Bangladesh

কুমিল্লায় উত্তেজনা, নেতাকর্মী আরও বিভক্ত ময়মনসিংহে: নিরুত্তাপ ভোটেও আ’লীগে দ্বন্দ্ব

ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ভোট আজ শনিবার। কুমিল্লায় উপনির্বাচন হচ্ছে শুধু মেয়র পদে। দুটি নির্বাচনেই দলীয় প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। ময়মনসিংহে দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হলেও ভোটারদের তেমন আগ্রহ নেই। তবে কুমিল্লায় বিরাজ করছে চরম উত্তেজনা, আছে সংঘাতের আশঙ্কাও। প্রশাসন বলছে, ভোট হবে শান্তিপূর্ণ

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটা বিষয় প্রায় নিশ্চিত, মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে যিনিই বিজয়ী হন, তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা। কারণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে সরকারি দলের নেতাদের মধ্যে। এর কুফল দুটি– স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোন্দল আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে, অন্যদিকে ভোটারদের তেমন আগ্রহ নেই। স্থানীয় নেতাকর্মী ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখানে ভোট ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে সরকারি দলের দ্বন্দ্ব। 

আজ শনিবার সিটি নির্বাচন। এখানে মেয়র পদে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পদ-পদবিতে রয়েছেন। জাতীয় পার্টি ছাড়া নিবন্ধিত কোনো দলের উল্লেখযোগ্য প্রার্থীও নেই। তবুও এ নির্বাচন নিয়ে স্বস্তিতে নেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটু (টেবিল ঘড়ি প্রতীক), এহতেশামুল আলম (ঘোড়া), সাদেকুল খান মিল্কী টজু (হাতি), ড. রেজাউল হক (হরিণ) এবং শহীদুল ইসলাম স্বপন মণ্ডল (লাঙল)। এ ছাড়া সাধারণ ৩৩ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩২টিতে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ১৪৯ জন (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত একজন)। সংরক্ষিত ১১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ৬৯। 
জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা অভ্যন্তরীণ ক্ষত এ নির্বাচন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। 

কোন্দলের বাইরে থাকতে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছেন।

এক বছরের বেশি সময় আগে জেলা ও মহানগর শাখার নতুন কমিটি গঠনের পর অনেকটা প্রশমিত হয়ে আসছিল আওয়ামী লীগের স্থানীয় বিভেদ। মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ইকরামুল হক টিটু এবং সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত অনেক কাছাকাছি এসেছিলেন। দলীয় কর্মসূচিতে একই সঙ্গে অংশ নিতেও দেখা গেছে তাদের। তবে দু’মাস আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সেই পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। পুরোনো বিভেদ আবার প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সংসদ নির্বাচনে সদর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শান্ত। তাঁর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন টিটুর বড় ভাই এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমিনুল হক শামীম। তখন থেকে স্পষ্ট দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। এবার সেই পুরোনো কোন্দল স্থায়ী রূপ দিয়ে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাক শুক্রবার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, টিটুর ভাই শামীম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় দ্বন্দ্ব বেড়েছে। না হলে আজ শান্তই সিটি নির্বাচনে টিটুর হয়ে সব দায়িত্ব পালন করতেন। 

এ নির্বাচনে কাউকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে তিনি নিজেকে পুরোপুরি বিরত রেখেছেন। কারণ, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা আওয়ামী লীগ ও মহানগর আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে কোনো প্রার্থীর সঙ্গে নেই। ব্যক্তিগতভাবে যার যাকে পছন্দ, তার পক্ষে মাঠে রয়েছেন।

আবদুর রাজ্জাক বলেন, নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে এটা দলের কৌশল হলেও এর নেতিবাচক দিক রয়েছে। খুব বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন তিনি। নেতাকর্মী বিভক্ত হয়ে তিন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে। তৃণমূল আওয়ামী লীগে বিভাজন স্থায়ী রূপ পাচ্ছে। ভবিষ্যতে এ দূরত্ব নিরসন কষ্টকর হবে।

আওয়ামী লীগের কর্মীরা বলছেন, ময়মনসিংহ জেলায় দলের মধ্যে জনসম্পৃক্ত নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। এখন যারা বিভিন্ন পদ-পদবিতে রয়েছেন, তারা শুধু নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। তাই দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নেও অনেক সময় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, সংসদ নির্বাচনে সদর আসনে শান্তর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন প্রায় দুই ডজন কাউন্সিলর। এবার ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪-৫টি বাদে এমপি শান্তর পক্ষ থেকে সব ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ নম্বর ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন ফরহাদ আলম। তিনি বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচিত। মেয়র প্রার্থী টিটুর পক্ষে প্রকাশ্যে স্লোগান দিতে দেখা গেছে তাঁকে।

সিটি নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি মহানগর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ হান্নান খান বলেন, বর্তমান প্রক্রিয়ায় যারা নির্বাচিত হচ্ছেন, তাদের সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসনের লোকজন জনপ্রতিনিধির মর্যাদা বা গুরুত্ব দেন না। কারণ সবাই জানে, তারা কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়ে আসছেন। তিনি আরও বলেন, এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে হলেও জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে– এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ আগের নির্বাচনগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও ‘প্রশাসনিক ফলাফল’ ঘোষণার আশঙ্কা রয়েছে।

একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় চারুশিল্প পর্ষদের সভাপতি মো. রাজন। তিনি বলেন, এ নির্বাচনের ফল পাল্টে দেওয়া বা কারচুপির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ সবাই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী। 

মেয়র প্রার্থী টিটুর পক্ষে প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়া সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের মহানগর শাখার সম্পাদক আলী ইউসুফ জানান, নির্বাচনে অন্য দলগুলো অংশ না নেওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ নিজ দলের একাধিক প্রার্থী দিয়েছে। এতে তাদের দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে। 

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, এবারের নির্বাচন শুধু টিটু ও শান্তর ব্যক্তিগত বিরোধেই সীমাবদ্ধ নেই। এর বাইরেও একাধিক উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি করেছে। 
টিটুর পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠান, মহানগর যুবলীগের একাংশ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগসহ দলীয় নেতাকর্মীর একাংশ কাজ করছে।

অন্যদিকে শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাদেকুল হকের পক্ষে সমর্থন দিয়ে মাঠে নেমেছেন গত জাতীয় নির্বাচনে শান্তর পক্ষে থাকা নেতাকর্মী। 

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফারুক আহাম্মদ খান, মহানগর যুবলীগের একাংশ ও এমপি শান্তর অনুসারীরা প্রকাশ্যে নেমেছেন সাদেকুল খান মিল্কীর পক্ষে।
এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম নিজে প্রার্থী হওয়ায় কিছু নেতাকর্মী তাঁর সঙ্গেও রয়েছেন।

এমপি শান্তর চেষ্টা ছিল টিটুকে আটকাতে নিজ বলয়ের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করে একজন প্রার্থী দেওয়া। সেই চেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সংসদ নির্বাচনে শান্তর পক্ষে কাজ করা নেতাদের মধ্যে চারজন মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের মনোনয়ন বাতিল হয় এবং একজন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। 
বাকি দু’জনের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন শান্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল ও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদেকুল ভোটের মাঠে লড়াইয়ে রয়েছেন। 

তিন দশকের বেশি সময় ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক ধর্মমন্ত্রী প্রয়াত অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের পরিবারের হাতে। নগরে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল মতিউরের ছেলে শান্তর। মতিউরের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করে নিজের অবস্থান জোরালো করে এক পর্যায়ে আলাদা বলয় গড়ে তোলেন টিটু ও তাঁর ভাই শামীম।
জেলা আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি শওকত জাহান মুকুল বলেন, নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হয় তা বলা যাচ্ছে না। স্থানীয় বিরোধ এর মাঝে কিছুটা কমলেও সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফের শুরু হয়। 

মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র টিটু বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান থাকলেও নির্বাচনের পর দলীয় কর্মকাণ্ডে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে তিনি মনে করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য শান্ত বলেন, সংসদ নির্বাচনের সময় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ যারা নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন, তা তাদের আদর্শিক স্খলন।

স্বাধীনতা কনসার্ট ঘিরেও নানা আলোচনা
গত ৫ ফেব্রুয়ারি নগরীর ঐতিহাসিক সার্কিট হাউস ময়দানে স্বাধীনতা কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন এমপি শান্ত। কিন্তু কনসার্ট শুরুর মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা আগে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে এমপি শান্ত এই কনসার্ট আয়োজন করায় তা বন্ধ করার জন্য চিঠি দেন মেয়র প্রার্থী টিটুর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আমিনুল হক শামীম। 

এমপি শান্ত এই কনসার্ট করতে ব্যর্থ হওয়ায় নগরে নানামুখী আলোচনা রয়েছে। একটি পক্ষ বলছে, কনসার্ট না করতে পারায় তার প্রভাব টিটুর ভোটে পড়বে। আরেকটি পক্ষ বলছে, কনসার্ট বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করায় ভোট বাড়বে টিটুর টেবিল ঘড়িতে। 

ভোটের তথ্য
নির্বাচনে মোট ভোটকেন্দ্র ১২৮টি, ভোটকক্ষ ৯৯০টি। মোট ভোটার ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭২ জন, নারী ভোটার ১ লাখ ৭২ হাজার ৬১৫ জন। হিজড়া ভোটার ৯ জন। ভোট হবে ইভিএমে। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, এপিবিএন, আনসার ব্যাটালিয়ন, সাধারণ আনসার মিলে থাকবে ৪ হাজার ৫০০ জন। পাশাপাশি ৩৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ১১ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে রয়েছেন। সাধারণ ভোটকেন্দ্রে পুলিশ ও আনসার মিলে ১৬ জন এবং গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করবেন।

১২৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪৩টি ভোটকেন্দ্রকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ (অতি গুরুত্বপূর্ণ) ও ৫৫টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ (গুরুত্বপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন চৌধুরী জানান, তারা সব কেন্দ্রকে সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d