Bangladesh

কুপের নির্ধারিত গভীরতায় যায়নি সিনোপ্যাক, গ্যাস অপচয়

সিলেট-১০ নম্বর কূপে গ্যাসের উচ্চচাপের কারণে নির্ধারিত গভীরতা পর্যন্ত কূপ খনন করেনি চীনা কম্পানি সিনোপ্যাক। এতে কূপটির নিচের স্তরের গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হবে না। এতে বিপুল পরিমাণ গ্যাস হারাতে পারে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী কূপটি তিন হাজার ৩০০ মিটার গভীর পর্যন্ত খনন করার কথা।

নির্ধারিত গভীরতায় যায়নি সিনোপ্যাক, গ্যাস অপচয়

আর জিওলজিক্যাল টেকনিক্যাল অর্ডার (জিটিও) অনুযায়ী কূপটি তিন হাজার ৫০০ মিটার গভীরে যাওয়ার কথা। টুডি ও থ্রিডি সাইসমিক সার্ভের রেজাল্টসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই জিটিও করেছিল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কম্পানি (বাপেক্স)।

কিন্তু সিনোপ্যাক দুই হাজার ৫৭৬ মিটার পর্যন্ত খনন করেছে। প্রকল্পের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা তিন হাজার ৩০০ মিটার পর্যন্ত যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই কূপ খননের কাজ শুরু করেন।

কিন্তু গ্যাসের উচ্চচাপের কারণে নির্ধারিত গভীরতা পর্যন্ত খনন করতে পারেননি।

জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী নিচের স্তরের গ্যাস আগে তুলতে হয়। পরে ধীরে ধীরে ওপরের স্তরের গ্যাস উত্তোলন করতে হয়। কিন্তু সিনোপ্যাক নির্ধারিত গভীরতায় যেতে না পারায় নিচের স্তরের গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘হাইপ্রেসারের (উচ্চচাপ) কারণে দুই হাজার ৫৭৬ মিটারের নিচে খনন করা সম্ভব হয়নি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল তিন হাজার ৩০০ মিটারে যাওয়ার। আমরা অনুমান করেছিলাম সেখানে চাপ থাকবে ছয় হাজার পিএসআইজি। এই চাপ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই আর গভীরে খনন করা হয়নি।’

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, উচ্চচাপের বিষয়টি একেক কূপে একক রকম। অনেক কূপে তিন হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৭০০ মিটার গিয়েও প্রেসারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, সিলেট-১০ কূপটিতে প্রেসার আসবে তিন হাজার মিটারের পর। কিন্তু এটি যে দুই হাজার ৬০০ মিটারেই চলে আসবে তা ধারণায় ছিল না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব সাধারণ কূপে ডিপ ড্রিলিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয় না। ডিপ ড্রিলিংয়ের প্রস্তুতি ছাড়া এর নিচে নামা সম্ভব নয়।

জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘আমরা সর্বনিম্ন স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করব। এখান থেকে ১০ থেকে ১৫ বছর দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্রিডে দেওয়া যাবে। তবে ওপরের স্তর থেকেও যদি দ্রুত গ্যাস নিতে চাই তাহলে পাশেই আরেকটি কূপ খনন করতে হবে। পাইপলাইনের কাজগুলো সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা করছি। যদি দুটি কূপ থেকেই গ্যাস নেওয়া হয় তাহলে যেন একই পাইপলাইনে ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস নিতে পারি।’  

জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল কাদের ভূঁইয়া বলেন, ‘মূলত উচ্চচাপের কারণেই আর নিচে যাওয়া সম্ভব হয়নি। জিওলজিক্যাল টেকনিক্যাল অর্ডারটি বাপেক্সের ধারণা মাত্র। জিটিওতে জ্বালানি তেল আবিষ্কারের ধারণাটিও ছিল না। কিন্তু আমরা তেল পেয়েছি। সেখানে দুই হাজার ৯০০ মিটারে চাপ পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা দুই হাজার ৫০০ মিটারে গিয়েই চাপ পেয়েছি।’

নির্ধারিত গভীরতায় যায়নি সিনোপ্যাক, গ্যাস অপচয়

জানতে চাইলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কম্পানির ঊর্ধ্বতন দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিলেট-১০ কূপটি অনুসন্ধান কূপ। তিন হাজার ৩০০ মিটার গভীরতায় যেতে হবে, তাই বাপেক্সকে দিয়ে কাজ না করিয়ে বিদেশি কম্পানিকে দেওয়া হয়। কিন্তু বিদেশি কম্পানি তিন হাজার মিটার পর্যন্তও যেতে পারেনি। জিটিওতে তো স্পষ্টভাবেই বলা ছিল, একটি পর্যায়ে গিয়ে উচ্চচাপ থাকবে। এর পরও কেন সিনোপ্যাক প্রস্তুতি নিয়ে কূপ খনন শুরু করেনি, সেটিই প্রশ্ন।

এই দুই কর্মকর্তা জানান, সিলেটের জকিগঞ্জে বাপেক্স যে কূপটি খনন করে সেটিতে চাপ ছয় হাজার ৩০০ পিএসআইজি ছিল। সিলেট-১০ কূপে সর্বোচ্চ চাপ ছিল পাঁচ হাজার ৮০০ পিএসআইজি। এর মানে জকিগঞ্জের তুলনায় এখানে চাপ অনেক কম থাকার পরও সিনোপ্যাক খননকাজ করতে পারেনি।

তাঁদের দাবি, দুই হাজার ৫৭৬ মিটার পর্যন্ত খনন করতেই দুবার পাইপ আটকে গিয়েছিল কম্পানিটির। প্রস্তুতি নিয়ে কূপ খনন করা গেলে বর্তমানে ছয় হাজার পিএসআইজি চাপ কোনো ব্যাপার নয়। দক্ষতার অভাবের কারণে কম্পানিটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। এতে কূপটিতে গ্যাসের বড় একটি অংশ মাটির নিচে থেকে যাবে।

সিনোপ্যাককে এটি ছাড়া আরো পাঁচটি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে। সবগুলোই সিলেট অঞ্চলের।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং নরওয়ের বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কম্পানি স্টেট অয়েলের (বর্তমানে ইকুইনর) গবেষক মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী তেল ও গ্যাস উত্তোলনের কূপ খনন করার আগে টার্গেট জোন (গ্যাস সেন্ড) নির্ধারণ করে কূপের গভীরতা ও পথ পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনামাফিক কূপ খনন করে নিচের স্তর থেকে প্রথমে গ্যাস উত্তোলন করে ধীরে ধীরে ওপরের স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়। কূপ খনন একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কূপ খননের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা করতে হয়। এতে কূপ খনন করার সময় বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি, যেমন—স্টাকপাইপ, বিস্ফোরণ ইত্যাদি হ্রাস পায়।

আমিরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি সিলেট-১০ কূপ খনন করার সময় স্টাকপাইপ হয়। ফলে নিচের স্তরের গ্যাস সেন্ডের মধ্যে ড্রিল না করেই সিমেন্টিং করে দিতে হয়েছে। এতে নিচের গ্যাসস্তরে ড্রিল করা বন্ধ হয়ে যায়। এতে কূপটির সর্বনিম্ন স্তরের গ্যাস নষ্ট হয়ে যাবে। এটি খননপ্রতিষ্ঠানের অদক্ষতার কারণে ঘটেছে।   ভবিষ্যতে কূপ পরিকল্পনা ও খনন করার জন্য অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছেন এই গবেষক।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) সূত্রে জানা গেছে, গত জুনে সিলেট গ্যাসক্ষেত্রের ১০ নম্বর কূপের খননকাজ শুরু করে সিনোপ্যাক। কূপ খননের কাজ শেষ করে এখন পরীক্ষা চলছে। এর মাধ্যমে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রবাহ হচ্ছে। পরীক্ষা শেষে এই অনুসন্ধান কূপ থেকে দৈনিক ১৫ থেকে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে দেওয়া সম্ভব হবে।

একই সঙ্গে এখনকার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে নেওয়ার জন্য পাইপলাইনের কাজ চলছে। ছয় মাসের মধ্যে পাইপলাইনের কাজ শেষ হবে। কূপটিতে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে তেলের সন্ধানও পাওয়া গেছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সিলেট ১০ নম্বর কূপে তেলের সন্ধান পাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ ব্যারেল (এক ব্যারেলে ১৫৯ লিটার) তেলের প্রবাহ পাওয়া গেছে। প্রথম দিন দুই ঘণ্টায় ৭০ ব্যারেল তেল উঠেছে। মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত হতে আরো অন্তত চার থেকে পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে স্থলভাগে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছিল পেট্রোবাংলা। এসব কূপ থেকে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই কূপ খনন করা হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports