কাশ্মীরে ক্রমবর্ধমান তাপ মানুষের স্বাস্থ্য ও ফসলের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে

জাইনা বেগম তার শুকিয়ে যাওয়া ধানক্ষেতের পাশে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার এই কৃষক এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছেন, যাতে ক্ষেতের ফসলকে বাঁচাতে পারেন। তাই এই সপ্তাহের শুরুতে যখন অবশেষে বৃষ্টি হল, তখন তিনি আশাবাদী হয়ে উঠলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জাইনা বেগমের জমি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গিয়েছিল। হিমবাহে ভরা এবং শীতল জলবায়ুর জন্য পরিচিত মনোরম হিমালয় অঞ্চল কাশ্মীরে এবার তীব্র গরম পড়েছে। চলতি মাসে তাপমাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সেইসঙ্গে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ দেখা দিয়েছে।
এই অঞ্চলে ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দিনের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭.৪ সেলসিয়াস (৯৯.৩২ ফারেনহাইট) – যা মৌসুমী গড় থেকে কমপক্ষে ৭ সেলসিয়াস বেশি। উপত্যকায় গত জুন মাস ছিল গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গরম, যার ফলে কর্তৃপক্ষ স্কুল-কলেজ দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেয়। এই সপ্তাহের শুরুতে এই অঞ্চলের কিছু অংশে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই স্বস্তি সাময়িক এবং আগামী দিনগুলোতে আরও তাপমাত্রা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিবর্তিত আবহাওয়ার ধরণ স্থানীয়দের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে যাঁরা জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। অনেকেই ব্যবসায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন, আবার অনেকে অভিযোগ করছেন যে ফসলের মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে তাদের বিশাল ক্ষতি হচ্ছে। বেগমের পরিবার চেরসু গ্রামে তাদের এক একর (৪০৪৬ বর্গ মিটার) জমিতে কয়েক দশক ধরে ধান চাষ করে আসছে।
এই চাষে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয় । কিন্তু গত পাঁচ বছরে তাদের এক বারও ভালো ফসল হয়নি, কারণ কাশ্মীরে বৃষ্টিপাত ক্রমশ অনিয়মিত হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘এই গরমকালে মনে হচ্ছে আমাদের সব আশঙ্কাই সত্যি হয়ে গেল। আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।’
২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে কাশ্মীরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, অর্থাৎ প্রতি দশকে গড়ে ০.৫ ডিগ্রি করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের শ্রীনগর কেন্দ্রের প্রধান মুখতার আহমদ জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে কাশ্মীর ইতোমধ্যেই তিনটি তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে, যার ফলে বড় বড় নদী ও ছড়া-ঝরনা শুকিয়ে গেছে। কাশ্মীরে সর্বত্র কম বৃষ্টিপাতের প্রভাব দৃশ্যমান
বান্ডিপোর জেলায় আলি মোহাম্মদের ১৫ একর জমিতে সারি সারি আপেল গাছ শুকিয়ে মরে যেতে বসেছে। বিশ বছর আগে, তিনি ধান চাষের জমিকে আপেল বাগানে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ তিনি অনুভব করেছিলেন যে আবহাওয়া এবং পানির অপর্যাপ্ত সরবরাহ ধান চাষের প্রতিকূল হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখন এমনকি আপেল গাছগুলোও —যার তুলনামূলকভাবে কম পানি প্রয়োজন—বেঁচে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।
আলি মোহাম্মদ জানাচ্ছেন , ‘বাগানগুলোতে মাসে অন্তত তিনবার পানির প্রয়োজন হয়, কিন্তু গত দুই মাস ধরে বৃষ্টি হয়নি এবং সেচের খালগুলো শুকিয়ে গেছে।’
এই তীব্র তাপদাহ বাসিন্দাদের উপরও প্রভাব ফেলেছে, যারা এত উচ্চ তাপমাত্রায় বসবাস করতে অভ্যস্ত নন। কাশ্মীরের বাসিন্দা ৬৩ বছর বয়সী পারভেজ আহমদ বলেন, ‘আমি জীবনে কখনও এত তীব্র গরমের প্রভাব দেখিনি।’
কয়েক দিন আগে তিনি মারাত্মক শ্বাসকষ্টে ভুগে হাসপাতালে ছুটে যেতে বাধ্য হন। তিনি জানান ডাক্তাররা বলেছেন, গরম ও আর্দ্রতার কারণেই এমন হয়েছে।পরিবেশবিদরা বলছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তন এই অঞ্চলে প্রভাব ফেলছে, যার ফলে শীত ও গ্রীষ্ম উভয় সময়েই চরম আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে এবং সেইসঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী শুষ্কতা।
গত বছর, এই অঞ্চলের বরফে ঢাকা পর্বতগুলোতে স্বাভাবিক তুষারপাত বিলম্বিত হওয়ায় কয়েক মাস ধরে সেগুলো অস্বাভাবিকভাবে বাদামি ও অনাবৃত ছিল। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে শীতকালে বরফপাত কমে গেছে, আর গ্রীষ্মের গরমের কারণে হিমবাহ গলনের গতি বাড়ছে, যা পানির সরবরাহ ব্যাহত করছে এবং মানুষের স্বাস্থ্য ও ফসলের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে, বলছেন গ্লাসিয়োলজিস্ট ও হাইড্রোলজিস্ট মোহাম্মদ ফারুক আজম। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, কাশ্মীরের বেশিরভাগ শীতকালীন বৃষ্টিপাত এবং তুষারপাত হয় পশ্চিমি অস্থিরতা থেকে। এগুলো ভূমধ্যসাগর অঞ্চল থেকে গড়ে ওঠে এবং পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়। তবে এই পদ্ধতিগুলো দুর্বল ও কম ঘনঘন হয়ে পড়েছে, যার ফলে তুষার পাত কমে যাচ্ছে এবং বরফ গলনে বিলম্ব হচ্ছে।
এতে করে জমি সময়ের চেয়ে আগেই উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে যা বেশি তাপ শোষণ করে। আওয়ন্তিপোরা জেলার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক জাসিয়া বশির বলেন, কাশ্মীরের শিল্পখাত সীমিত এবং এখানে প্রধানত কৃষি ও পর্যটনের ওপর নির্ভরতা থাকার কারণে এটি বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণের খুবই সামান্য অংশীদার।
তবুও, এই অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—এখানকার মানুষ এমন একটি সংকটের শিকার যার পেছনে তাদের কোনো হাত নেই।