদফতরের সব স্তরে আর্থিক অনিয়মসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
সর্বশেষ গত ২৪ মার্চ দ্বাদশ জাতীয় সংসদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম বৈঠকে বন বিভাগ থেকে দুর্নীতি দূর করার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল সংরক্ষণসহ নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টির ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। জানা গেছে, মহাখালীতে অবস্থিত বন ভবনটি আগাগোড়া একটি দুর্নীতির আখড়া। ডিএফও থেকে বিট কর্মকর্তা পর্যন্ত সব স্তরে চলে ভয়াবহ বদলি বাণিজ্য। বন রক্ষার নামে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে টাকা লুটপাট, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ কামাতেই সময় পার করেন এখানবার কর্মকর্তাদের বড় অংশ। ফলে আলোচনার বাইরে থাকা এ বিভাগে কয়েক বছর চাকরি করেই অনেকে বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে যাচ্ছেন। বাড়ি কিনছেন বিদেশেও। পাচার করছেন অবৈধ অর্থ। অনেক কর্মকর্তার বাড়িতে অভিযান চালালে ওসমান গনির মতো টাকার বস্তা বেরিয়ে আসবে। সূত্রমতে, অর্থের বিনিময়ে ফরেস্টারদের বন বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ রেঞ্জগুলোর রেঞ্জ কর্মকর্তার চেয়ারে বসিয়ে দেওয়ার অভিযোগের শেষ নেই। অর্ধযুগ পার হলেও একই স্টেশনে পোস্টিং রাখা, নিজ এলাকায় পোস্টিং দেওয়াসহ সবকিছুই হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। টাকা ছাড়া বন বিভাগে কোনো কাজ হয় না।
উল্লেখ্য, বনের রাজা উপাধি পাওয়া সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ওসমান গনির বাসায় ২০০৭ সালে অভিযান চালিয়ে বালিশের ভিতর, তোশকের নিচে, চালের ড্রামে, ওয়্যারড্রোবে, আলমারিতে ও বাসার আনাচে-কানাচে মিলেছিল কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। মামলা হওয়ার পর ২০০৭ সালের ১৮ জুন তিনি কারাগারে যান। দুর্নীতির অভিযোগে আদালত তাকে ১২ বছর কারাদণ্ড দেন। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুবিধাবঞ্চিত বন বিভাগেরই বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা বলছেন, বন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাড়িতে দুদক অভিযান চালালে সাবেক বনের রাজা ওসমান গনির বাসার চেয়ে আরও অনেক সম্পদ মিলবে। অনুসন্ধান করলে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার, নামে- বেনামে বাড়ি-গাড়ি ক্রয়সহ নানা তথ্য সামনে আসবে। এদিকে সাবের হোসেন চৌধুরী এ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিবাজরা আতঙ্কে আছেন। পরিবেশ, বন রক্ষায় তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ মানুষ। তবে বন বিভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাঁটি গাড়া দুর্নীতিবাজদের এ ভয়াবহ সিন্ডিকেট মন্ত্রী ভাঙতে পারবেন কি না সেটাই এখন প্রশ্ন। কারণ অনিয়মের পাহাড়ে বসে থাকা লুটপাটকারীদের সিন্ডিকেট বিশাল। ঘাটে ঘাটে রয়েছে তাদের প্রভাব।
কমছে বনভূমি : বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অনিয়মের কারণে বাংলাদেশের সবুজ শেষ হচ্ছে। এ বিভাগের কর্মকর্তারা যা খুশি তাই করেন। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। শুধু ‘উপর’কে খুশি রাখতে পারলে সব হয়ে যায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট পরিচালিত প্ল্যাটফরম গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্যানুযায়ী, দেশে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালে ৫৩ হাজার একর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে। এর আগের বছর কমেছিল ৫৪ হাজার ৬১০ একর বন। ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৪ লাখ ৯৪ হাজার ২১১ একর। ২০২০ সালে সারা দেশে ১ হাজার ১৩৬ একর আদি বন ধ্বংস হয়েছে। টিআইবি তাদের গবেষণায় এসব বন ধ্বংসের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনিয়মকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু প্রকল্পের টাকা লুটপাটের জন্য সংরক্ষিত বনের গাছ রক্ষার চেয়ে বৃক্ষ রোপণে বেশি আগ্রহ বন বিভাগের।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যাদের ওপর বন সুরক্ষার দায়িত্ব, তারাই বনের ক্ষতি করছে। বন বিভাগ বনে বসবাসকারী আদিবাসীদের উৎখাতে যতটা তৎপর, তার তুলনায় মোটেই তৎপর না দখলবাজদের দখল ঠেকাতে। অথচ আদিবাসীরা বনকে রক্ষা করে। এখানে সরকারেরও দায় আছে। বনায়নে যতটা জোর দেওয়া হয়েছে, বন সুরক্ষায় ততটা জোর দেওয়া হয়নি। দুটো আলাদা বিষয়। সরকার নিজেই বনের জন্য ক্ষতিকর নানা প্রকল্প গ্রহণ করছে। বন ধ্বংস করে নানা স্থাপনা তৈরির অনুমোদন দিচ্ছে। এ কারণেই বন কমে যাচ্ছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সদস্যসচিব শরীফ জামিল বলেন, বন ধ্বংসের পেছনে বন বিভাগের দায়িত্বে অবহেলা যেমন আছে, নীতিনির্ধারকরাও বনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন না। বনের জায়গা লিজ দেওয়া হচ্ছে। ঘরবাড়ি, শিল্পকারখানা হচ্ছে। দখল হয়ে যাচ্ছে। এসব অপরাধে জড়িতদের শাস্তি হচ্ছে না। এখানে জবাবদিহিতা নেই। অথচ আমাদের মতো জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশের জন্য বনভূমি ধ্বংসের পরিণতি ভয়াবহ।
বন অধিদফতর থেকে প্রকাশিত তথ্যকণিকা-২০২৩ এ দেখা গেছে- সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ ২৩ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট আয়তনের ১৫.৫৮ ভাগ। বন অধিদফতর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ ১৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের আয়তনের ১০.৭৪ ভাগ। বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের ২২.৩৭ ভাগ। একই চিত্র ছিল তথ্যকণিকা-২০১৯-এ। চার বছরের ব্যবধানে বন বা বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বাড়েওনি, কমেওনি। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বনায়নকেন্দ্রিক হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ফল কী? আবার যেসব এলাকার বন উজাড় হচ্ছে সেই হিসাব কোথায়? আইওয়াশ হিসেবে বছরের পর বছর একই তথ্য কপি পেস্ট করে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে যাচ্ছে বন বিভাগ। সেই ফাঁকে উজাড় হচ্ছে বন, দখল হয়ে যাচ্ছে বনভূমি।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, বিশ্বব্যাপী ২০০০-২০১৫ সময়ে প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। বাংলাদেশে তা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ একর। সারা দেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনভূমি জবরদখল করে রেখেছেন ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ জন। দখলের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি সংরক্ষিত বনভূমিও। ৮৮ হাজার ২১৫ জনের দখলে রয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ দশমিক শূন্য ৬ একর সংরক্ষিত বনভূমি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এ জবরদখলের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে খোদ বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। কখনো বনের জমি ভুল তথ্য দিয়ে অন্যের নামে রেকর্ড করিয়ে দিচ্ছে। আবার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে। এখানেও অনিয়মের শেষ নেই। বনের রাজারা সরাসরি ভয়ংকর অনিয়মের মাধ্যমে সব করেন। বনের প্রধান কার্যালয়ের এখনকার রাজাদের বসবাস অনিয়মের পাহাড়ে। তাদের কোনো কিছু তোয়াক্কা না করার কারণ হিসেবে জানা গেছে, তারা এক হাতে নেন। আবার অন্য হাতে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সব খানে সিন্ডিকেট বানিয়ে প্রভাব খাটান। তাদের লাগামহীন ক্ষমতার জোরে বনের সর্বনাশ হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের মতে, সাবের হোসেন চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকে আশার আলো দেখছেন। সবাই বলছেন, বনখেকো, লুটপাটকারী কালো বিড়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই সময়।
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বনের জমি জবরদখল করে ব্যাঙের ছাতার মতো নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। সরেজমিনে দেখা গেছে, সংরক্ষিত বনের ভিতরেই গড়ে উঠছে ছোট-বড় পাড়া-মহল্লা ও হাট-বাজার। তৈরি হয়েছে মৎস্য খামার, রিসোর্ট ও শিল্পকারখানাও। স্থানীয় বিট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে বেচাকেনা হচ্ছে বনের জমি। সেই বিক্রির টাকার ভাগ যাচ্ছে অসাধু বন কর্মকর্তাদের পকেটেও। সংরক্ষিত বনের সরকারি গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। খাড়াজোড়া এলাকায় বন বিভাগের চন্দ্রা চেকপোস্ট থাকলেও টাকা দিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক, কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া ও মৌচাক-ফুলবাড়িয়া সড়ক দিয়ে এসব গাছ পাচার হচ্ছে।
অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন করে প্রধান বন সংরক্ষককে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনে এসএমএস পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।