Hot

কৃষি তথ্য সার্ভিসে মিলেমিশে লুটপাট: কেনাকাটাসহ বিভিন্ন খাতে কোটি টাকার বাণিজ্য

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে পরিচালকের সিন্ডিকেট

কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠান কৃষি তথ্যসার্ভিস (এআইএস)। রাজধানীর খামারবাড়িতে প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতর। সারা দেশেই রয়েছে এর কার্যক্রম। কৃষি খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন অগ্রগতি, সমস্যা সমাধানে করণীয়সহ কৃষিসংক্রান্ত খবরাখবর সব ধরনের গণমাধ্যমের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকের দোরগোড়ার পৌঁছে দেয়া এআইএস’র প্রধান কাজ। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সাথে গণমাধ্যমের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা। কিন্তু না; সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সে সম্পর্ক গড়ায়নি। শীর্ষকর্তা ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটির বেশির ভাগের সম্পর্ক বিভিন্ন ঠিকাদার ও পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে। কৃষি খাতের প্রচার প্রচারণার চেয়ে কাগজ কালিসহ বিভিন্ন কেনাকাটাতেই মনোযোগী তারা। প্রতিষ্ঠানটির গুটিকয়েক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ‘মিনি কেবিনেট’ হিসেবে পরিচিত এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন খোদ এআইএস পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায়।

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ডায়েরি মুদ্রণে লাখ লাখ টাকা লোপাট : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জন্য প্রতি বছর ১৩ হাজার ১০০টি উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ডায়েরি মুদ্রণ হয় এআইএস’র প্রেস থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রকাশিত ডায়েরির পেছনে (২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট) খরচ হয়েছিল ২৫ লাখ টাকার কিছু বেশি। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ডায়েরির পেছনে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিয়ে মুদ্রিত প্রতিটি ডায়েরির খরচ পড়েছে প্রায় ৪১২ টাকা। রাজধানীর নয়াবাজারে সরেজমিনে গিয়ে যাচাই করে জানা যায়, একই মানের ডায়েরি প্রকাশে প্রতিটিতে খরচ পড়বে ২৪০ টাকা থেকে ২৬০ টাকা। তাও আবার দামি ব্র্যান্ডের কাগজে। সে হিসেবে ১৩ হাজার ১০০ ডাইরি মুদ্রণে খরচ হবে ৩০ লাখ টাকা থেকে ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই ডায়েরি মুদ্রণে ২৪-২৮ লাখ টাকার বেশি গচ্চা দিতে হচ্ছে সরকারকে।
সরকারি বিধান অনুযায়ী, তিন লাখ টাকার উপরে কেনাকাটায় উন্মুক্ত দরপত্র দিতে হয়। কিন্তু এআইএস’র কর্তা বাবুরা নিজেদের সুবিধার্থে তিন লাখ টাকার নিচে (২ লাখ ৯০ হাজার ৮৯০ টাকা ও ২ লাখ ৯০ হাজার ৪০০ টাকা করে) ছোট ছোট কোটেশনে ভাগ করে প্রায় ৫৪ লাখ টাকার মুদ্রণ খরচ দেখিয়েছেন। প্রতিটি বিল-ভাউচারে স্বাক্ষর রয়েছে তৎকালীন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো: আবু জাফর আল মুনছুরের। পরিচালকের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই কেনাকাটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সিন্ডিকেটের কথা অস্বীকার করেন পরিচালক সুরজিত সাহা রায়। এক বছরের ব্যবধানে ডায়েরির মুদ্রণ ব্যয় কীভাবে দ্বিগুণেরও বেশি হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়েছে। এখন আবার কাগজের দাম কমেছে, দেখবেন, খরচ কিছুটা কমেছে। দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে অর্থ লোপাটের কথা তিনি অস্বীকার করেন।

মুদ্রণের কাগজ ও কালি কেনায় অনিয়ম : কৃষি তথ্যসার্ভিস থেকে নিয়মিত প্রকাশনা মাসিক কৃষি কথা, টেলিফোন নির্দেশিকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত বিভিন্ন সংস্থার লিফলেট, পরিচিতিসহ চাহিদার প্রেক্ষিতে বেশ কিছু মুদ্রণ করা হয়। এসব প্রকাশনা মুদ্রণে বিভিন্ন সাইজের কাগজ ও ৪ কালার কালি দরকার হয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় প্রায় ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। জুলাই থেকে চলতি অর্থবছর শুরু হওয়ার পরই এই কেনাকাটায় মনোযোগ দেন এআইএসের কর্তা বাবুরা। সারা বছর ব্যবহারের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ১ কোটি ৫২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৫ টাকার কাগজ ও কালি কিনেছেন তারা।

বিল ভাউচার যাচাই করে দেখা যায়, ২২-৩২ সাইজের পার্টেক্সের এক রিম কাগজ ২ হাজার ৭৪৭ টাকা হারে মোট ৩ হাজার ৫০০ রিম ৯৬ লাখ ১৪ হাজার ৫০৩ টাকায় কেনা হয়েছে। পুরান ঢাকার নয়াবাজারে কাগজের দাম যাচাই করে দেখা যায়, ২২-৩২ সাইজের পার্টেক্সের এক রিম কাগজের দাম ২ হাজার ১২৫ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে। সে হিসেবে ৩ হাজার ৫০০ রিম কাগজের দাম হয় ৭৪ লাখ থেকে ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই এক ধরনের কাগজেই ২০-২২ লাখ টাকা বেশি দর দেখানো হয়েছে। আরো ৫ ধরনের বিভিন্ন সাইজের কাগজ কেনা কাটাতেও একইভাবে বেশি দাম দেখানো হয়েছে। শুধু কাগজ নয়, কালি কেনাতেও ডাকাতি করা হয়েছে। কাগজের প্যাকেটের উপরে ব্র্যান্ডের নাম থাকলেও ভেতরে নিম্নমানের কাগজ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে মানের কাগজ ও কালি সরবরাহ করা হয়েছে তাতে এই কেনাকাটায় প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়েছে।

জানা যায়, এআইএস প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস কাগজ ও কালি কেনা কাটার সাথে সম্পৃক্ত। বেশি দাম দেখিয়ে অর্থ লোপাটের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। অন্যদিকে, বাজার যাচাই করেই কেনা কাটা হয়েছে বলে জানান পরিচালক সুরজিত সাহা রায়।

কৃষি ডকুমেন্টারি তৈরিসহ অন্যান্য কেনাকাটায় অনিয়ম : কৃষি রিলেটেড বিভিন্ন সংস্থা/ প্রকল্পের ডকুমেন্টরি করে থাকে এআইএস। প্রায় দুই ডজন ডকুমেন্টরির বিল ভাউচার যাচাই করে দেখা গেছে এর বেশির ভাগের তৈরি খরচ পড়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে। এআইএস-এ ২ জন অভিজ্ঞ ভিডিও ক্যামেরা ম্যান, সহকারী ক্যামেরা ম্যান, ভিডিও এডিটর, লাইটিং এসিস্ট্যান্ট, উন্নত যন্ত্রাংশসমৃদ্ধ স্টুডিওসহ সব সাপোর্টই থাকার পরও বাইরে থেকে করানো হচ্ছে এসব। এমনকি এআইএসের জন্য একটি ড্রোন কেনার প্রায় বছর পার হলেও তা অফিসকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফিল্ম প্রডাকশন অফিসার মোসলেহ উদ্দিনের মাধ্যমে ডকুমেন্টরিগুলো তৈরি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্যাডে বিল ভাউচার তৈরি করা হয়। এতে সহায়তা করেন এআইএসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সঞ্জিত কুমার ভৌমিক ও ক্যাশিয়ার মো: জুয়েল হোসেন। মানহীন এসব ডকুমেন্টরি তৈরি করে কলাকৌশলীসহ বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়ে সবাই মিলে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শুধু ডকুমেন্টরি নয়, সাতটি বেসরকারি টিভিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরিষার তেলবিষয়ক টিভিসি প্রচার বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। যদিও এই বিলে সংশ্লিষ্ট টিভির বিল ভাউচার পাওয়া যায়নি। ‘কৃষকের চ্যাট জিটিপি’র নামে তিনটি কোটেশনে সুকৌশলে ১১ লক্ষাধিক টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া, অত্র দফতরের ইউপিএস, আইপিএস সার্ভিসিং খরচ বাবদ প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। অনলাইন পিডিএস ডাটাবেইজ ও সিকিউরিটি হোস্টিং ক্রয়ে ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা খরচ দেখানো হলেও সুকৌশলে আবার কৃষি ডিরেক্টরি ওয়েব সাইড ও মোবাইল অ্যাপস আপডেটের নামে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকার বিল ভাউচার করা হয়েছে। আবার এআইএস ইউটিউভ ড্রাইভ এ ডাইরেক্টরি সফটওয়্যার আপডেট করার কথা বলে আরো ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকার ভাউচার করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এলইডি ডিজিটাল সাইনবোর্ড তৈরিতে ২৬ লাখ খরচ?
কৃষি তথ্যসার্ভিসের বিভিন্ন কার্যালয়ে (এআইসিসি) মোট ৯০টি ডিজিটাল এলইডি সাইনবোর্ড তৈরিতে প্রায় ২৬ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই ১০টি কোটেশনের মাধ্যমে (প্রতিটি কোটেশনে ২,৯০,০০০) এই সাইনবোর্ড সরবরাহ দেখিয়ে অর্থ লোপাট করেছে। এ খাতে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর সঞ্জিত কুমার ভৌমিক, ক্যাশিয়ার মোঃ জুয়েল হোসেন, টেকনিক্যাল পার্টিসেন্ট/ আইসিটি ইনচার্জ বাদল চন্দ্র সরকার এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌসকে নিয়ে একটি মিনি কেবিনেট করেছেন পরিচালক সুরজিত। এই কেবিনেটে একজন নারী কর্মকর্তাও রয়েছেন।
এদের মধ্যে টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট বাদল চন্দ্র সরকার একজন ডিপ্লোমা কৃষিবিদ হলেও ‘আইসিটি ইনচার্জ’র অতিরিক্ত দায়িত্ব তার উপর বর্তানো হয়েছে। ননটেকনিক্যাল হয়েও সামলাচ্ছেন এআইএস ল্যাব। আইসিটিসংক্রান্ত সব ইক্যুইপমেন্ট কেনাকাটা ও মেরামত, কথিত উদ্ভাবনীর নামে লাখ লাখ টাকার বিল ভাউচার তার হাত দিয়ে।
অন্যদিকে, এআইএস-এ না থেকেও পরিচালকের সব কার্যক্রমেই ছায়া হয়ে কাজ করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) সরেজমিন উইংয়ের উপ-পরিচালক (ডিডি) মো: আবু জাফর আল মুনছুর। এ ব্যাপারে কথা বলতে তার ফোনে বারবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি।

বিসিএস ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা সুরজিত সাহা রায় এর আগেও পরিচালক হিসেবে ছিলেন। অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় তখন তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয়বার একই পদে আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এআইএস থাকা অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেন সুুকৌশলে। নতুন কর্মকর্তাদের অনেকটা সাইটে রেখে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কেনাকাটাসহ সব কিছু পরিচালনা করে আসছেন। নতুন কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই নারী। তাদের সাথেও খারাপ ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব ধরনের কার্যক্রমে কয়েকজন কর্মচারীকে প্রাধান্য দেন ডিরেক্টর স্যার। তিনি কথায় কথায় বলে থাকেন বর্তমান কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মূলত সচিব স্যার তার বন্ধু এটাকে পুঁজি করেই সব কিছু করে যাচ্ছেন ডিরেক্টর স্যার। এখানে কারো কিছুই বলার নেই।
এসব বিষয় নিয়ে গত সোমবার সন্ধ্যায় পরিচালক সুরজিত সাহা রায়ের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা কেনাকাটাসহ সব অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন। কথায় কথায় সচিব বন্ধু বলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সচিব আমার বন্ধু হতে পারেন। কিন্তু, সচিব তো সচিবই। সচিব আমার বস।’ এ বিষয়ে কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তারকে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button